২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১২:০০

এমপি লিটন হত্যা

জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত

কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আসলেই ধর্মের কল বাতাসে নড়ে উঠেছে। অন্তত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এমপি লিটন হত্যার ক্ষেত্রে এ কথাটি আর একবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে। লিটনকে খুন করা হয়েছে গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর। একজন এমপি’র হত্যাকাণ্ড যে সে ব্যাপার নয়। যে কোন মূল্যে সেই হত্যা রহস্যের উদঘাটন করতে হবে। এ জন্য পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ফুল এনার্জি দিতে হবে। কিন্তু তাই বলে মানুষ হত্যার মত এমন মারাত্মক বিষয় নিয়ে পলিটিক্স করা যাবে না। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে মানুষ হত্যা নিয়ে সেই ঘৃণ্য পলিটিক্সই বারবার করা হয়েছে। এমপি লিটন হত্যা নিয়েও সেই পুরানা পলিটিক্যাল গেম খেলার অপচেষ্টা করা হয়েছে। হত্যা কাণ্ডের পরদিন থেকেই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে। নতুন বছর শুরুই হয়েছে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সমস্ত দায় জামায়াতে ইসলামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে।

কিন্তু সত্যের ঢাক বেজে উঠেছে। এরশাদের জাতীয় পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) আব্দুল কাদের খান গ্রেফতার হওয়ার পর জামায়াতকে জড়িত করার সরকারী ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, কর্নেল কাদেরই এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা। গত ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারীর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বিশেষ করে দৈনিক “প্রথম আলোর” প্রথম পৃষ্ঠায় হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে কি বলবেন? কারণ এই হত্যাকাণ্ডের পর পরই তিনি যাবতীয় দায়-দায়িত্ব জামায়াতের ঘাড়ে চাপান। গত ৪ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “মন্জুরুল ইসলাম লিটনের ওপর জামায়াতের ক্ষোভ ছিল। তিনি সব সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। গাইবান্ধায় গোলাম আযমের সমাবেশ করতে বাধা দিয়েছিলেন। সেটাই কি তার হত্যার কারণ? স্বাধীনতার পক্ষশক্তির পক্ষে থাকার কারণেই তাকে জীবন দিতে হয়েছে। লিটনের ওপর বারবার হামলা হয়েছে। মাঝে একটা ঘটনা ঘটার পর তার কাছ থেকে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র নিয়ে নেয়া হয়। তার পর থেকে তিনি আতঙ্কে থাকতেন, সবসময় কখন তার ওপর হামলা হয়। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, তাকে হত্যা করা হলো।” এসব কথা তিনি একবার নয়, একাধিক বার বলেছেন।

এত গেল প্রধানমন্ত্রীর কথা। প্রধানমন্ত্রীর নিচে আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের যত স্তর রয়েছে তারা সকলেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। এমপি লিটন খুন হয়েছেন ৩১ ডিসেম্বর। পর দিন পহেলা ডিসেম্বর প্রাক্তন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, “জামায়াত-শিবির আবারো দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে তা-ব চালাচ্ছে। এমপি লিটন হত্যাকা-ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে জামায়াত-শিবির এখনো তৎপর। তাদের রুখে দিতে হবে।” একই দিন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক এমপি বলেছেন, ‘তাকে তারাই হত্যা করেছে যারা ধর্মের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে।’

কথায় বলে, রাজা যাহা বলে, পারিষদ দল বলে তার শত গুণ। যেহেতু কেন্দ্রীয় নেতারা বিশেষ সুরে গান ধরেছেন তাই মফস্বলের পাতি নেতারাও সেই সূরে তাল ধরেছেন। তাই দেখা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফাও একই দিনে সুন্দরগঞ্জের প্রতিবাদ সভায় বলেছেন, ‘জামায়াত-শিবিরের লোকজনই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তিনি সুন্দরগঞ্জ থানার ওসিকে জামায়াত-শিবিরের দোসর বলেও মন্তব্য করেন।’

॥দুই॥
আবার আওয়ামী নেতৃত্বের ওপর দিকে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগের দুই নম্বর ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৩ জানুয়ারী বলেছেন, ‘সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম বছরের প্রথম সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার।’ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ গত ৩ জানুয়ারী বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জামায়াত এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর এই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষক বিএনপি।’

গাইবান্ধা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসানুল করিম চাঁদ একই দিন বলেছেন, ‘জামায়াত-শিবিরের লোক পুলিশ হত্যা মামলায় জামিনে এসে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়িয়ে আবারো এমপি লিটনকে হত্যা করেছে। পুলিশ ব্যর্থ হলে আমরা আওয়ামী লীগের লোকজন এমপি’র খুনি জামায়াত-শিবিরদের চিহ্নিত করবো।’

উপজেলা ছাত্রলীগ আহ্বায়ক ছামিউল ইসলাম ছামুও একই দিন এক ডিগ্রী আগ বাড়িয়ে বলেছেন, ‘সংসদ সদস্য লিটনের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে যদি পুলিশ খুনি জামায়াত-শিবিরকে বের করতে না পারে, তাহলে আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। আমরা সেই খুনি জামায়াত-শিবিরদের বের করে দেবো।’

এতক্ষণ ধরে আমরা রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কথা বললাম। এবার দেখুন প্রশাসনের কথা। পুলিশ প্রশাসন রাজনৈতিক দলের কোন অঙ্গ দল নয়। তার পরেও পুলিশের সর্বোচ্চ অফিসার আইজিপি গত ৩১শে ডিসেম্বর বলেছেন, ‘এলাকার সাধারণ লোক ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, খুনের সাথে জামায়াত-শিবির জড়িত থাকতে পারে। সংসদ সদস্য লিটন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।’

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ২রা জানুয়ারী বলেছেন, ‘এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করেই মামলা করেছে পরিবার। ওই বিষয় নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।’

॥তিন॥
অথচ তদন্তের পর এসব অফিসারই সম্পূর্ণ উল্টা কথা বলেছেন। তারাই তদন্ত করে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি কর্নেল কাদেরকে গ্রেফতার করেছেন। আরও গ্রেফতার করেছেন তিন কিলারকে, যাদের সাথে জামায়াতের বিন্দুমাত্র সংশ্রব নাই। তাদের বক্তব্য আমরা একটু পর তুলে ধরব। তার আগে অন্যদের কথা।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বাংলাদেশে অতি পরিচিত একটি নাম। টেলিভিশনে টকশো-তে যে ক’টি নাম মনে আসে তার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় নাম হলো আসিফ নজরুল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। সেই আসিফ নজরুল এ সম্পর্কে ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “এমপি লিটন হত্যায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জামায়াতকে দায়ী করেছিলেন: আসিফ নজরুল। এমপি লিটন হত্যার জন্য স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী জামায়াতকে দায়ী করেছিলেন। তারপরও পুলিশ তদন্ত করে বের করছে যে এজন্য দায়ী জাপার একজন সাবেক এমপি। তার মানে কারো কথায় প্রভাবিত না হয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত চালানোর নির্দেশ ছিল এখানে। তারমানে স্বাধীনভাবে তদন্ত করলে যে কোন অপরাধীকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে আমাদের পুলিশের। আমার প্রশ্ন, এই পুলিশ তাহলে কেন পারে না সাগর-রুনি হত্যাকা-ের তদন্ত করতে? কেন পারে না সমাজকে স্তব্ধ করে দেয়া অন্যান্য গুম বা হত্যাকা-গুলো তদন্ত করতে? পুলিশ বা স্বগোত্রীয় কেউ নিজেই এসবের সংগে জড়িত বলে? অথবা জড়িত যেই হোক, স্বাধীনভাবে তা তদন্তের নির্দেশ নেই বলে?

আর একজন কলামিষ্ট হলেন মিনার রশিদ। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি লিটন নিহত হওয়ার পর পরই জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে দায়ী করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”

সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগের টপ টু বটম সকলের মনেই এই ধারণাটিই গেঁথে যায়। জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, এমপি লিটনকে হত্যা করেছে জঙ্গি ও জামায়াত। ডেপুটি স্পিকার জানান, জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতায় লিটন খুন, খুনের তদন্তের অগ্রগতি।

লিটনের স্ত্রীও একই ধরণের বিবৃতি দেয়। জামায়াত-শিবির চক্র তার স্বামীকে হত্যা করেছে বলে জানান লিটনের স্ত্রী।
কিন্তু লিটনের ভাইবোন এই ধরনের দোষারোপ থেকে বিরত থাকেন। তারা এই ধরনের দোষারূপ বন্ধ রেখে প্রকৃত খুনীকে বের করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করেন। মূলত লিটনের ভাইবোনের দৃঢ়তাতেই সরকার চাপে পড়ে যায়। প্রকৃত খুনীকে বের করার উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়।

এখন মনে হচ্ছে, অল্পের উপর দিয়েই গেছে। আরো মারাত্মক কিছু বের হয়ে যেতে পারতো। মানুষের আশংকা আরো ভয়ংকর ছিল।

মানুষের মনে এই ধরনের সন্দেহ সৃষ্টির জন্যে সরকার দায়ী। সরকার পুরো বিচার ব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে মানুষ আর এই সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকে ব্যবহার করে ঢাকায় বসে সিনেমার কাহিনীর মত কাহিনী সাজানো হয়। পরিস্থিতির মতিগতি বুঝে ঘটনা প্রচার করা হয়। সরকারের এই ভয়ংকর খেলা কোথা গিয়ে শেষ হবে, তা একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন।

এখন যদি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাক্তন এমপি কাদের খানই মূল হত্যাকারী হন, তবে প্রধানমন্ত্রী কেন কোনরূপ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে জামায়াত শিবিরকে দোষারূপ করেছিলেন ? এই জাতির বিবেক বলে কি আদৌ কিছু আছে যেখানে আজ এই প্রশ্নটি রাখা যাবে?

আসলে আমরাই আমাদের এই দেশটিকে ভয়ংকর এক জনপদ বানিয়ে ফেলছি। যে কেউ যে কোনও সময় এর করুণ শিকার হয়ে পড়তে পারে। আমাদের মধ্যে কেউ হবে লিটন, কেউ হবে নন্দঘোষ, কেউ হবে স্কেপ গোট আর কেউ হবে কাদের খান। বিএনপি জামায়াতকে নন্দঘোষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হলে গৃহপালিত বিরোধী দল থেকে কাউকে বলির পাঠা বানানো হবে।

এই ছিল মিনার রশিদের মন্তব্য। এবার পুলিশের আইজি’র সর্বশেষ মন্তব্য দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন কাগজে যে রিপোর্ট বেরিয়েছে, সেই সব রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকান্ডের পর টেলিফোনে আড়ি পেতে আরও একজনকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন পুলিশ সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। সেই সূত্র ধরে শুরু হয় অনুসন্ধান। আর এতেই আওয়ামী লীগের এমপি মনজুরুল হত্যায় জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি আবদুল কাদের খানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। পুলিশ সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক গত ২২ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, এমপি মনজুরুল হত্যার পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খান। তাঁর ইচ্ছা ছিল মনজুরুলকে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করে পরবর্তী সময়ে এমপি হবেন। তিনি আরও বলেন, গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি মনজুরুল হত্যা মামলায় গত মঙ্গলবার কাদের খানকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল বুধবার গাইবান্ধার আদালতে তাকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। কাদের খান ওই আসনের সাবেক এমপি।

মনজুরুল হত্যা মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, আবদুল কাদের খান ছয় সাত মাস আগেও একবার মনজুরুল হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর তিন যুবক তাঁর বাড়ি থেকেই মনজুরুলকে খুন করতে যান। খুনের পর তাঁরা আবার সেখানেই ফিরে আসেন। হত্যায় ব্যবহার করা অস্ত্রটিও তাঁরই ছিল বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।

এর পর আর কোনো কথা থাকে না। জামায়াত ও শিবিরের বিরুদ্ধে সরকারের তরফ থেকে মিথ্যার যথেষ্ট বেসাতি হয়েছে। এবার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে যে সব জামায়াত ও শিবির নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কে মুক্তি দিন। আর সাংবাদিক নামধারী চন্দন সরকার নামের যে আওয়ামী লীগ নেতাটি ভারতে পালিয়ে গেছে তাকে ধরে আনুন এবং কঠিন শাস্তি দিন।

http://www.dailysangram.com/post/273370