২৭ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ১০:১৯

দুই দেশের সংঘবদ্ধ চক্রের ফলে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ বাতিল

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গড়া একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ বাতিল হলো। বাংলাদেশের ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারকের (রিক্রুটিং এজেন্সি) একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের ফলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কোনো কর্মী আর মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না।

প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে ১৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটির বৈঠকে কর্মী নিয়োগের বিশেষায়িত পদ্ধতি এসপিপিএ (যা জিটুজি প্লাস নামে পরিচিত) থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে মালয়েশিয়া ২১ আগস্ট একটি চিঠি দিয়েছে।

কুয়ালালামপুরে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বলছেন, ১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ হবে না। অনলাইন নিবন্ধন ছাড়া সরাসরি বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ করার কথা ভাবছে মালয়েশিয়া। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন কোনো প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার আগে মালয়েশিয়া এভাবে কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এটি জানিয়েছে মালয়েশিয়া।
দায়ী ১০ এজেন্সির অনৈতিক ব্যবসা
মূলত মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার কারণেই শ্রমবাজারে এই সংকট তৈরি হলো। মালয়েশিয়ায় ওই চক্রের প্রধান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশীয় নাগরিক মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুন নূর। তিনি সেখানকার রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলাসহ প্রভাবশালীদের নিয়ে সিনারফ্ল্যাক্স নামে একটি কোম্পানি তৈরি করেন। সিনারফ্ল্যাক্স বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়ার দায়িত্ব পাওয়ার পর শুধু এখানকার নির্দিষ্ট ১০ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করত।
অভিযুক্ত ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের আদৌ কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছু জানা যায়নি।
বাংলাদেশের ওই ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিক ইস্টার্ন, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ।

ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সমিতি বায়রার সাবেক সভাপতি ও ইউনিক গ্রুপের মালিক মো. নূর আলী। প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটসের মালিক আরিফ আলম। তিনি একজন মন্ত্রীর আত্মীয় বলে জানা গেছে। ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক বায়রার সাবেক মহাসচিব মো. রুহুল আমিন। রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের মালিক বায়রার সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ বশির। প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের মালিক বায়রার সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন ছাত্রলীগের একজন সাবেক সভাপতি এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের প্রথম সারির একজন নেতা। সানজারি ইন্টারন্যাশনালের মালিক শেখ আবদুল্লাহ। তাঁর সঙ্গে যুক্ত আছেন একজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এক প্রটোকল কর্মকর্তা। ক্যারিয়ার ওভারসিজের মালিক রুহুল আমিন ও বদরুল আমিনরা তিন ভাই। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছেন সরকারের একজন মন্ত্রী এবং একটি অনলাইনভিত্তিক পত্রিকার সম্পাদক। আল ইসলাম ওভারসিজের মালিক জয়নাল আবেদীন জাফর। তিনি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের পরিচালক। আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের পরিচালক তুহিন সিদ্দিকী। আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক মো. রুহুল আমিন।

টিআইবির উদ্বেগ
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মালয়েশিয়ায় আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মী নিয়োগ বন্ধের ঘোষণায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তবে এটিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এই খাতকে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত অভিবাসী কর্মী নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ সিন্ডিকেটমুক্ত করার উদ্যোগ বাংলাদেশকেই নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, যে সিন্ডিকেটের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার কর্ণধাররা এবং তাঁদের কার্যক্রম ও প্রভাব সম্পর্কে সরকারের অবগত না থাকার কথা নয়। অথচ দীর্ঘদিন তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পেরেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে এখন সুযোগ এসেছে অভিবাসন খাতকে সিন্ডিকেট ও যোগসাজশের দুর্নীতির গ্রাস থেকে মুক্ত করার। তাই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা প্রমাণের এখনই সুযোগ বলে মনে করে টিআইবি।
সরকার কী করছে
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গতকাল বলছেন, মালয়েশিয়ায় নির্বিঘ্নে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগ অব্যাহত রাখতে দেশটির সঙ্গে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কুয়ালালামপুরের কূটনৈতিক সূত্রগুলো রোববার দুপুরে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের কর্মীদের নিয়োগ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা আছে মালয়েশিয়ার। এ পরিকল্পনার কথাটি মালয়েশিয়া অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানিয়েছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সেপ্টেম্বরে কুয়ালালামপুরে বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে এই প্রতিবেদক রোববার দুপুরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদারের সঙ্গে দেখা করেন। নমিতা হালদার বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ হয়নি। বিদ্যমান প্রক্রিয়া বাতিল হলেও বাজার চালু আছে। দেশটিতে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন হতে পারে। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো আরও গতিশীল করতে নিয়োগ অব্যাহত রাখতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1555088