১০ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ১২:৫৬

সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে পশুর হাট

আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশে ইতিমধ্যেই বসেছে পশুর হাট। এসকল পশুর হাট ঘিরে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, বিভিন্ন সিটি ও জেলা পর্যায়ে পশুর হাট ইজারা দেয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণের পরিবর্তে গোপনে কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে ইজারা দেয়া হয়েছে। প্রধান্য দেয়া হয়েছে এলাকার সরকার দলীয় সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের। এর ফলে সরকার শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে। আবার কোথাও কোথাও প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও মূলত কাউন্সিলর, প্রভাবশালী নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা নেপথ্যে থেকে যে ক’টি দরপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, তার অধিক দরপত্র সাধারণত জমা পড়ে নাই। ফলে নিয়ন্ত্রণের লাগাম ছিল সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে। যশোর থেকে মিজানুর রহমান তোতা, রাজশাহী থেকে মো: রেজাউল করিম রাজু, বগুড়া থেকে মহসিন আলী রাজু, চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম, এবং কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুনের পাঠানো তথ্যে এমন চিত্র ফুটে উঠে।
যশোর থেকে মিজানুর রহমান তোতা জানান, যশোর অঞ্চলে পশুর হাট ইজারা দেওয়ার প্রস্ততি চলছে। গতবারের মতো এবারো ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকছে না বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কোরবানির পশু হাটের বেচাকেনা হবে আরো ২/৩দিন পর থেকে। গরু ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এবার পশুহাটে শতভাগই দেশী গরু ও ছাগল উঠবে বলে ক্রেতা ও বিক্রেতারা প্রত্যাশা করছেন। অনেকেই বলেছেন আর ভারতীয় গরুর ব্যবসা করবো না। দেশী গরুর ব্যবসাতে কোনরূপ ঝুঁকি নেই, নিরিবিলি ব্যবসা করবো। পুঁজি লগ্নি করে নানা ঝামেলা মাথায় নিয়ে ভারতীয় গরু ঢোকানোর চেষ্টা করবো না।

রাজশাহী থেকে মো: রেজাউল করিম রাজু জানান, এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশুর হাট রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ‘সিটি হাট’। এছাড়া নওহাটা, কাটাখালি, মহিশালবাড়ি, কাঁকনহাট, মচমইলহাট, কেশরহাট, বানেশ্বরহাট, সাবাইহাটে পশু বেচাকেনা চলছে। সিটিহাট ছাড়া অন্যগুলো এখন সপ্তাহে একদিন করে বসছে। সিটি হাটের ইজারাদার জানান, এখন থেকে প্রতিদিনই হাট বসবে। কাটাখালি ও বানেশ্বর হাট দুটি বসবে সংশ্লিষ্ট কলেজ মাঠে। সংশ্লিষ্টদের মাথে আলাপকালে জানা যায়, সিটি হাট ছাড়া অন্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের। এবারো তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের থেকে অনুমতি নিয়ে সমঝোতা করে বসেছে হাট। পশু কেনা বেচার ছাড়পত্র মূল্য তাদের ইচ্ছেই নির্ধারণ করা হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের মাঠে হাট বসবে তাদের উন্নয়নের নামে কিছু দেয়া হবে এমনটি জানান হাট সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা জানান, এবারো ইচ্ছেমতই আদায় করা শুরু হয়েছে ছাড়পত্র আদায়। হাটে পশু নিয়ে ফেরত গেলেও দিতে হচ্ছে টোল। এরপর ক্রেতা বিক্রেতাকেও দিতে হচ্ছে ফি। হাটগুলো প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে বলে তাদের ইচ্ছের কাছেই জিম্মি ক্রেতা বিক্রেতারা। যদিও হাট নিয়ন্ত্রনকারীরা বলছেন তারা অতিরিক্ত কোন ফি আদায় করছেনা।
বরিশাল থেকে নাসিম উল আলম জানান, বরিশাল মহানগরীতে কোরবানীর গরুর হাট নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ নেই ইজারাদারদের। গতকাল পর্যন্ত মাত্র একজন ১টি হাটের ইজারা গ্রহণের আবেদন করেছেন নগর ভবনে। জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনে পশুর হাট নিয়ে কখনোই প্রকাশ্যে নিলাম অনুষ্ঠিত হয় না। আগ্রহীদের কাছ থেকে লিখিত আবেদন যাচাই বাছাই করে সমঝোতার ভিত্তিতেই ৫দিনের জন্য এসব হাট ইজারা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্ত আসন্ন ঈদ উল আজহা উপলক্ষে কোরবানীর গরুর হাটের জন্য এবার ইজারাদারদের তেমন কোন আগ্রহ নেই। ফলে গত বছর নগরীর দুটি স্থায়ী গরুর হাটের অতিরিক্ত ৫টি অস্থায়ী হাট বসলেও এবার কি পরিস্থিতি হবে তা এখনো বলতে পারছে না নগরভবন কর্তৃপক্ষ। ফলে আগামী সপ্তাহের মধ্যে ইজারা আবেদন জমা এবং তা অনুমোদনের পরে টাকা জমাসহ সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে হাট চালু করা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। পর্যাপ্ত হাট না বসলে গরুর বাড়বেনা অমদানি। ফলে মূল্য পরিস্থিতি নিয়েও শঙ্কা বাড়বে।

বগুড়া থেকে মহসিন আলী রাজু জানান, বগুড়ায় আসন্ন কোরবানীর পশুর হাটগুলো এখনও জমে ওঠেনি । ধারণা করা হচ্ছে, আগামী রোববার থেকে পুরোদমে পশুর হাটে কেনাবেচা শুরু হবে। বগুড়ায় ছোট বড় শতাধিক হাটে কোরবানীর পশু কেনাবেচা হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও বড় বড় ও গুরুত্বপর্ণ হাটগুলোর স্থায়ী ও অস্থায়ী ইজারা নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারি দলের নেতাদের হাতেই। তবে গতকাল বৃহষ্পতিবার বগুড়া রাজস্ব বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানীর হাটগুলোতে যাতে ক্রেতা বিক্রেতারা প্রতারিত না হয় সেজন্য আইনশৃংখলা বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রামে ঝামেলা মুক্ত কোরবানির পশুহাটের ইজারা মূল্যও বেড়েছে। হাটের ইজারা নিয়ে এবারও কোন অপ্রীতিকর কিছু হয়নি। দেশের অন্যান্য এলাকায় পশুর হাটের ইজারা নিয়ে রাজনৈতিক চাপ আর হাঙ্গামা হলেও ব্যতিক্রম চট্টগ্রামে। দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সরকারি দলের সমর্থিতদের প্রাধান্য ছিল বেশি। তবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দলীয় পরিচয়ের চেয়ে পশুর হাট ইজারার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দরদাতাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ফলে ঝামেলাহীন ইজারায় সিটি কর্পোরেশন মূল্যও বেশি পেয়েছে। পবিত্র ঈদ উল আজহা উপলক্ষে এবারও স্থায়ী দুটি পশুর হাটের পাশাপাশি ছয়টি অস্থায়ী পশুরহাটের ইজারা দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। স্থায়ী অস্থায়ী মিলে আটটি পশুর হাট এখন প্রস্তুত। এসব হাটে আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। এবার আটটি হাটের ইজারা মূল্য পাওয়া গেছে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ দুই হাজার ৫৪৯ টাকা। অস্থায়ী ছয়টি হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে ছয় কোটি ১৭ লাখ এক হাজার ৫১ টাকা।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সামসুদ্দোহা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দরপত্র আহŸানের মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পশুর হাট ইজারা দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ দরদাতারাই ইজারা পেয়েছেন। আর এ কারণে ইজারা মূল্য অনেক বেড়েছে। ইজারাদারদের মধ্যে রাজনীতির লোক থাকলেও সিটি কর্পোরেশন এক্ষেত্রে কাউকে বিশেষ খাতির করেনি। যিনি সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন তিনি ইজারা পেয়েছেন।

কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান, কুমিল্লায় কোরবানীর পশুর হাট ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ করেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। গত বছর জেলায় ২৭০টি হাট ইজারা দেয়া হলেও এবারে তা বেড়ে তিনশোতে দাঁড়িয়েছে। তবে ইজারার বাইরে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারেও সতের উপজেলায় অবৈধ হাটের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে যাবে। যেখানে সরকারের কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইজারা বহির্ভূত এসব অবৈধ হাট ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

কুমিল্লা জেলায় প্রায় তিনশো অস্থায়ী কোরবানীর পশুর হাটের ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবারে হাটের সংখ্যা বেড়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব এবং টেন্ডার সমঝোতায় অস্থায়ী কোরবানীর পশুর হাটগুলো এবছরও সংশ্লিষ্টদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছরই এরা প্রভাব খাটিয়ে যত্রতত্র কোরবানীর পশুর হাট বসায়। প্রতি উপজেলায় কম করে হলেও ৮/৯টি অবৈধ হাট বসে। সেই হিসেবে জেলায় ইজারাবিহীন শতাধিক হাট ঈদের আগের এক সপ্তাহ পর্যন্ত জমজমাট ব্যবসা করে। এসব হাট থেকে সরকারের রাজস্ব কয়েক কোটি টাকা আসার সম্ভাবনা থাকলেও টাকা চলে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের গড়া সিন্ডিকেটের পকেটে।

https://www.dailyinqilab.com/article/146884