শনির হাওর ডুবে যাওয়ায় সোনালি ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন তলিয়ে যায় কৃষকের। গতকাল কয়েকজন কৃষককে পানির নিচ থেকে ধান কেটে তুলতে দেখা যাচ্ছে। ছবি : আশকার আমিন রাব্বি
২৫ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫১

ধান মাছ সব গেছে বেঁচে থাকাই দায়

► পাগনার হাওরও তলিয়ে গেল
► সুনামগঞ্জের ১৩৩টি ছোট-বড় হাওরের ফসল ডুবে গেছে
►মাছ মরেছে ১২৭৬ টন
► ১০ হাজার হাঁসের মৃত্যু
► ১১৯ হেক্টর জমির সবজিও নষ্ট হয়েছে

‘মাছ আর ধান, হাওরাঞ্চলের প্রাণ’—এ কথা গর্ব করেই বলে থাকে হাওরাঞ্চলের মানুষ। কিন্তু এবার ধানও নেই, মাছও নেই। আছে শুধু সব হারানোর হাহাকার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার তলিয়ে গেছে পাগনার হাওরের অবশিষ্ট অংশ। একের পর এক হাওর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পুরো সুনামগঞ্জ জেলার কৃষি অর্থনীতি এখন চরম হুমকির মুখে। পরিবেশ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মার্চের শেষের দিকে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের হাওরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আধাপাকা ও কাঁচা বোরো ধান তলিয়ে যায়।
হাওরের পানিদূষণে ও পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকায় প্রায় ৪১ কোটি টাকা মূল্যের এক হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে বলে গতকাল প্রতিবেদন দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাছ ছাড়াও তিন হাজার ৮৪৪টি হাঁস মারা গেছে। শুধু সুনামগঞ্জে ৫০ মেট্রিক টন মাছ মারা গেছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানালেও স্থানীয় লোকজনের দাবি, এর পরিমাণ অন্তত দুই হাজার টন। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে প্রায় ১০ হাজার হাঁস মারা গেছে বলেও স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে।
আচমকা এই বিপর্যয়ে জেলার তিন লাখ কৃষিনির্ভর পরিবার এখন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ তত্পরতা জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক হাওরে কৃষিঋণ আদায় স্থগিত রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
সুনামগঞ্জে কৃষি অর্থনীতি হুমকির মুখে : গতকাল জেলার দেখার হাওর, খরচার হাওর এবং শনির হাওর সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। জেলার ১৩৩টি ছোট-বড় হাওরের সবকটির ফসল এখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাহিরপুর উপজেলার সর্ববৃহৎ শনির হাওর কোনোমতে টিকে থাকলেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁধ ভেঙে গত দুই দিনে এই হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল তলিয়ে গেছে। একইভাবে গতকাল তলিয়ে গেছে পাগনার হাওর। কৃষকদের সর্বনাশের ষোলোকলাই যেন পূর্ণ হলো।
‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের সদস্যসচিব বিন্দু তালুকদার আক্ষেপ করে বলেন, ‘হাওরের বোরো ফসলে বাংলাদেশের ত্রিশ দিনের খাবার হয়। এটা জনশ্রুতি হলেও বাস্তবতাও তাই। অথচ কৃষি অর্থনীতির সেই বিশাল ভাণ্ডার আজ শূন্য এবং নিঃস্ব। খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকার প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক পরিবার। ’
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, জেলায় এ বছর দুই লাখ ২৩ হাজার ৮৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। ফলনও হয়েছিল ভালো। প্রায় আট লাখ ৪৩ হাজার টন চাল পাওয়া যেত এই পরিমাণ ধান থেকে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা। গত ২৯ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে বাঁধ ভেঙে গতকাল পর্যন্ত জেলার সবগুলো হাওর তলিয়ে গেছে। সরকারি হিসাবেই গত সোমবার পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯০ ভাগ। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। শুধু ধানই নয়, এই অকালের বর্ষণ ও ঢলে জেলার প্রায় ১১৯ হেক্টর জমির সবজিও নষ্ট হয়ে গেছে। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
এই অঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্যের পাশাপাশি পরিবেশ, মাছ, গবাদি পশুসহ জলজ জীববৈচিত্র্যেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খাদ্যশস্যের ক্ষয়ক্ষতি সাময়িক হলেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এখনো নিরূপণ করা যায়নি। যাঁরা হাওরে পানি ও জীববৈচিত্র্য পরীক্ষা করে গেছেন তাঁরাও আশঙ্কা করছেন প্রজনন মৌসুমে মাছ মারা যাওয়ায় আগামীতে এর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে আমন-বোরো মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৯৭ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে জেলার চাহিদা চার লাখ ১৪ হাজার ৬১৫ টন। প্রতিবছর উদ্বৃত্ত থাকে প্রায় পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৩৪৯ টন।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, সুনামগঞ্জ জেলায় প্রতিবছর ৮৯ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়। জেলার স্থানীয় চাহিদা ৫৪ হাজার টন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকে ৩৫ হাজার টন। সরকারি হিসাবে গত ১৭ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫০ টন মাছ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও মৎস্যজীবী ও কৃষকদের মতে, এই দুর্যোগে প্রায় দুই হাজার টন মাছের ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় প্রায় ১০ লাখ গবাদি পশু রয়েছে। যা চাষবাসের প্রধান মাধ্যম। ২৫ লাখ হাঁস রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজারের মতো হাঁস মারা গেছে। এ ছাড়া আরো লক্ষাধিক বিভিন্ন ধরনের পশু-প্রাণী রয়েছে। সবগুলো হাওর তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশু খাদ্য সংকেট পড়েছে। ২০১৪ সালেও জেলায় বৈশাখে প্রায় হাজারো গবাদি পশু মারা গিয়েছিল। এ বছর গবাদি পশু মারা না গেলেও গো-খাদ্য না থাকায় চাষিরা চিন্তিত। অনেকে গো-খাদ্য সংকটের কারণে সস্তায় গবাদি পশু বিক্রি করে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে খাদ্য উদ্বৃত্ত সুনামগঞ্জের কৃষি অর্থনীতি এখন হুমকির মুখে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকরা জানায়, এ বছর নিকট অতীতের চেয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়লেও কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। বিশেষ করে এক ফসলের ওপর নির্ভরশীল কৃষক গত ১০ বছরে পুরো ফসল কখনো ঘরে তুলতে পারেনি।
জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন, প্রতিবছরই ক্ষতি গুনছে হাওরের লাখ লাখ কৃষক। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এই কৃষকরা এখন ক্ষতি গুনতে গুনতে নিঃস্ব হওয়ার পথে। কৃষি পুনর্বাসন তো দূরের কথা, ক্ষতির ন্যূনতম সহায়তাও পায় না তারা। তা ছাড়া কৃষকরা উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় তারা এ পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ কারণে হাওরের কৃষি অর্থনীতি এখন সংকটের মুখে।
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য : গতকাল বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিসহ জীববৈচিত্র্য পরীক্ষা করতে আসে। প্রতিনিধিদলের সদস্য ড. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, একটি জলাধারে মাছের জন্য অক্সিজেনের মাত্রা ০.৫ থাকার কথা। টাঙ্গুয়ার হাওরে কোথাও ০.৩ কোথাও ০.৪ মাত্রা পাওয়া গেছে।
পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘হাওরের গঠন, জীববৈচিত্র্য ও বিশাল সম্পদের কারণে জাতীয়ভাবে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। কিন্তু বরাবই এই সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বছরও দৃশ্যমান ক্ষতির পাশাপাশি অদৃশ্য পরিবেশ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি হবে। ’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও নদী গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাসুদ হোসেন খান বলেন, হাওরের পানিদূষণে মাছ মারা গেছে। অন্যান্য জলজ জীববৈচিত্র্যও আক্রান্ত হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওর ও চর ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে কৃষি, মৎস্য, পশুপালন ও কৃষি-অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি সমন্বয়ক দল নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের তেঁতুলিয়া গ্রামের ডিঙ্গাপোতার আশপাশের হাওর এলাকা পরিদর্শন করে। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. আবদুর রহমান সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ডিঙ্গাপোতার আশপাশের হাওরগুলো থেকে তাঁরা পানি ও মাটি সংগ্রহ করেছেন। পানির বর্তমান অবস্থা ভালো, অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রয়েছে। এ অবস্থা থাকলে মাছ কিংবা জলজ এলাকায় বসবাসরত প্রাণীর মৃত্যুঝুঁকি নেই। আরো গবেষণার জন্য তারা নমুনা সঙ্গে নিয়েছেন।
এ সময় অন্যদের মধ্যে ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক জাকির হোসেন, অধ্যাপক আবু হাদী নূর আলী খান, অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র দাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আজ মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওর পরিদর্শন করবে। আগামী বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন দেবে বলে জানান বিশেষজ্ঞ দলের আহ্বায়ক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক।
তলিয়ে গেল পাগনার হাওরের অবশিষ্ট অংশ : সুনামগঞ্জের পাগনার হাওরের অবশিষ্ট অংশও গতকাল বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে। ভোর ৫টায় হাওরের উড়ারবাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে। একই সময়ে গাজিরগাঁওসংলগ্ন পাতলিচোরা জলাশয়ের পাশে কাউয়ার বাধা বাঁধেও ফাটল সৃষ্টি হয়। দিরাই উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের আওতাধীন বেড়িবাঁধের অংশে ডালিয়া স্লুইস গেটের পশ্চিমের ক্লোজার ও পূর্বের দুটি ক্লোজারে পর্যাপ্ত বাঁশ-বস্তা, পলিথিন না থাকায় এই ভাঙনের ঘটনা ঘটে বলে কৃষকরা জানান। এ ছাড়া হাওরের করাটিয়া বাঁধ, ডালিয়া স্লুইস গেট, পূর্বের পাতলিচোরা বিল পর্যন্ত বেড়িবাঁধের নিচু জায়গা দিয়েও হাওরে পানি ঢুকছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, এ হাওরে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ ছিল। কৃষকদের অভিযোগ, এই বাঁধে প্রাক্কলন অনুযায়ী যথাসময়ে কাজ হয়নি। ফলে পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কায়ই গত মাসের ৩০ তারিখের দিকে ঝুঁকির মুখে পড়ে। এর পর থেকেই কৃষকরা বাঁধে স্বেচ্ছায় বাঁধ রক্ষার কাজ করছিলেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পাগনার হাওরটি দিরাই ও জামালগঞ্জ উপজেলাবেষ্টিত। এই দুই উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার কৃষক পরিবার এই হাওরে চাষবাস করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ হাওরে প্রায় ১৬ হাজার ১১৭ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে এবার আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ হেক্টর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. জাহেদুল হক বলেন, পাগনার হাওরের প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমির ধান আগেই তলিয়েছিল। এখন বাঁধ ভাঙার কারণে অবশিষ্ট জমির আধাপাকা ধানও তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্র চাষি, প্রান্তিক চাষি, মৎস্যজীবীসহ হাওরের ওপর নির্ভরশীল প্রায় দেড় লাখ পরিবারের জন্য তিন স্তরের খাদ্যনিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভিজিএফ, ওএমএস ও ১০ টাকা কেজির চালের মেয়াদ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকার প্যাকেজটি দু-তিন দিনের মধ্যেই চালু করা হবে। দেড় লাখ পরিবারের তালিকা প্রায় প্রস্তুত করা হয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/25/49049