১৪ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০৫

শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

ছাত্র আন্দোলনের মুখে তড়িগড়ি করে পুলিশ ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করলেও রাজধানীসহ সারাদেশে সড়ক ও মহাসড়কের চিত্র পাল্টায়নি। সড়কে আগের মতোই চলছে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা। দীর্ঘ যানজট, অহরহ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র পার্কিং, যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানো নামানো, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে ইচ্ছামত রাস্তা পারাপারও আগের মতোই রয়েছে। আইন না মেনে যে যার মতো সেই ফ্রি-স্টাইলেই চলছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্ধ হয়নি নসিমন-করিমনের মতো ছোট যান চলাচল। ৪ ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা। ঢাকা-ময়মনসিংহসহ মহাসড়কের অবস্থা আগের মতোই মাইলের পর মাইল যানজট লেগেই থাকছে। সড়কের দুই পাশে ট্টাকের স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে। এতে যানজট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীসহ সারাদেশেই গবাদিপশুর হাট বসার প্রস্তুতি চলছে। ঈদের আগে শহর ছেড়ে সাধারন মানুষ যখন গ্রামের দিকে ছুটবেন তখন ভয়াবহ যানজটের আশংকা রয়েছে। এমনকি ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছে। এর বাইরে প্রতিদিন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে ‘ট্রাফিক সপ্তাহ’ সফল। কিন্তু রাস্তায় সেই সফলতার চিহ্নমাত্র নেই। গত ১১ আগস্ট বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আরো ৩দিন বাড়ানো হয়। সারাদেশে চলা বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহে পুলিশের হাতে যানবাহন চালকের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে অনেক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর ৯৮ ভাগ পরিবহন এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আত্মীয়দের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া আন্তঃজেলা রুটেও এ চিত্র ৬০ ভাগের বেশি। এ প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা বা ট্রাফিক আইন না মানার ক্ষেত্রে দন্ড দেয়া হলে রাজনৈতিক প্রভাববিস্তার করা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় বেশিরভাগ পরিবহন। এমনকি পুলিশ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাংবাদিকরাও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অরাজকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন সকলকেই আইন মান্য করতে হবে। সকলের সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস্তাসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। অন্যতায় পরিবহন সেক্টরের মতো দেশের সর্বত্রই আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে।

মহাসড়কে ফিটনেসহীন যানবাহন ঠেকানোর ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ প্রধান ড. জাবেদ পাটোয়ারি। গতকাল সোমবার পুলিশ সদরপ্তরে এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ঘরমুখো মানুষের ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্নে করতে পুলিশ কাজে করে যাচ্ছে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে পারবে না ও লাইসেন্সবিহীন কোনো চালক সড়ক মহাসড়কে গাড়ি চালাতে পারবে না। গত ১১ আগস্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বিদেশে যেখানে ৯৮ শতাংশ মানুষ আইন মানে, বাংলাদেশে সেখানে ৯০ ভাগ মানুষ আইন মানেনা। এ ৯০জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সবচেয়ে কঠিন অসম্ভব।
গতকাল রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি, বিমানবন্দর সড়ক, মালিবাগ, শাহবাগ ও মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ডের বাইরে যত্রতত্র ওঠানামা চলছে যাত্রীদের। বাসের দরজায় ঝুলে আছে যাত্রীরা। সুযোগ পেলেই উল্টো পথে ছুটছে গাড়ি, ফুটপাতে উঠছে মোটরসাইকেল। পদচারী সেতু ব্যবহার না করে চলছে রাস্তা পারাপার। কিছু কিছু জায়গায় দেখা গেছে ট্রাফিক পুলিশদের হাল ছেড়ে দেয়ার দৃশ্য। চালকের কানে মোবাইল, আবার অনেক পথচারীও মোবাইল কানে লাগিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে দিচ্ছেন ভোঁ দৌড়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ফিটনেসহীন গাড়িতে রাস্তা সয়লাব। আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা এমন অনেক বাসকে আটকে দিয়েছিল, শিক্ষার্থীরা চলে যেতেই এখন আবার নেমেছে সেই লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো। এগুলোর কয়েকটিতে রঙের প্রলেপ পড়েছে বটে কিন্তু রং ভেদ করে যেন এদের রুগ্নতা বেরিয়ে আসছে প্রকটভাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানউল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশে আইন না মানার প্রবনতা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নৌপথ ও গ্রামীন জনপথে আইনের প্রয়্গো তেমন দরকার হয় না। কিন্তু শহরে কেউ আইন মানছেন না। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে চোখে আঙ্গল গিয়ে দেখিয়ে গেছে আইন না মানার প্রবনতা কত বেশি। এ ধরনের অরাজকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন সকলকেই আইন মান্য করতে হবে। সকলের সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস্তাসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। এ জন্য আমাদের আরো সময় প্রয়োজন বলে অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানউল্লাহ মন্তব্য করেন।
মহাখালীতে হাবিব নামে এক ট্রাফিক সদস্য বলেন, সকাল থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি সড়কে শৃঙ্খলা আনতে। এক দিক সামাল দিলে অন্য দিক দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল অর্থাৎ আইন অমান্য করে চলে যায়। কেউ আইন মানতে চায় না।

পল্টন মোড়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে দেখা যায়, সব সময় এ এলাকায় যানজট লেগেই থাকছে। ট্্রাফিক মোড়গুলোতে কোনো ট্রাফিক বাতি নেই। সেখানকার কর্তব্যরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, সকাল থেকে আমরা রাস্তার শৃঙ্খলার জন্য চেষ্টা করি। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে এখনো আইন মানার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। তারা ট্রাফিক সিগন্যালও মানতে চায় না। অনেকেই নিজেকে সরকারের প্রভাবশালী বা আমি অমুকের আত্মীয় বলে পরিচয় দেন তখন আমরা অসহায় হয়ে যাই। যারা আইন তৈরি বা প্রয়োগ করেন তারাই আইন ভঙ্গ করেন। আইনের প্রতি সকলের শ্রদ্ধা না থাকলে এ ধরনের পরিস্থিরি উন্নতি হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মালিবাগে বাস চালক সিরাজুল ইসলাম জানান, রেসিংয়ের মধ্য দিয়েই রাজধানীতে বাস চালাতে হচ্ছে। সিরিয়ালের গাড়ি হলেও অন্য গাড়িকে পেছনে ফেলতে না পারলে অতিরিক্ত টাকা রোজগার করা যায় না। ফলে একটি বাস আরেকটির সঙ্গে গা ঘেঁষে চলছে। তিনি বলেন, কোনোটি খানিক চাপ দিলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যাত্রী উঠা-নামার সময় একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে সাইড না দেয়ার ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। ওই সময় কেউ কেউ গুরুতর আহত হন। আবার কারও কারও প্রাণ যায়। আমাদের কিছুই করার নেই। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। কেউ আইন মানে না, আমাকে একা আইন মানতে হলে আয় কমে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে যানবাহনের ত্রæটির পাশাপাশি রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনাগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। শুধু সাধারন মানুষ নয়, যারা রাষ্ট্র পরিচালন করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন তাদের অবস্থাও এ সময় প্রকাশ পেয়েছে। এক কথায় আইন কেউ মানছেন না। রাস্তাসহ রাষ্ট্রের সকল জায়গাতেই আইন না মানার প্রবনতা রয়েছে।
পুলিশ হেডকোয়াটার্স থেকে জানানো হয়েছে, গত ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ট্রাফিক সপ্তাহে গত রোববার ৮ম দিনে দেশের ৬টি মেট্রোপলিটন এলাকা, ৮টি রেঞ্জ এবং হাইওয়ে রেঞ্জে মোট ১লাখ ৪৬হাজার ৩৬৩ টি যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩হাজার ৭৫৯ জন চালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। এ সময়ে ৫ কোটি ২৫লাখ ৪১ হাজার টাকা বিভিন্ন আইনগত অনিয়মের কারণে জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া আইনগত ব্যবস্থা হিসেবে ৩হাজার ৭শ’ ৭৭টি যানবাহন আটক করা হয়েছে। আগামী ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এ ট্রাফিক সপ্তাহ চলমান থাকবে।

দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানিয়েছেন, ট্রাফিক সপ্তাহে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইন অমান্যকারী, উল্টো দিকে গাড়ি চালানো, লেন অমান্য করা, হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো, বিকার লাইট থাকা, ফিটনেস না থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স মেয়াদ শেষ হলেও তা দিয়ে গাড়ি চালানোসহ বিভিন্ন অপরাধে অধিকাংশ মামলা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মামলা হলেও জরিমানা দিয়ে কাগজপত্র ঠিক না করেই ওই কাগজ দেখিয়ে অনেক গাড়ি চালক গাড়ি চালাচ্ছেন। গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে উড়াল সেতুর ঢালে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের চাপা দেয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত ও কয়েকজন আহত হন। নিহত দুই শিক্ষার্থী হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম। দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সারা দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। প্রায় সপ্তাহব্যাপী রাজপথে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে। গোটা সড়ক যোগাযোগ কার্যত অচল হয়ে যায়। এমন বাস্তবতায় অনেকটা তড়িঘড়ি করে সড়ক নিরাপত্তা আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/147635