১০ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ১২:২৭

চামড়ার দাম কমছে॥ পাচারের আশঙ্কা


# গত বছরের চামড়ার ৪০% অবিক্রিত
র চামড়ার ব্যবসায়ীরা দুই বছরের বকেয়া পায়নি
# প্রতিবর্গ ফুট গরুর চামড়া ৪৫-৫০ ও ৩৫-৪০ টাকা
# ছাগলের চামড়া ১৮-২০ ও ১৩-১৫ টাকা

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও আসন্ন ঈদে কুরবানির পশুর চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় আরও কমিয়েছে সরকার। এ বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা শহরে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটে দাম কমেছে দশ টাকা। এছাড়াও সারা দেশে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম হবে ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত বকরির চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের সামনে এই ঘোষণা দেন।
জানা গেছে, প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ১০ টাকা কমাতে প্রতিবেশি দেশ ভারতে পাচারের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। একই সাথে বলা হচ্ছে এবছর ট্যানারি মালিকরা এ দামেও চামড়া কিনতে পারবে না। কারণ ট্যানারি শিল্প নগরীতে উন্নয়ন কাজের কারণে তাদের হাতে কোন টাকা নেই। আর এ কারণে যদি তারা চামড়া কিনতে ব্যর্থ হয় তাহলে পাচার রোধ করা কঠিন হবে। সূত্র আরও জানায়, এখনও ট্যানারি মালিকরা গত বছরের বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। এতে করে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছে। তারা বলছেন, সরকার দাম নির্ধারণ করলেও কোন লাভ নেই।
এ দামে তারা চামড়া কিনতে পারবে না। কারণ তারা আমাদের আগের বকেয়া এখনও পরিশোধ করতে পারেনি। তাহলে আমরা কিভাবে চামড়া কিনবো। এতে করে চামড়া পাচার হতে বাধ্য। সরকার ট্যানারি মালিকদের ব্যাংক ঋণ দিলেও তারা কোন চামড়া কিনেন না। তাহলে কেন তাদের ঋণ দেয়া হয়। তারা চামড়াও কিনে না আর ঋণও পরিশোধ করেন না। তাহলে আমরা কিভাবে চামড়া কিনবো।
ট্যানারি মালিকরা রফতানি অর্ডার পেলেই কেবল চামড়া ক্রয় করে থাকেন। তা না হলে আমাদের গোডাউনেই সারা বছর চামড়া পড়ে থাকে। তাহলে কেন আমরা সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করবো। সারা বছর গোডাউন ভাড়া দিয়ে তাদের সুবিধামত সময় সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করবো কিভাবে। এমনিতেই আমরা লোকসানে আছি।

জানা গেছে, প্রতি বছরই সরকার চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু সে মূল্যে কোন দিনই ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে পারেন না। এতে করে সাধারণ মানুষের হাত থেকে কম দামে চামড়া চলে আসে। পরে নিজেদের চাহিদা মত বেশি দাম দিয়েই ট্যানারি মালিকরা চামড়া ক্রয় করে থাকেন।
প্রতি বছরই আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে চামড়া চলে যায় প্রতিবেশি দেশ ভারতে। সরকার সীমান্তে রেড এলাট জারি করলেও পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। এ অন্যতম কারণ হলো ব্যাংক ঋণের টাকা ট্যানারি মালিকরা কাঁচা চামড়া ক্রয় না করা। এতে করে পুঁজির অভাবে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে পারেন না। বাধ্য হয়ে প্রতিটি চামড়া ৫০০-১০০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। অথচ আজ থেকে ৫ বছর আগেও বড় একটি চামড়া বিক্রি হতো আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। প্রতি বছরই প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম কমছে ১০-১২ টাকা। এতে করে পাচার হচ্ছেই। কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন দাম কমিয়ে পাচার রোধ করা যাবে না।
সূত্র জানায়, সীমান্তবর্তী এলাকার ব্যবসায়ীরা কাচা চামড়া ক্রয়ের জন্য ভারত থেকে গরু কিংবা নগদ টাকা এনে থাকেন। আর এ কারণেই চামড়া পাচার করতে তারা বাধ্য। যদি সরকার ট্যানারি মালিকদেও ঋণ না দিয়ে সরাসরি কাচা চামড়া ক্রয়ের জন্য ঋণ দিতে পারেতো তাহলে পাচার অনেকাংশ রোধ করা যেতো। সীমান্তে এত পাহারা দরকার হতো না।

এদিকে ট্যানারি মালিকরা বলছেন আমরা চামড়া কিনে কি করবো। এখনও অর্ধেকের বেশি ট্যানারি চালু করা যায়নি। কারখানা উন্নয়নের কারনে অনেকেই তাদেও মূলধন হারিয়ে ফেলেছে। তাহলে কিভাবে আমরা চামড়া ক্রয় করবো। এতো চামড়া রাখার মত গোডাউনও আমাদের নেই। আর সারা দেশে মওসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় কওে থাকেন। আমরা তাদের থেকে পরে চামড়া ক্রয় করে থাকি।
গত বছরের চামড়ার দামের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, এবার কুরবানির গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে পাঁচ টাকা করে কমেছে। গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছিল সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা। একইভাবে কুরবানির খাসির চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে প্রতি বর্গফুটে কমেছে ২ টাকা করে। গত বছর এর দর ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা। অন্যদিকে, কুরবানির বকরির চামড়াতেও এবার প্রতি বর্গফুটে ২ টাকা করে দাম কমিয়েছে সরকার। গত বছর এই দাম ছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা।

গত বছরের চেয়ে কুরবানির পশুর চামড়ার দাম কমার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, মূলত দুটি কারণে এবার কুরবানির পশুর চামড়ার দাম কমানো হয়েছে। প্রথম কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা ব্যাপক হারে কমেছে। দ্বিতীয়ত, সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপিত হলেও এখন পর্যন্ত তা পরিপূর্ণভাবে কাজ শুরু করতে পারেনি। নানা ধরনের ত্রুটি রয়েছে সেখানে। যে কারণে সেখানে এখনও ঠিকভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ সময় সরকার চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের বন্ধু। সবাই দেশকে ভালোবাসী। আসলেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চামড়ার সেক্টরটি খারাপ পর্যায়ে আছে। তাই ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতেই দর কম করে নির্ধারণ করে দিয়েছি। ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার অর্থ জিম্মি হওয়া নয়। দেশের এই ব্যাপক উন্নয়নে ব্যবসায়ীদের অবদান অনস্বীকার্য।
আরেক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এ বছর রফতানির অন্যান্য খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও চামড়া খাতে রফতানি প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ কমেছে।

কুরবানির পশুর চামড়ার দাম গত বছরের চেয়েও কমানোর কারণে চোরাচালানের মাধ্যমে তা দেশের বাইরে চলে যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবি অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
এ সময় ট্যানার্স ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদের কাছে চলতি বছর চামড়া কেনার লক্ষ্য কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনও লক্ষ্য এখনও আমরা নির্ধারণ করিনি। কারণ, গত বছর কেনা চামড়ার ৪০ শতাংশ এখনও মজুত আছে। যার গুণগত মান অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক আমাদের যে ঋণ দিয়েছে তাও অনিশ্চিত। কারণ, গত বছর পাওয়া ঋণ আমরা এখনও পরিশোধ করতে পারিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন গত বছরের তুলনায় পাঁচ টাকা বাড়িয়ে গরু-খাসি ও বকরির চামড়ার দাম প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু, সরকার নির্ধারিত বর্তমান দাম তার থেকে ১০ টাকা কম।

 

http://www.dailysangram.com/post/341230