৩০ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২১

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচার বিভাগকেই রক্ষা করতে হয়

আজ আমরা গণতন্ত্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে যে সংকট মোকাবেলা করছি, সেই চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ভূমিকা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। শাসনতন্ত্রের সুরক্ষায় বিচার বিভাগের কতটা সাহসী ভূমিকা পালন করতে হয় তার দৃষ্টান্ত তারা রেখেছেন।
সরকার নামক সংস্থাটিই কেবল শাসনতন্ত্রের বৈধতা নিয়ে ক্ষমতা ব্যবহার করার অধিকার রাখে না। বিচার বিভাগও শাসনতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্বাধীন সংস্থা এবং সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা শাসনতন্ত্র রক্ষা করার, এর চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখার এবং এর ওপর কোনো আঘাত এলে তাকে প্রতিহত করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ।

এটা সত্য যে, ট্রাম্প একজন সাধারণ প্রেসিডেন্ট নন, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্রের তিনি প্রেসিডেন্ট। তা সত্ত্বেও অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন এবং বিচার বিভাগের অন্য ব্যক্তিরাও হেলাফেলা করার মতো কেউ নন। অথবা এমনও নয় যে, শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ তাদের ওপর যে আস্থা অর্পণ করেছে, তা বিস্মৃত হয়ে নিজেদের চাকরি বাঁচানোর জন্য তারা প্রেসিডেন্টকে খুশি রাখতে মোসাহেবিতে মত্ত থাকবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কিছু সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণের জবাব দিতে গিয়ে একেবারে সোজাসাপ্টা ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, তিনি বিচার বিভাগের দায়িত্বে আছেন এবং কোনোরকম রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে দেয়া হবে না। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে যদি আমাদের দেশের চিত্রটা মেলাতে যাই, তাহলে দেখতে পাই আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিচার বিভাগ সহজেই অসহায় হয়ে পড়েন। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনো বা চাপের মুখে অথবা ভয়ে। কিন্তু আমেরিকায় অ্যাটর্নি জেনারেল কিংবা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ডিরেক্টর কখনও প্রেসিডেন্ট তাদের চাকরিচ্যুত করতে পারেন এ ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকেন না। তারা সেখানে দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার মর্যাদাবোধ সমুন্নত রাখার দায়িত্ব পালনে সাহস দেখিয়ে থাকেন। তাদের এ সাহসী ভূমিকা শাসনতন্ত্র প্রদত্ত। শাসনতন্ত্র বিচার বিভাগকে এ দায়িত্ব দিয়েছে যাতে যার যার অবস্থান থেকে সবাই শাসনতন্ত্রের বিধান মেনে সরকার চালাতে বাধ্য থাকে।

বস্তুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের শাসনতন্ত্রকে সমুন্নত রাখা। কারণ শাসনতন্ত্রই হচ্ছে তাদের সবার ক্ষমতার উৎস। বিচার বিভাগের বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে শাসনতন্ত্র রক্ষায় তার নিজস্ব স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। শাসনতন্ত্র রক্ষার ন্যস্ত দায়িত্ব পালন তখনই বিচার বিভাগের পক্ষে সম্ভব হয়, যখন স্বাধীন বিচার বিভাগের শক্তি ও সাহস সরকারকে শাসনতন্ত্র মেনে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত থাকতে বাধ্য করতে পারে।
সরকারকে শাসনতান্ত্রিক সীমা লঙ্ঘন করতে না দেয়ার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। সরকারের কোন কাজটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা শাসনতন্ত্রই বিচার বিভাগের ওপর অর্পণ করেছে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের চাকরির স্থায়িত্ব এ জন্যই সরকারের ওপর নির্ভর করে না। সরকারের ভয়ে শাসনতন্ত্রসম্মত সুশাসন প্রতিষ্ঠার সেই দায়িত্ব যদি বিচার বিভাগ পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণের আস্থার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিণাম বিচার বিভাগকেই বহন করতে হবে।
ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আত্মস্থ করে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকে পড়তে চাইবে, তা জেনেই জনগণ স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর শাসনতন্ত্র রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেল বা এফবিআইয়ের ডিরেক্টর চাকরি হারানোর ভয়ে নিজেদের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনে বিরত থাকছেন না। শাসনতন্ত্র রক্ষায় স্বাধীন ভূমিকা পালন করার মধ্যেই রয়েছে বিচার বিভাগের শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতার যৌক্তিকতা। শাসনতন্ত্র রক্ষা পেলেই তো দেশ স্বৈরশাসন থেকে রক্ষা পাবে।

আমাদের দেশে অ্যাটর্নি এবং সরকারি আইনজীবীরা বিশ্বাস করতে পারেন না যে তারা সরকারি চাকরিজীবী নন, তারা দেশ ও জনগণের সুবিচার নিশ্চিত করার শাসনতান্ত্রিক কর্মকর্তা।
দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের অধীনে থাকার কারণে আমাদের বিচার প্রক্রিয়া ও বিচার বিভাগ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনে দারুণভাবে সাহসিকতার অভাবে ভুগছে। নিজেদের চাকরি ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা যেন সরকারের অনুগ্রহের ব্যাপার। তাই চাকরি তাদের টিকিয়ে রাখতেই হবে। বিচার প্রক্রিয়া এবং বিচার বিভাগ শাসনতন্ত্রসম্মত শাসন ব্যবস্থার স্বাধীন ভূমিকা রাখার সাহসী ভূমিকার অভাবের জন্যই প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বেপরোয়াভাবে অনিয়ম, অবিচার ও দুর্নীতি চলতে পারছে।
আইনের শাসনের কথা মুখে বলাই যথেষ্ট নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব শাসনতন্ত্রই বিচার বিভাগকে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ওয়াটার গেট মামলার প্রধান আইনজীবী আর্চি বলডকে চাকরিচ্যুত করতে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল তাতে সম্মত না হয়ে নিজে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে ইস্তফা দেন। বস্তুত, সাহসী বিচার বিভাগের অভাবই স্বৈরশাসনের পথ সুগম করছে স্বাধীন বাংলাদেশে।

বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী বিজয়কে কেন্দ্র করে সংঘটিত অনিয়ম তদন্ত করার জন্য বিচার বিভাগকে দোষারোপ করেছেন। ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন চেয়ারম্যান পল ম্যানাফোর্ট ও ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেন দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থা সঙ্গিন। কোহেন ট্রাম্পের নির্দেশে অবৈধ অর্থ লেনদেনের কথা স্বীকার করে ট্রাম্পকে বিপদে ফেলেছেন। আর ম্যানাফোর্ট ট্র্যাক্স ও ব্যাংক জালিয়াতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ যোগসাজশের বিষয়ে এটাই প্রথম মামলা যেটা ট্রায়ালে পাঠানো হয় এবং স্পেশাল প্রসিকিউটর সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে পল ম্যানাফোর্টকে দণ্ডিত করেন।
ট্রাম্প যাই বলুন, আর যাই দাবি করুন না কেন, পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। তাকে ইম্পিচ করা হলে মার্কিন অর্থনীতিতে ধস নামবে, প্রচুর লোক চাকরি হারাবে এসব কথা বলে তিনি আইনের হাত থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনে শিগগির তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দাখিল করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন স্বাধীনভাবে এবং শক্ত হাতে যেভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবৈধ কর্মকাণ্ডগুলোর তদন্ত করে যাচ্ছেন, তাতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্টের অভিযোগ উত্থাপন করা অসম্ভব নয়। বিচার বিভাগ তার ওপর কড়া নজর রাখছে। বিচার প্রক্রিয়ার কাছে তার অসহায়ত্ব বেড়েই চলছে। তাই তিনি এখন এই ভয় দেখাচ্ছেন যে, তাকে সরালে মার্কিন অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। ঘটনা পরম্পরায় এটাই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যতই বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হোন না কেন, স্বাধীন বিচার বিভাগ তাকে আইন ও শাসনতন্ত্রের ঊর্ধ্বে যেতে দেবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাগলামির রাশ টেনে ধরতে না পারলে আমেরিকার গর্ব ও গৌরবের মহত্তম মূল্যবোধসমূহকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে আমেরিকার দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের সেই সুমহান দৃষ্টান্ত আর বজায় থাকবে না। ট্রাম্পের রাজনীতি এতটা বিভেদমূলক, এতটা বর্ণবাদী যে আগামীতে আমেরিকানরাই আমেরিকানদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। ‘আমেরিকা প্রথম’- তার এ নীতি আমেরিকাকে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং আর পাঁচটি দেশের মতো আমেরিকাকেও একটি সাধারণ দেশের পর্যায়ে অবনমিত করেছে।

শেষ পর্যন্ত আমেরিকার বিচার বিভাগের স্বাধীন বিচার প্রক্রিয়া আমেরিকার শাসনতন্ত্রকে সমুন্নত রেখেই ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত রাখবে। দেশ থাকবে, শাসনতন্ত্র থাকবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে, বিদায় নিতে হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রই দুঃশাসনের প্রতিষেধক।
শাসনতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে চাকরি রক্ষার প্রশ্নটিকে বড় করে দেখা যায় না। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই বলা হয় এবং বলা হচ্ছে। কিন্তু যেটা অপ্রিয় সত্য তা হল, যেভাবেই হোক সরকার বিচার বিভাগের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই সমগ্র জাতিকে অসহায় করে রেখেছে। স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচনের পথে শাসনতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। বিচার বিভাগ শাসনতান্ত্রিক নিয়মে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্বল থাকলে জাতি শক্তি পাবে কোথা থেকে? শাসনতন্ত্রসম্মত সরকার চালানোর মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। কিন্তু আমাদের যোগ্য বিচারপতি নেই, যোগ্য আইনজীবী নেই এমন তো নয়। রাজনৈতিক এই শূন্যতার মধ্যেও যারা রাজনীতিতে আছেন, তাদের মধ্যে যারা সমঝোতার ভাষায় কথা বলতে পারেন না, তারা তো নিজেদের রাজনীতিবিদ দাবি করতে পারেন না।
ট্রাম্প শাসনের বিচার বিভাগের বিচার প্রক্রিয়ার দৃষ্টান্ত দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে, শাসনতন্ত্র রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখার দায়িত্ব শাসনতন্ত্রই বিচার বিভাগের ওপর অর্পণ করেছে। বিচারপতিগণ জেনেশুনেই সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ জন্য দায়িত্ব পালনের সচেতনতা বিচার বিভাগকেই দেখাতে হবে। জনগণও তাদের ওপর তাই বেশি দাবি রাখে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সবিধান বিশেষজ্ঞ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/84858