চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতীরের সরকারি এই ভূমিতে (গোল চিহ্নিত) দুই শতাধিক মৎস্য আড়ত তৈরি করে চলছে কোটি টাকার বেচাকেনা - মো. রাশেদ
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:৫২

কর্ণফুলী তীর \'ইজারা\' নিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য

হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে কর্ণফুলী নদীতীরে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে কোটি টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। এর জন্য সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত চার একর জায়গা প্রথমে কয়েক হাত ঘুরে বিক্রি করা হয়। অথচ কর্ণফুলী নদীতীরের এ জায়গার প্রকৃত মালিক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। বেচাকেনা প্রক্রিয়ায় এই জায়গা প্রথমে দখল করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তারা বছরে ২৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা দাম ধরে ১৫ বছরের জন্য জায়গাটি ইজারা দেয় বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের কাছে। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি তা বিক্রি করে সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য সমবায় সমিতি লিমিটেডের কাছে। তারা সেখানে তৈরি করে শতাধিক মৎস্য আড়ত। এরপর এই সমিতি প্রতিটি আড়ত ৫ থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি করে শতাধিক ব্যক্তির কাছে। এই প্রক্রিয়ায় হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রকাশ্যেই কর্ণফুলী নদীতীরে কোটি টাকার এই অবৈধ বাণিজ্য চলছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের শতাধিক আড়তের (গদি) একটির মালিক মো. হানিফ। তার মালিকানায় রয়েছে ১২ ফুট বাই ১৪ ফুট আয়তনের ৪৩নং আড়তটি। ৭৭নং আড়তের মালিক কাউসারুজ্জামান, ৪২নং

আড়তের মালিক বেলাল গাজী ও ৪৪নং আড়তের মালিক খলিল। ক্রেতা সেজে টেলিফোনে হানিফের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য সমবায় সমিতির কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে আড়ত কিনেছেন তিনি। এর জন্য কোনো ডকুমেন্ট ছাড়াই পরিশোধ করেছেন ২০ লাখ টাকা। অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করলে আড়তের মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে তাকে জানানো হয়েছে। একই কথা জানালেন ৭৭নং আড়তের মালিক কাউসারুজ্জামান, ৪২নং আড়তের মালিক বেলাল গাজী ও ৪৪নং আড়তের মালিক খলিল।

টেলিফোনে তারা আরও জানান, বিভিন্নজনের কাছে আড়ত বিক্রি করছেন সমিতির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক ওরফে বাবুল সরকার। সোনালি যান্ত্রিক সমিতির যারা পুরনো সদস্য তাদের কাছ থেকে আড়ত বরাদ্দ দেওয়া বাবদ নেওয়া হয় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। যারা সমিতির সদস্য নন, আড়ত কিনতে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এই টাকা লেনদেনে কোনো ডকুমেন্ট নেই।

এই অভিযোগ অস্বীকার করে সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি হাজি মো. আলী বলেন, আমরা সমিতির সদস্য আছি ১১০ জন। তাদের কাছে আড়তঘর ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকায় কারও কাছে বিক্রি করা হচ্ছে না। আড়তঘর নির্মাণের খরচ বাবদ কিছু টাকা অগ্রিম নেওয়া হচ্ছে। কোনো কারণে এটি উচ্ছেদ করা হলে তাদের টাকা সমন্বয় করে ফেরত দেওয়া হবে।

নির্মাণ করা এসব স্থাপনা বৈধ কি-না জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জায়গাটি ১৫ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে কিছু মাছের আড়ত তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছি। এ জায়গার বড় অংশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অধীনে রয়েছে।'

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পাঁচটি একতলা ভবন ও একটি দোতলা ভবন তৈরি করা হয়েছে। 'ইউ' আকৃতির একতলা ভবনের দোকানগুলো হবে মাছের আড়ত। দোতলা ভবনটি শৌচাগার ও পোশাক পরিবর্তনের কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আড়তের আরেক পাশে থাকা অর্ধশত স্থাপনা ব্যবহার করা হবে দোকান হিসেবে। বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড প্রতিটি দোকান বিক্রি করছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায়। নদীতীরের চাকতাই ও রাজাখালী খালের মোহনার জায়গা নিয়ে এভাবেই চলছে কোটি টাকার বাণিজ্য। বর্তমানে এ আড়ত উদ্বোধনের তোড়জোড় চলছে।

জায়গাটির মালিক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন হওয়ায় গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে একটি প্রতিবেদন দেন সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আছিয়া খাতুন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মধ্যবর্তী স্থানের যে জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে, তা ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত নদী শ্রেণির জমি। খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গা কী বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারা বা ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেছে, তা বোধগম্য নয়।' এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কর্ণফুলী নদীর পাশের জমিতে স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ইজারা প্রদানের বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকেও চিঠি দেন।

কর্ণফুলী নদী দখলমুক্ত করা নিয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, 'আমাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট, জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে তিন মাসের মধ্যে অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সময়সীমা বেঁধে দেয়। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করে খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষই ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ভরাট করা জায়গা ১৫ বছরের জন্য লিজ দিয়েছে। আবার জেলা প্রশাসন সতর্কতামূলক চিঠি দিয়ে চুপচাপ বসে আছে।'

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন বলেন, 'বন্দর কর্তৃপক্ষ যে স্থানটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের জন্য লিজ দিয়েছে সেটি জেলা প্রশাসনের ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গা। আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে এ ব্যাপারে মতামত চাওয়ার পর তারা একটি জবাব দিয়েছে। সেই জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আমরা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছি। সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেবে জেলা প্রশাসন।'

এ প্রসঙ্গে বন্দরের বোর্ড সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম বলেন, 'সাধারণত কর্ণফুলী নদীর হাই ওয়াটার মার্ক ১৫০ ফুট পর্যন্ত বন্দরের এখতিয়ার অধীন। তাছাড়া নদীকেন্দ্রিক যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করে, তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাও বন্দরের কাজ। এ চিন্তা থেকে তাদের জায়গাটি লিজ দেওয়া হয়েছে।'
- See more at: http://bangla.samakal.net/2017/02/18/271022#sthash.CK1PPXpu.dpuf