২০১৭ সালের প্রাক-নিবন্ধিত সকল হজ্বযাত্রীদের হজ্বে পাঠানোর দাবিতে গতকাল রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে হাব সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১:৪৩

হজ্ব কার্যক্রমের শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ

প্রাক-নিবন্ধন বাতিলের দাবি

চলতি বছরের হজ্ব¡ কার্যক্রমের শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট আইটি সংস্থা বিজনেস অটোমেশনের বিরুদ্ধে। প্রাক-নিবন্ধন করতে গিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করতে না পারা ও ব্যাংক থেকে বিলম্বে অনুমোদন দেয়ায় প্রায় ৫ শতাধিক এজেন্সির হজ্ব¡যাত্রীরা কোটার বাইরে পড়ে গেছে। যার ফলে তাদের হজ্ব¡যাত্রীগণ এ বছর হজ্বে¡ যেতে পারবেন না। এ বছর নিবন্ধিত সকল হজ্ব¡যাত্রীদের হজ্বে¡ গমনের ব্যবস্থা করা, অথবা প্রাক-নিবন্ধন বাতিল করে নতুনভাবে নিবন্ধন করার দাবি জানিয়েছে এজেন্সিগুলো। অন্যথায় তারা আদালতে মামলা দায়ের করবে বলে জানিয়েছে।

বেশ কয়েকটি এজেন্সি মালিকরা জানিয়েছে, তারা সার্ভারের সমস্যার কারণে ব্যাংক থেকে বিলম্বে অনুমোদন পান। যার ফলে তাদের হজ্ব¡যাত্রীগণ কোটার বাইরে চলে যায়। সকাল ১০টায় ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া হলেও বিকেল ৫টার পর তাদের অনুমোদন দেয়া হয়। আর প্রাক-নিবন্ধন চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন সার্কুলার জারি হওয়ায় তারা বিভ্রান্তিতে পড়েন। এমন কী ব্যাংকে টাকা জমা নেয়ার সময়সীমা বাড়ানোর সার্কুলার প্রকাশের ক্ষেত্রেও অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। এসব কারণে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে এজেন্সিগুলোকে। হামযা এয়ার ইন্টারন্যাশনালের (লাইসেন্স ৮১১) ১৬০ জন এবং উইংস ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস (লাইসেন্স ১৫৪) এর ১৫১ জন হজ্ব¡যাত্রীর সবাই কোটার বাইরে পড়েছে। অনিয়মের কারণে প্রাক-নিবন্ধন বাতিল করে নতুন করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রাক নিবন্ধনের দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট হজ্ব এজেন্সিগুলো। ইতোমধ্যেই হজ্ব¡ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) পক্ষ থেকে অনিয়মের বিষয়টি ধর্মমন্ত্রীকে মৌখিক ও লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। মন্ত্রী অনিয়মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়ে বিষয়টির সুরাহার আশ্বাস দিলেও চারদিনেও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। এ নিয়ে হজ্ব এজেন্সিগুলো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু এজেন্সি আইনের আশ্রয় নেয়ার চিন্তা করছেন বলেও জানা গেছে।

সূত্রমতে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রাক-নিবন্ধন কার্যক্রম চলে। শুরুর প্রথম তিনদিনেই প্রাক-নিবন্ধনের সিরিয়াল নির্ধারিত কোটা ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৫২ জন অতিক্রম করে। আর এ সময়ের মধ্যেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, গোপনে নোটিশ জারি, রাতেও ব্যাংকে ভাউচার গ্রহণ, মফস্বল এলাকায় ব্যাংকের শাখায় রহস্যজনকভাবে বেশি হজ্ব¡যাত্রীর প্রাক নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়া, ঢাকায় কয়েকটি ব্যাংকে সকাল ১১টায় টাকা জমার পর তা বিকাল ৪টায় পোস্টিং হয়ে প্রাক-নিবন্ধনের সিরিয়াল পড়ার ঘটনা ঘটে।

এসব অনিয়মের বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার পর ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় হাব কার্যালয়ে হাবের জরুরি ইসি সভায় এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবির পাশাপাশি বিকল্প কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে হাব নেতারা ধর্মমন্ত্রীর বাসায় যান। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় হাব সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেও রাতে মন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তা স্থগিত করে। মন্ত্রী অনিয়মের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সমস্যা সমাধানে হাবের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাব চান। হাব নেতারা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মন্ত্রীকে লিখিত প্রস্তাব দেন। কিন্তু তারপর এ ব্যাপারে আর কোনো কিছুই জানানো হয়নি।

চলতি বছর সরকারি-বেসরকারি মিলে বাংলাদেশের হজ্ব¡যাত্রীর কোটা ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৮ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনার ১০ হাজার। এছাড়া গত বছরের প্রাক-নিবন্ধিত হজ্ব¡যাত্রী রয়েছেন ৩৭ হাজার ৪৯৪ জন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ্ব¡বিষয়ক ওয়েব পোর্টালে দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৯৫ জনের সিরিয়াল থেকে এ বছরের নতুন প্রাক-নিবন্ধন শুরু হয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রাক-নিবন্ধনের সিরিয়াল দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭০২ জন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধর্ম মন্ত্রণালয়র এক সার্কুলারে (নং- ১৬.০০.০০০০. ০০৩.৩০.০০২. ২০১৬-৩১৫) উল্লেখ করা হয় নিবন্ধন চালুর পর থেকে কোনো হজ্ব¡ এজেন্সি যদি নিয়মের বাইরে কোনো রকম কার্যক্রম করে বা ডাটা এন্ট্রি /ভাউচার/ টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে জাতীয় হজ্ব ও ওমরাহ নীতির বাইরে অস্বাভাবিক এবং অনিয়ম করে, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। স্মারকে বলা হয়েছিল একটি এজেন্সি তাদের নির্ধারিত কোটা ১৫০ জনের কম হলে ব্যাংকের কোনো ভাউচার জমা দিতে পারবে না এবং কোনো ব্যাংক আংশিক হজ্বযাত্রীর কোনো ভাউচার গ্রহণ করবে না। অথচ ১৯/০২/২০১৭ তারিখে রাতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট থেকেই জানা যায়, ২৯৩ টি এজেন্সি ১৮টি ব্যাংকের ৮৬টি শাখার মাধ্যমে প্রায় ৮ হাজার হজ্বযাত্রীর ভাউচার জমা দিয়ে প্রাক-নিবন্ধন সম্পন্ন করে ফেলেছে। অথচ যাদের কেউই ১৫০ জনের কোটা পুর্ণ করেনি। এই জন্য তাদের বিরুদ্ধে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে ওইদিন রাত ৯টায় কারণ দর্শানোর নোটিশও জারি করা হয়। একই নোটিশ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রতিও জারি করা হয়। কিন্তু পরক্ষণেই রাতে আবার দেখা যায় আরেকটি স্মারকে (নং- ১৬.০০.০০০০. ০০৩.৩০.০০২. ১৬-৩৩৪ নং ) তাদের ক্ষমা দেয়া হয়েছে। তাদের জমা দেয়া ভাউচারগুলোও বাতিল করা হয়নি। এতে যারা সরকারের আইন মেনে একত্রে ভাউচার জমা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর অনিয়মকারীরা ক্ষমা পেয়েছে।

এদিকে ২০/০২/২০১৭ তারিখে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা থাকবে বলা হয়েও আকস্মিক গোপনীয় নোটিশ জারি করে বলা হয় ব্যাংক ৭টা পর্যন্ত ভাউচার জমা নেবে। আর নোটিশটি সাইটে প্রকাশ করা হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। অধিকাংশ এজেন্সি তখন সার্ভার বন্ধ করে চলে যায়। অথচ ওইদিন ওই সময়ের মধ্যেই অনেক এজেন্সির হজ্বযাত্রীদের টাকা জমা নেয় ব্যাংকগুলো।

২২ ফেব্রুয়ারি তড়িগড়ি করে সকাল ১১টার মধ্যেই নির্ধারিত ব্যাংকে ভাউচারসহ টাকা জমা দেয় পিছিয়ে পড়া অনেক এজেন্সি। ব্যাংকও নিশ্চিত করে যে, তারা কোটার সিরিয়ালের মধ্যেই থাকবে। কিন্তু ভাউচার জমার ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা ব্যাংকে অপেক্ষার পর তারা জানতে পারে তাদের ভাউচার জমা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সিরিয়াল পড়েছে কোটার বাইরে একেবারে শেষের দিকে। অথচ এই ৫/৭ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার বাইরে মফস্বল ও বিভাগীয় শহর থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা থেকে অধিকাংশ ভাউচার জমা পড়েছে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি হাবের সভাপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম বাহার ‘২০১৭ সালের হজ্বে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাক-নিবন্ধনে চরম বিশৃঙ্খলার প্রেক্ষিতে সুষ্ঠু হজ্ব ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বিষয়টি নিরসনে হস্তক্ষেপ কামনা’ করে ধর্মমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘....বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাপ্ত কোটা হতে ৫০ হাজারের অধিক হজ্বযাত্রী নিবন্ধিত হয়েছে। যাদের পক্ষে ২০১৭ সালে (চলতি বছর) হজ্বে যাওয়া হবে না।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘অধিকাংশ এজেন্সি ডাটা এন্ট্রি করে পেমেন্ট ভাউচার প্রিন্ট করে সময়মতো ব্যাংকে জমা করলেও আইটি জটিলতার কারণে ৪-৫ ঘণ্টায়ও পেমেন্ট অনুমোদন পায়নি। অপরদিকে কিছু এজেন্সি ১০-২০ মিনিটের মধ্যে পেমেন্ট অনুমোদন পেয়ে গেছে। অর্থাৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও আইটির জটিলতার কারণে টাকা জমা দেয়ার পরও আইটি থেকে সিরিয়াল পায়নি। অনেকে আইটির সহজলভ্যতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক হজ্বযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন করতে সক্ষম হন। এহেন জটিল কার্যক্রমে হজ্ব এজেন্সিগুলোকে সময়ক্ষেপণ করতে হয়।....... জীবন সায়াহ্নে অনেক হজ্বযাত্রী হজ্বে যেতে সক্ষম হবেন না বিধায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন।’

এমতাবস্থায় সমস্যা সমাধানে ব্যাংকে টাকা জমাদানের সময় অনুযায়ী প্রাক-নিবন্ধন সিরিয়াল দেয়া ও সমতার ভিত্তিতে হজ্বযাত্রী বণ্টনের দাবি জানান হাব সভাপতি।

এ ব্যাপারে হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আইটির কারণেই এসব অনিয়ম হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রী মহোদয়কে এ বিষয়ে লিখত জানিয়েছি। আমরা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হওয়া প্রাক-নিবন্ধন বাতিল করে নতুন করে পুনরায় প্রাক-নিবন্ধন করার দাবি জানাচ্ছি।’

তবে বিজনেস অটোমেশন কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিজনেস অটোমেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল হাসান মিতুলকে ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে হজ্বযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধনের জন্য নিয়োজিত এই আইটি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার (প্রজেক্ট) মো. কবির আল মামুন জানিয়েছেন, প্রাক-নিবন্ধনের সময় সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গে বুয়েট এবং মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল টিম কাজ করেছেন। তা সবকিছু মনিটরিং করেছেন। এখানে অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি।

এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল জলিল গতকাল রোববার বিকেলে জানিয়েছেন, তিনি দেশের বাইরে ছিলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

এদিকে গতকাল রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রাক-নিবন্ধিত সকলকে হজ্বে¡ পাঠানোর দাবি জানিয়েছে হাব সমন্বয় পরিষদ।

হাব সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক হাবিবুর রহমান মিজান বলেন, ‘চলতি বছর ১ লাখ ২৬ হাজার ৮২৯ জনকে হজ্বে পাঠানোর ব্যাপারে সৌদি সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর ১ লাখ ৮১ হাজার ৮২৯ জন প্রাক-নিবন্ধন করেছেন। সৌদি সরকারের সঙ্গে চুক্তির চেয়ে ৫৫ হাজার অতিরিক্ত প্রাক-নিবন্ধন করেছেন। সরকার চাইলে প্রাক-নিবন্ধিত এ ৫৫ হাজার যাত্রীর কোটা বাড়ানো সম্ভব। প্রাক-নিবন্ধিত সবাই হজ্বে যেতে চান। তাই সকল হজ্বযাত্রীকে হজ্বে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন- এটাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০১৬ সালে লিড প্রথার কারণে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ বছর লিড প্রথা বাতিল করে স্ব স্ব এজেন্সিকে ৬ মাসের মাল্টিপল ভিসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অবিলম্বে সরকারি নিবন্ধন করে অব্যবহৃত কোটা বেসরকারি কোটায় স্থানান্তর করতে হবে। আইটি চার্জ ২০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৫০০ টাকা করতে হবে।’

এ সময় হাব সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব রেজাউল করিম উজ্জ্বল, হাবের সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

http://www.dailysangram.com/post/273485