২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:০৮

এমপি লিটন হত্যা

মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ও অভিযুক্তদের ক্ষতিপূরণসহ মুক্তি দেয়া উচিত

গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম হত্যার আসল আসামী ও তার সহযোগী পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের প্রেক্ষাপটে মিথ্যা অভিযোগে এই হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত নির্দোষ জামায়াত নেতাকর্মী এবং বিএনপিসহ অন্যান্য দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ও হয়রানি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মূল আসামী ধরা পড়ার আলোকে সহযোগী একটি দৈনিক প্রশ্ন করেছেন, তাহলে “আগে গ্রেফতার ১৫৫ জনের কি হবে?” উল্লেখ্য যে, গত ৩১শে ডিসেম্বর (২০১৬) সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গাইবান্ধায় আঁততায়ীরা তার নিজ বাড়িতে গুলী করে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন দল, তার জোটের শরিক এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কিছু অতি উৎসাহী ও সরকার সমর্থক কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে এবং পুলিশ এই অভিযোগে গাইবান্ধা ও তার আশপাশ জেলার ১২৩ জন জামায়াত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে চরম নির্যাতন করে। তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়, রিমাণ্ডে নিয়ে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার বানানো হয় এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। তাদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক নির্যাতন অত্যাচারী ফেরাউনদেরও হার মানায়। জামায়াতের ১২৩ জন নেতাকর্মী ছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততা দেখিয়ে বিএনপি’র ৩০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে নির্যাতন করে এবং লোক দেখানোর জন্য সুন্দরগঞ্জের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আহসান হাবিব ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা মাসুদুর রহমান মুকুলকেও গ্রেফতার করে। আওয়ামী লীগ নেতাদের এই গ্রেফতারটি ছিল জনাব লিটনের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে।

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আমাদের পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ। তারা শত প্রলোভন, প্ররোচণা এবং ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে আসল আসামীদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করেছেন। আসামীদের সকলেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। মূল আসামী ও হত্যাকা-ের পরিকল্পনাকারী এবং অর্থ সরবরাহকারী সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও আওয়ামী জোটের বড় শরিক জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খান পরিষ্কার বলেছেন যে, তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য হবার পথ পরিষ্কার করার জন্য মঞ্জুরুলকে হত্যা করিয়েছেন, পরিকল্পনা করেছেন, ভাড়াটে লোক নিয়োগ করে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করেছেন। এমনকি তার বাড়িতে অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। খুনের কাজে ব্যবহৃত অস্ত্রের খোঁজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বাড়ির দু’টি পুকুর সেঁচে শুকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু অস্ত্র পাননি। পক্ষান্তরে তার জবানবন্দী অনুযায়ী গাছের তলার মাটি খুঁড়ে ঐ অস্ত্রও উদ্ধার করেছেন। তার নিযুক্ত ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী খুনীরাও স্বীকার করেছেন যে, তারা ঐ অস্ত্র দিয়ে জনাব কাদের খানের নির্দেশ অনুযায়ী জনাব মঞ্জুরুলকে হত্যা করেছেন। এখন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যাকা-ের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কোর্টে প্রদত্ত হত্যাকারীদের জবানবন্দী এবং অর্থদাতা ও পরিকল্পনাকারীর জবানবন্দী মিলে গেছে। এই অবস্থায় এই হত্যাকা-ে অন্য কারোর সম্পৃক্ততার আর কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। এখন বিচার তার নিজস্ব গতিতে চললেই ইনসাফ কায়েম হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াতের গ্রেফতারকৃত ১২৩ জন নির্দোষ নেতাকর্মী বিএনপির ৩০ জন এবং আওয়ামী লীগের ২ জন নিরপরাধ আসামীর কি হবে? তারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের সম্মানহানি হয়েছে এবং লোকচক্ষে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছেন। পেশাগতভাবে তারা ক্ষতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন এবং কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চরম অবমাননাকর অবস্থায় দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা এ দেশেরই মানুষ, সরকারকে খাজনা দেন, আইন মেনে চলেন এবং নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন। মিথ্যা অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত ও গ্রেফতার করে তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত করা হয়েছে তেমনি তাদের বৈধ নাগরিক অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। স্বয়ং খুনি যেখানে খুনের দায় স্বীকার করেছেন, মোটিভ সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন, খুনের কাজে ব্যবহৃত সন্ত্রাসী ও অস্ত্র প্রভৃতি সম্পর্কে আদালতে পরিষ্কার ভাষায় জবানবন্দী দিয়েছেন সেখানে নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি না দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই অবস্থায় তাদের শারীরিক, মানসিক ক্ষতি, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থহানি, মানহানিসহ যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে যখন যেখানে অপরাধমূলক ঘটনা-দুর্ঘটনাই ঘটুক না কেন সরকারি কর্মকর্তা ও নেতা-পাতিনেতারা কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই তার দায় জামায়াতের ওপর চাপায়। লিটন হত্যার দায়ও তারা এই দলটির ওপর চাপিয়েছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে জামায়াত তার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এখন অলৌকিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, জামায়াত এই হত্যার সাথে জড়িত নয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাহলে তাদের মুক্তিতে বাধা কোথায়? আর ক্ষতি যখন করেছেনই ক্ষতিপূরণে আপত্তিই বা কেন?

উপমহাদেশের ইতিহাসে বিনা অপরাধে জামায়াতের মতো নির্যাতিত দল সম্ভবত আর নেই। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ইসলামের অনুসরণ ও অনুশীলন তাদের অপরাধ। এই অপরাধে তাদের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলসমূহ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০০৯ সালে আওয়ামী জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াতের ৫ জন শীর্ষ নেতাকে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে সরকার ফাঁসি দিয়েছেন। প্রকাশ্যে গুলী করে জামায়াত, বিএনপির ১২১ জন এবং শিবিরের ৩৭৭ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১২৮৩ জন, অর্থাৎ ফাঁসি, ক্রসফায়ার, প্রকাশ্যে গুলী প্রভৃতির মাধ্যমে মোট ১৭৮৬ জন জামায়াত-শিবির ও গণতন্ত্রকামী কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন। এছাড়াও পুলিশ কর্তৃক জামায়াতের ৯০,২০০ জন পুরুষ ও ৯৫৩ জন মহিলা কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন যথাক্রমে ৬০৬২০ এবং ৯৫১ জন। এদের মধ্যে নৃশংস নির্যাতনের মাধ্যমে অনেককে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। মামলা করা হয়েছে ২০৩৯৬০টি, আহত হয়েছেন ৭৮৩১৩ জন। বাগেরহাটের অজোপাড়াগাঁয়ের মসজিদের একজন নিঃস্ব ইমামের আমি সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম যার বিরুদ্ধে ৪৭টি মামলা। তার ঘরে চালচুলো নেই। কি নিমর্মতা! প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী চাকরিচ্যুত মসজিদের ইমাম ও মাদরাসা শিক্ষকদের সংখ্যা হচ্ছে ৭৮০০, স্কুল শিক্ষকের সংখ্যা ৪৯০০ জন।

পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে গত ৮ বছরে চরমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে জামায়াত সমর্থক ৯৫৯১০ জন লোককে। তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও অপরিসীম। জামায়াতের ৩০ হাজার নেতাকর্মী তাদের বাড়িঘরে থাকতে পারেন না। তাদের ২৫০০০ বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং বাড়িঘর, দোকানপাট ও কলকারখানায় হামলা করে প্রায় ৫০০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সহায়সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। আরামবাগে জামায়াত সমর্থক দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশক কোম্পানি বাংলাদেশ পাবলিকেশনস-এর একটি ৯ তলা ভবন, দু’টি চারতলা ভবনসহ ১৫ একর জমি স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় ওয়ার্ড কমিশনার ও তার সন্ত্রাসী সহযোগীরা জবরদখল করে আছে। সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে কোনও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে ইউনিয় পর্যায় পর্যন্ত দফতরগুলো বন্ধ; সরকার এগুলো খুলতে দিচ্ছেন না। জামায়াত নেতাকর্মী, এমনকি মহিলা এবং ছাত্রীরা পারিবারিক বৈঠক কিংবা সাংগঠনিক সভা অথবা কুরআন হাদিস চর্চার লক্ষ্যে কোনও বৈঠকে বসতে পারেন না, বসলে নাশকতার অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতার করা হয়। দেশ একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পর্দানশীন মহিলাদের উপর বৃটিশ উপনিবেশিক আমলেও এতো নির্যাতন হয়নি যা এখন হচ্ছে। কুরআন হাদিস ইসলামী বই এখন উপহাসের পাত্র...সন্ত্রাসী বই....তাদের ভাষায় জিহাদী বই। কুরআনের এই অবমাননা অসহনীয়।

সরকার সজ্ঞানে এগুলো করছেন বলে আমার মনে হয় না; যাদের পরামর্শে তারা এই অন্যায় অবিচারগুলো করছেন, নির্দোষ মানুষকে দোষী বানিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন তারা তাদের ডোবানোর জন্যই তা করছেন। অবিলম্বে এই অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটা উচিত বলে আমি মনে করি।

http://www.dailysangram.com/post/273666