৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৯:৫৫

কোনো অজুহাতেই বিচার এড়াতে পারবে না মিয়ানমার

মিয়ানমার মানুক আর না-ই মানুক, তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) বিচারিক এখতিয়ার নিয়ে আর প্রশ্ন নেই। এখন রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের তদন্ত শুরু হওয়ার পালা। আর দেরি না করে দ্রুত তদন্ত শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদেষ্টা আদামা দিয়েং। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি আইসিসির প্রসিকিউটর (কৌঁসুলি) ফেতু বেনসুদাকে আইসিসি চেম্বার আদালতের সুপারিশ অনুযায়ী তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নিতে আহ্বান জানান।
বিবৃতির শেষাংশে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘প্রি-ট্রায়াল চেম্বারের সিদ্ধান্ত অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ। মিয়ানমার এ বিষয়ে নিরপেক্ষ কোনো তদন্তে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে এবং সার্বভৌম সীমানার ভেতরে লুকানোর বিষয়ে জোর দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। দেশগুলোর এখন বোঝার সময় এসেছে যে মানুষের ওপর সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিচার এড়ানোর জন্য সীমান্তগুলো আর তত শক্তিশালী নয়।’

আইসিসির ব্যাখ্যা ও জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদেষ্টার বিবৃতি থেকে ধারণা পাওয়া যায়, রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত যেসব অপরাধ তাদের বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে, সেগুলোরই বিচারিক এখতিয়ার আছে আইসিসির। মিয়ানমারের ভেতর যেসব অপরাধ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর বিচার কিভাবে হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে পুরোপুরি সংঘটিত অপরাধগুলো ‘জেনোসাইডের’ (গণহত্যা) আলামত হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। আর সেটি আইসিসির বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে। এ কারণে তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আইসিসি গত বৃহস্পতিবার রাতে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের বিচারিক এখতিয়ার আছে বলে রায় দেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরকে অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই রায় সম্পর্কিত সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে আইসিসি গত শুক্রবার রায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন।
আইসিসির কৌঁসুলি আদালতের কাছে কী অনুরোধ জানিয়েছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাব হিসেবে আইসিসি বলেছেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বিতাড়িত বা বহিষ্কার করার ব্যাপারে আইসিসির বিচারিক এখতিয়ার আছে কি না সে বিষয়ে কৌঁসুলি প্রি-ট্রায়াল চেম্বারকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।

‘বহিষ্কারের অপরাধ’ বলতে কী বোঝায়—এমন প্রশ্নের জবাবে আইসিসি বলেছেন, লোকজন আইনগতভাবে অবস্থান করছে, এমন স্থান থেকে বলপূর্বক অন্যত্র স্থানান্তর বহিষ্কারের অপরাধের অপরিহার্য একটি উপাদান। আর ওই লোকজনকে যখন রাষ্ট্রের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়, তখন তা অন্য একটি অপরাধ হয়। সেটি হলো লোকজনকে জোরপূর্বক স্থানান্তর।
প্রি-ট্রায়াল চেম্বার কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আইসিসি বলেছেন, চেম্বার আদালত কৌঁসুলির অনুরোধ মঞ্জুর করেছেন এবং আদালতের এখতিয়ারসংক্রান্ত একটি আদেশ দিয়েছেন, যা আইনগতভাবে মানতে বাধ্য। চেম্বার আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বহিষ্কারের অভিযোগে আইসিসি তাঁর বিচারিক এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারেন। কারণ বহিষ্কারের অপরাধের অন্তত একটি উপাদান বা ধাপ বাংলাদেশের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়েছে।

মিয়ানমার আইসিসির রোম সংবিধির পক্ষ না হওয়ায় আইসিসির বিচারিক এখতিয়ারে কতটা প্রভাব ফেলবে—এ প্রশ্নের জবাবে আইসিসি বলেছেন, আইসিসি তখনই বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন যখন তাঁর এখতিয়ারাধীন কোনো অপরাধের অন্তত একটি উপাদান তাঁর আওতাধীন এলাকায় বা সেই অপরাধের কোনো অংশ সদস্য কোনো রাষ্ট্রে সংঘটিত হয়।
আইসিসি আরো বলেছেন, “এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য। আর বহিষ্কারের অপরাধে আমরা বিচারিক এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারি। কারণ ওই অপরাধের একটি উপাদান সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া আরো অপরাধের উপাদান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়েছে। এগুলো ‘ক্রাইম অব পারসিকিউশন’ (নিপীড়নের অপরাধ) বা ‘ক্রাইম অব আদার ইনহিউম্যান ট্রিটমেন্ট’ (অমানবিক আচরণের অন্যান্য অপরাধ) সংক্রান্ত অভিযোগ হতে পারে।”
আদালতের এই সিদ্ধান্তের অর্থ প্রসিকিউটর নিজে থেকেই তদন্তের উদ্যোগ নেবেন ও তদন্ত করবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে আইসিসি বলেছেন, ‘না। এই সিদ্ধান্তের অর্থ এই নয় যে কৌঁসুলি নিজে থেকেই তদন্ত শুরু করবেন। সিদ্ধান্তটির অর্থ হলো কৌঁসুলিকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত করতে হবে। আর এর মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে পূর্ণ তদন্তের যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে কি নেই।’
আইসিসি জানান, প্রাথমিক তদন্ত শেষে কৌঁসুলি যদি মনে করেন পূর্ণ তদন্তের যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে তাহলে এ বিষয়ে অনুমতির জন্য তাঁকে প্রি-ট্রায়াল চেম্বারে অনুরোধ জানাতে হবে। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রি-ট্রায়াল চেম্বার সিদ্ধান্ত নেবেন পূর্ণ তদন্ত শুরু করা উচিত হবে কি হবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, এটিই আইসিসির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জোরালো অভিযোগ জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে উঠেছে। আইসিসির কৌঁসুলির প্রাথমিক তদন্তেও এমনটি উঠে আসবে বলে ধারণা করা হয়।

গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদেষ্টা আদামা দিয়েং কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার পর গত ১৩ মার্চ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার জোরালো আলামত থাকার ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটি স্পষ্ট যে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো আদালতই দিতে পারেন।
আইসিসির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আদামা দিয়েং গতকাল নিউ ইয়র্কে বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এক বছর ধরে যে অন্ধকার অধ্যায় পার করছে তাতে এই সিদ্ধান্ত আলো হয়ে এসেছে। বিশেষ করে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা গণবাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। ভয়ংকর এসব অপরাধ কোনোভাবেই শাস্তি এড়াতে পারে না। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা গণহারে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের আগুনে ছুড়ে ফেলা এবং গ্রামের পর গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলার মতো অত্যন্ত মর্মান্তিক সব খবর জেনেছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে অসংখ্য আহ্বান সত্ত্বেও আইসিসিকে তদন্তের আহ্বান জানাতে নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতাকে কম করে হলেও হতাশাজনক বলতে হয়।’

নিরাপত্তা পরিষদের এমন ব্যর্থতার মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে আইসিসির সিদ্ধান্তকে বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উপদেষ্টা।
এদিকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক গত শুক্রবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না—এমনটি তিনি বলবেন না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের রূপরেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রথমে রাখাইনে আস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘের সব সংস্থাকে সেখানে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে হবে। সব শেষে, কোনো ধরনের চাপমুক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সঙ্গে রাখাইনে ফিরে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গারাই সিদ্ধান্ত নেবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/09/09/678013