৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১১:৪৩

ডেঙ্গুতে ১১ জনের মৃত্যু

দুই সিটির মশা নিধনে নেই কার্যকর পদক্ষেপ

রাজধানীতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজার ৩৭৪ জন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। এ সময়ে জ্বরের প্রকোপ বাড়াটা অনুমিত। তবে চিকিৎসকরা বাড়তি যে দিকটা নজরে এনেছেন তা হলো, অন্য বছরের চাইতে এই বছরের ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো আলাদা। তাই একে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রায় সবগুলোই রাজধানী ও তার আশেপাশের ঘটনা। সচেতনতার অভাবেই এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আর এভাবে বাড়তে থাকলে মৃতের সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়াবে বলে জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে। বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ২৩২ জন আক্রান্ত ও ২০০০ সালে সর্বোচ্চ ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২০১৬ সালে হঠাৎ করে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৬০ জনে উঠে যায়। ওই বছর ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৭৬৯ জন ও মৃতের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৮ জনে নেমে আসে।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মতে, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট আকারে হলেও পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আর তাতেই এডিস মশার প্রজনন বাড়ে। ডেঙ্গু নিরাময়যোগ্য রোগ, তবে নারী ও শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকার কারণে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে তাদের সংখ্যাই বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের অধিকাংশই রাজধানীতে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬৩২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৩২ জন। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু।
পানিবদ্ধতা, খোলা ড্রেন আর যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপের কারণে রাজধানী হয়ে উঠেছে মশা প্রজননের অভয়ারণ্য। এতেই বাড়ছে মশাবাহিত চিকনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগসহ মশাবাহীত নানা রোগ ব্যাধী। অথচ মশা নিধনে বছর বছর বরাদ্দ বাড়াচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। গতবছর ঢাকাবাসীকে চিকুনগুনিয়া রোগ নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। আর এ বছর শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বাসিন্দারা মশার অত্যাচার বেশি পোহাতে হচ্ছে। সেখানে রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি, অফিস, পার্ক কিংবা খেলার মাঠ সব জায়গায় মশার উপদ্রব। মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না বস্তি থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকাগুলোও। বাদ যাচ্ছে না বিমানবন্দরও। মশার কারণে চলতি বছরের শুরুর দিকে বিমানের একটি ফ্লাইট দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছিল।
বছর বছর বরাদ্দ বাড়লেও মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলছে না নগরবাসীর। উপরন্তু বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে পালা দিয়ে বাড়ছে মশার উপদ্রব। তারা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর মশা প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল থেকে শুরু করে চলন্ত গাড়িতেও কামড়াচ্ছে মশা। দিনের বেলায় উপদ্রব কিছুটা কম থাকলেও রাতের বেলায় অসহনীয় হয়ে ওঠে। মশারি, কয়েল কিংবা ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মশানাশক স্প্রে করেও মিলছে না প্রতিকার। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার জীবনচক্র নিয়ে না বোঝার কারণে যে কোনো পদক্ষেপই কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ফলে রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির হাসান বলেন, মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন এককভাবে কাজ করলে হবে না, পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। আমরা মশার ওষুধ ছিটাচ্ছি। একই সাথে জনসচেতনতামূলক যেসব কর্মকান্ড আছে, সেগুলোও চালাচ্ছি। মসজিদের ইমামের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে জনসচেতনতামূলক প্রোগাম করছি। কিন্তু মানুষের সচেতনতা যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়ছে না।
আইইডিসিআর’র সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুসারে ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাওয়ার কথা না। প্রথমত মানুষ এখনও জানে না ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি? তারা নিজেরাই ওষুধ খেয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরে হাসপাতালে আসেন। প্রায় সব রোগীই বাসা থেকে এ রোগটা বাধিয়ে নিয়ে আসেন। তারা বাসা ও তার আশেপাশের এলাকাকে পরিষ্কার বা মশামুক্ত রাখার চেষ্টা করেন না। অর্থাৎ এই পুরো সমস্যা দূরীকরণে একমাত্র জনসচেতনতাই মুখ্য।
এডিস মশা সাধারণত বাসাবাড়িতে ফুলের টব, টায়ার, ফ্রিজ, এসিতে জমে থাকা পানিতে জন্মায়। এ রোগ থেকে দূরে থাকতে বাড়ির আশপাশে কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না ও নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। কেননা মশার ওষুধও ইদানিং মশাদের জন্য রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শেখ সালাউদ্দীন বলেন, আমরা আমাদের শতভাগ চেষ্টা চালিয়েছি এবং অব্যাহত রয়েছে। আমরা পক্ষকালব্যাপী বিশেষ কর্মসূচিতে ৩৩ হাজার ৫০৮টি বাড়িতে পরিদর্শন করি। এরমধ্যে কিছু বাড়িতে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা হয়েছে। তারপরেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/152060