১০ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ১২:২৮

তারা ভুল ধরিয়েছে পথ দেখিয়েছে সবাইকে অপরধ করেনি ॥ সাধারণ ক্ষমার প্রশ্ন কেন?

শিশু-কিশোররা পথ দেখিয়েছে। তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে মৌলিক গলদ কোথায়? যারা বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে আসা যাওয়া করতো, ক্লাস শেষে কোচিং করলে সেখানেও অভিভাবকদের হাত ধরেই যেতো। তারাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে নেমে আসে রাজপথে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ছাত্রছাত্রীরা গাড়ির ফিটনেস আর চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে। সড়কে গাড়ি চলাচলের লেনও ঠিক করে দিয়েছে। এ সময় বেরিয়ে আসে মন্ত্রী, সচিব, পুলিশ থেকে শুরু করে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেরই গাড়ির ফিটনেস নেই, চালকদের লাইসেন্সও নেই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদের এই দাবি, তাদের উদ্যোগের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। দেশে বিদেশে সব মহল থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাদের মুখে মুখে ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। তারা চেয়েছিল বিচার। এখন তাদেরই বিচার করা হচ্ছে। রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। গত বুধবার এক সভা থেকে তাদের সাধারণ ক্ষমা করার দাবি জানানো হয়েছে। তাদের অপরাধটা কী? বিচার চাওয়াটা অপরাধ? ‘রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে’ এই কথা বলা কী অপরাধ? দাবির জন্য মাঠে নামা কী অপরাধ? তাহলে তাদের সাধারণ ক্ষমা করার প্রশ্ন আসছে কেন?

গত ২৯ জুলাই দুপুরে ছুটির পরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম ওরফে সজীব এবং একই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিম নিহত হন। তারা রাস্তার পাশে ফুটপাথে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় জাবালে নূর পরিবহণের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এই ঘটনার পর ৯ দফা দাবিতে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলোর সাথে নৌপরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবিও পরে যুক্ত হয়। বৃহস্পতিবার সরকার বন্ধ ঘোষণা করে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষার্থীদের উত্তাঙ্গ ঢেউ তাতে কমেনি, বরং আরো বেড়েছে। এ দিন ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে। রাজধানী শহর ছিল অচল। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়। অবরোধে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে। তবে তারা তা মেনে নিয়েছেন হাসি মুখেই। মন্ত্রী, সচিব, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিক সমাজের প্রভাবশালী একটি বড় অংশ যে কোনো আইনের তোয়াক্কা করেন না, আইনি ব্যবস্থা যে এখানে বহুলাংশে ভেঙে পড়েছে এই শিশুরা আমাদের সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয়েছে সারা দেশে। টানা কর্মসূচি চলার মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহণ মালিকরা। তারা বাস বন্ধে নিরাপত্তার কথা বললেও শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে দূরপাল্লার কোনো বাসে হামলা করেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
মোড়ে মোড়ে সব ধরনের যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীরা। পঞ্চম দিনে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও গাড়ির কাগজপত্র না থাকায় আটকে দেয় শিক্ষার্থীরা। যানবাহনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে শিক্ষার্থীদের চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। পরিবহণ না থাকায় রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ হেঁটে, রিকশায় বা বিকল্প যানে দুর্ভোগ সঙ্গী করে চলাচল করলেও এতটুকু বিরক্তি ছিল না কারও। সাধারণ মানুষ বলছেন দুর্ভোগ সহ্য করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরলে এটি হবে দেশের জন্য একটি বড় অর্জন। এদিকে শিক্ষার্থীদের তল্লাশিতে সরকারি যানবাহনের কাগজপত্র ও লাইসেন্স না থাকার বিষয় ধরা পড়া এবং তা ব্যাপক হারে প্রচার হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে গাড়িতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সড়কে লাখো শিক্ষার্থী ট্রাফিক শৃঙ্খলার চেষ্টা: রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেছে। তাদের মুখে মুখে ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান। বিক্ষোভ করার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষায়ও দিনভর কাজ করেছে। কারো কাগজ না থাকলে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তাকে সার্জেন্টের কাছে নিয়ে মামলা দিয়ে ছেড়ে দেয় তারা। অ্যাম্বুলেন্স ও রোগী বহনকারী গাড়িগুলোকে যানবাহন ও রিকশার মাঝ দিয়ে ইমার্জেন্সি লেন তৈরি করে পার করে দেয়ার ব্যবস্থা করে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকে এসব খুদে ট্রাফিকের কাজ।

ঝিগাতলায় গুলী সংঘর্ষ টিয়ার শেল: ৯ দফা দাবিতে শনিবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে নানা সহিংস ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর ঝিগাতলা, ধানম-ি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এদের মধ্যে অনেকেই হেলমেট পরা ছিল। তারা ফাঁকা গুলী করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সবমিলিয়ে শনিবার রাজধানীর ধানম-ির ঝিগাতলা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানে আহত হয়েছে শতাধিক ছাত্র। এ ঘটনার পর ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয় লক্ষ্য করে ছাত্ররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ছাত্র হত্যা ও ধর্ষণের গুজব বারবার ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি সদস্যরা সেখানে অভিযান চালায়। সাদা পোশাকের কিছু যুবককে ঘটনাস্থলে লাঠি হাতে মহড়া দিতে দেখা যায়। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরেও ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষার্থী-পথচারীসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে নিলয় নামের এক শিক্ষার্থীসহ ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। আহতদের ঢাকার পপুলার এবং জাপান ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। ধানম-িতে হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যার পর প্রগতি সরণির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান ফটকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নতুন করে অবরোধ করে। পরে অবশ্য একদল যুবকের হামলার মুখে তারা চলে যায়। আন্দোলনের মধ্যে সন্ধ্যার পর মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

ওই দিন দিনভর নানা গুঞ্জন সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন ছাত্র নিহত হওয়া, ছাত্রীরা লাঞ্চিত হওয়া, ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার কথা সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। যদিও সরকার বলছে, এসবই গুজব।
হামলাকারীদের টার্গেট সাংবাদিক: নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলে আসা কোমলমতি শিশুদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গত শনিবার হঠাৎ করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আহত হয় বেশ কিছু শিক্ষার্থী। এর প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর রাজপথে নেমে আসেন। সায়েন্সল্যাব এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগ হামলা চালায়। এ ছাড়া পৃথকভাবে ধানমন্ডি ও মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর হামলার খবর পাওয়া গেছে। এতে অন্তত ১০ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুপুরে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন নয়া দিগন্তের ফটো সাংবাদিক মোহাম্মদ শরীফ, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এ এম আহাদ, দৈনিক বণিক বার্তার পলাশ শিকদার, ফ্রিল্যান্স ফটো সাংবাদিক রাহাত করিম, নাগরিক টিভির নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুল্লা সাফী ও ক্যামেরাপারসন রিপন হাসান প্রমুখ। ধানমন্ডি-১ নম্বর সড়কে ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহত হন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত।
আহত সাংবাদিকদের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। হামলাকারীরা রাহাতের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়। রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করে তাকে রক্তাক্ত করে। লাঠিসোঁটা হাতে যুবকদের মধ্যে মহানগর উত্তরের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছিলেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে দায়িত্ব পালনকালে অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলার বিশেষ প্রতিনিধি গোলাম সামদানীর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়। গোলাম সামদানী জানান, আন্দোলনরত ছাত্রদের লাঠিসোঁটা হাতে ছাত্রলীগ কর্মীরা ধাওয়া দেয়। সেই ছবি তুলতে গেলে ছাত্রলীগের কর্মীরা তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে এবং তার আইডি কার্ড ছিঁড়ে ফেলে। ছবি তোলার কারণে কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরে গালাগাল করতে থাকে।
বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে হামলা: সোমবার আবারো রাজধানীতে হামলার শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বাড্ডার আফতাব নগরে এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে টিয়ারশেল ও জলকামান থেকে পানি ছুড়েছে পুলিশ। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বাড্ডায় বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভাঙচুরও করে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এসময় সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা করে, শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুরের পর থেকে থেমে থেমে সন্ধ্যা পর্যন্ত হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে।
২২ ছাত্র রিমান্ড শেষে কারাগারে: নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের দুই মামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় করা দুই মামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন।
এর আগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আলাদা দুই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ২২ ছাত্রকে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা বিভিন্ন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক জামিনের আবেদন খারিজ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে গত ৭ আগস্ট ঢাকার মহানগর হাকিম আবদুল্লাহ আল মাসুদ ২২ ছাত্রকে দুই মামলায় রিমান্ডে পাঠান।
রিমান্ডে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ, সাউথ ইস্ট ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রয়েছেন। এর মধ্যে বাড্ডা থানার এক মামলায় ১৪ জন, ভাটারা থানায় আরেক মামলায় আসামী আটজন।
আরো হয়রানি: গত বুধবার বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিদের সাথে সভা করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময় প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আব্দুল হান্নান চৌধুরী বলেন, আমরা জানতে পেরেছি আগের কোনও অজ্ঞাত মামলায় আটক শিক্ষার্থীদের ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরনো মামলায় জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা চাই, যা হবার হয়েছে, যেহেতু এখন পরিস্থিতি শান্ত, ফলে শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হোক।

নিঃশর্ত মুক্তি আর সাধারণ ক্ষমা: শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত ক্ষমার দাবি প্রথমে তোলেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি আব্দুল মান্নান চৌধুরী। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যাই করেছে তাদের সাধারণ ক্ষমা করা উচিত। কারণ, পরিস্থিতি কোনও না কোনও কারণেই তো সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া নতুন করে কোনও ইস্যু তৈরি করে, সেই সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এরা আমাদেরই সন্তান। তারা বিভ্রান্ত হয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের ধরুন।
নর্দান ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের প্রতিবাদকে অন্যায় বলবো না। তারা যে জন্য আন্দোলন করেছে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, মাফ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা মাফ করার কে? উদ্দেশ্যমূলকভাবে যারা বেআইনী কাজ করেছে, আইন-শৃংখলা বাহিনী তাদের দেখবে। নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হবে না।

সহিংসতা কাম্য ছিল না: লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পদত্যাগই সব সমস্যার সমাধান, তা কেউ বলবে না। তিনি পদত্যাগ না করলেও অন্যভাবে সমস্যাটির সমাধানের চেষ্টা করা যেত। শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে কর্তৃপক্ষ যেভাবে প্রশমিত করতে চেয়েছে, তা সঠিক পথ ছিল না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার নির্দেশের মধ্যে আমি কোনো যুক্তি দেখতে পাইনি। এখন আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ওপর শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা যদি স্কুলেও না যায় এবং রাস্তায়ও না নামে, ব্যবস্থাপনা কমিটি কী করতে পারে? তিনি বলেন, কিশোর-কিশোরীরা নাগরিক হয়ে ওঠার আগেই নির্মমতার শিকার হলো। সড়কে নিরাপত্তা শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, সব মানুষের দাবি। সস্নেহে যার সমাধান হতে পারত, তার সমাপ্তি সহিংসতায় কাম্য ছিল না।

এটুকু প্রতিবাদ সহ্য হচ্ছে না: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, একরাতে চমকে উঠি ফেসবুক দেখে। রক্তাক্ত স্কুলছাত্রকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়ার ছবি, হাত বেয়ে চুইয়ে পড়া রক্তের ছবি, স্কুলের ইউনিফর্ম আর কেডসের গায়ে রক্তের ছোপ ছোপ চিহ্ন। গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র নয়, বাংলাদেশের পুলিশের পেটানোর ক্ষত বাংলাদেশের শিশুদের গায়ে!
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি অনেকটা রাত। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলের পা গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছিল প্রকাশ্যে। গ্রেপ্তার হয়নি হাতুড়িওয়ালা, আর চিকিৎসা ছাড়াই সরকারি হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয় তরিকুলকে। এমন বহু নারকীয় কা- দেখে দেখে ক্ষুব্ধ গর্জনে ফেটে পড়তে ইচ্ছা হয়েছিল আমারও। কিন্তু এ দেশে এখন গর্জন পাপ, প্রতিবাদ নৈরাজ্য, প্রতিরোধ রাষ্ট্রদ্রোহ। অদ্ভুত এক অবসাদ নেমেছিল দেহে-মনে। ‘ঝিনুক নীরবে সহো’।
কিন্তু নীরবে কি সহা যায় সবকিছু? কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ত। আর এবার রাজপথে একের পর এক হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা শিশু-কিশোরদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে পুলিশ! তাদের অপরাধ? একের পর এক বেপরোয়া সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার না পেয়ে নেমে এসেছে তারা রাস্তায়। এটুকু প্রতিবাদ সহ্য হচ্ছে না এ দেশের শাসকদের। তাহলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের দেহ সড়কে পিষ্ট হওয়াকে তারা সহ্য করলেন কীভাবে?
গু-া লেলিয়ে দেয়া হয়েছে: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন সমাবেশে বলেন, দেশে অসুস্থ শাসন ব্যবস্থা চলছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আজকে গু-া লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা লাঠিসোঁটা নিয়ে নিরীহ ছাত্র-ছাত্রী ও নিরীহ মানুষের ওপরে হামলা করে যাচ্ছে, তাদের আমরা গু-া ছাড়া আর কোনোভাবে চিহ্নিত করতে পারি না। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, আছে গু-াতন্ত্র। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, গু-ামুক্ত বাংলাদেশ চাই আমরা। এদের থেকে দেশকে মুক্ত করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে, ঐক্যবদ্ধ হোন। এ ঐক্যবদ্ধ মানুষকে গু-া লেলিয়ে ধ্বংস করা যাবে না।

অবিচার যখন আইন হয়, রুখে দাঁড়ানো কর্তব্য হয়ে পড়ে: সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, আমাদের কিশোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দিন হলো। সরকারি দলের গু-ারা প্রকাশ্যে লাঠি-অস্ত্র হাতে পুলিশের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করছে। শিক্ষার্থীদের দাবি কী? নিরাপদ সড়ক এবং একটি সুশৃঙ্খল দেশ। এ শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি দলের গু-ারা আক্রমণ করছে এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার। তিনি বলেন, সরকার এখনো উপলব্ধি করতে পারছে না। তারা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এসব কি আইনসম্মত, শিক্ষার্থীরা বলছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। প্রতিটি পদক্ষেপ যখন জাস্টিসের বদলে অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। অবিচার যখন আইন হয়ে যায়, রুখে দাঁড়ানো তখন কর্তব্য হয়ে পড়ে।

প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা: শিশু-কিশোর আন্দোলন চলাকালে শনিবার শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। রাজধানীর ঝিগাতলা, ধানম-ি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এদের মধ্যে অনেকেই হেলমেট পরা ছিল। তারা ফাঁকা গুলী করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন। এঘটনার প্রতিবাদে পরদিন আন্দোলনে যোগ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ওই দিন আরো ব্যাপক আকারে হামলার শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ওপর পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজধানীর জিগাতলা এলাকা।
সোমবার হামলার শিকার হয় রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ দিন বাড্ডার আফতাব নগরে এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে টিয়ারশেল ও জলকামান থেকে পানি ছুড়েছে পুলিশ। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বাড্ডায় বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভাঙচুরও করে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
মূলত শিশু-কিশোরদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়েই হামলার শিকার হয় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এখন তারা মামলা, রিমান্ডের মুখোমুখি।

http://www.dailysangram.com/post/341231