৯ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৪০

আতঙ্কে শিক্ষার্থী-অভিভাবক

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন স্থানে হামলা, মারধর, গ্রেফতার ও রিমান্ডের ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। হামলা ও পুলিশি হয়রানির কারণে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবক মহল। অনেক অভিভাবক সন্তানদের ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আবার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের সাময়িক যেতেও বারণ করছেন। সব মিলিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরাজ করছে হামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক ছাত্রকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটিয়ে সহিংসতার আহ্বান জানানোর অভিযোগে রাজধানীতে আরো ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৬ আগস্ট বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা ও আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন ঘোষণা করেছেন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

পুলিশ জানিয়েছে, গত সোমবার বসুন্ধরা এবং বাড্ডা এলাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার সাথে জড়িত সন্দেহে এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে ২২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে নয় দিন ধরে চলা আন্দোলনের সময় সংঘটিত নানা ঘটনায় ঢাকার ১৬টি থানায় ৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার বা কারো বাসায় অভিযান চালানো উচিত নয়। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মামলাগুলোতে অজ্ঞাতনামা হিসেবে অনেককে অভিযুক্ত করায় তাদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ ও র্যা ব প্রতি রাতেই বিভিন্ন ছাত্রের বাসায় অভিযান চালাচ্ছে। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার জন্য মাঠে নেমেছিলাম। পরে কয়েক জায়গায় সংঘর্ষ হলেও যারা হেলমেট পরে, লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এমনকি নির্মমভাবে সাংবাদিকদের মারধর করা হলেও এরা এখনও আড়ালেই রয়ে গেছে। শুধু সাধারণ ছাত্ররা মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
র্যা বের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, যারা অপরাধের সাথে জড়িত তাদের আতঙ্কে থাকাটা স্বাভাবিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সন্তান সঠিক পথে রয়েছে কি না এবং কারো মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কি না এমন তথ্য যেসব অভিভাবক রাখেন না তাদের আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। সব অভিভাবককেই সন্তানের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মামলাগুলোতে পুলিশের কাজে বাধা দেয়া এবং সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উস্কানি দেয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানরা পড়ালেখা করেন এমন দু’জন অভিভাবক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কিত। তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে যায়। এখন মামলা হয়েছে, মামলায় কারা অভিযুক্ত জানা যাচ্ছে না। কেউ পরিকল্পিতভাবে ছেলেদের ধরিয়ে দেয় কি না তা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি বলে তারা মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আমরাও চাই যারা অন্যায় করেছে তাদের আইন অনুযায়ী যেন বিচার হয়। একই সাথে কোনো নিরপরাধ শিক্ষার্থী যেন হয়রানি বা মামলার শিকার না হয় সে জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ওই দুই অভিভাবক।
আরো ৬ জন গ্রেফতার
পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের এডিসি নাজমুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগ ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন- তৌহিদুল ইসলাম তুষার (২৪), পিতা-আব্দুর রাজ্জাক, মো: ওয়ালিউল্লাহ (২৮), পিতা-সাইফুল ইসলাম ও ইহসান উদ্দিন ইফাজ (১৮), পিতা-সৈয়দ নূরুল আলম। রমনা থানায় গত ৫ আগস্ট দায়ের করা মামলায় (মামলা নম্বর-৮) তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ, মেমোরি চিপসহ ফেসবুক আইডি ও গ্রুপ জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের সাত দিনের পুলিশ রিমান্ড চেয়ে মহানগর মুখ্য হাকিমের কাছে পাঠানো হয়েছে।
র্যা ব-২ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, ফেসবুকে ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তিন কর্মীকে গ্রেফতার করেছে র্যা ব। মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের সামনে থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন-আখতারুজ্জামান টনি (২২), আসাদুল্লাহ আল গালিব (২২) ও মুনীম সরকার (২৩)। তিনি বলেন, সা¤প্রতিক সময়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল।

বুয়েট ছাত্রকে পিটিয়ে পুলিশে দিলো ছাত্রলীগ
বুয়েটের শিক্ষার্থী দাঈয়ান নাফিস প্রধানের সহপাঠীরা জানান, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ২০-২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে প্রবেশ করেন। সেখানে তারা ১৫তম ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী মো: দাঈয়ান নাফিস প্রধানকে মারধর করে পুলিশের কাছে তুলে দেন। এ ব্যাপারে চকবাজার থানার ওসি (অপারেশন) ইন্সপেক্টর কামরুল হাসান বলেন, মঙ্গলবার রাতে বুয়েটের এক শিক্ষার্থীকে আন্দোলন নিয়ে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে থানায় সোপর্দ করা হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি এবং আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জেরে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়।
ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা
গত ৬ আগস্ট বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা ও আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন ঘোষণা করেছে ব্র্যাক ও শান্ত মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এদিকে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দু’টির কর্তৃপক্ষও পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষার্থীর মুক্তির দাবিতে ক্লাস পরীক্ষায় অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে নোটিশ দিয়ে পরীক্ষা স্থগিত করার বিষয়টি জানিয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার লে. কর্নেল ফয়জুল ইসলাম স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করা হলো। কোরবানির ঈদের পর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। শিগগিরই নতুন সময়সূচি জানিয়ে দেয়া হবে।
আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের বন্ধুদের পুলিশ ধরে নিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে। আমাদের ভাইদের ওপর হামলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা পরীক্ষা কিভাবে দেবো? তাদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেবো না। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়েও পরীক্ষা ও ক্লাস স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, পরবর্তী নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ছাত্ররা ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন না। এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ক্লাস পরীক্ষা শুরু করা হবে। এছাড়া ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি পরীক্ষাও স্থগিত করে। ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটি তাদের সামার সেশনের পরীক্ষা ঈদের পরে নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে চলমান পরিস্থিতি সামলাতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৭ আগস্ট এক মেইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জানানো হয়, আগামী ২৭ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. এ টি এম ফজলুল হক বলেন, ঈদের ছুটিকেই বর্ধিত করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে যেসব পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল সেগুলো আগামী ২৮ আগস্ট থেকে শুরু হবে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস ৬ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার প্রফেসর আক্তার আহমেদ জানান, সার্বিক অবস্থা বিচার করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা ও যানবাহনের অপ্রতুলতার বিষয়টি সর্বাধিক বিবেচনা করে বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।
গোয়েন্দা নজরে উস্কানিদাতারা
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন উস্কানিমূলক অপপ্রচার চালিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে এমন ৩শ’ ফেসবুক ও টুইটার আইডি শনাক্ত করেছে পুলিশ, র্যা ব ও গোয়েন্দা সংস্থা। একই সাথে উস্কানিদাতাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এসব আইডিধারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর গ্রেফতার করা হয়েছে ৬ জনকে। এছাড়া এরই মধ্যে ঢাকার ৩৫ মামলায় ৩৩ জন ছাড়াও চট্টগ্রাম ও নড়াইলে ২ মামলায় ১০ জন, পটুয়াখালীর একটি মামলায় এক শিক্ষিকাসহ সারাদেশে ৩৮টি মামলায় ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/146681