৯ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৮

কী পাল্টেছে ঢাকার সড়কে

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল রাজধানীর পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিসভায় সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই শুরু হয়েছে ট্রাফিক সপ্তাহ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোরদের আন্দোলন সবার চোখ খোলে দিয়েছে এমন বক্তব্য এসেছে সব পক্ষ থেকে। টানা এক সপ্তাহ আন্দোলন চলার পর এখন ঢাকার সড়কের চিত্র পাল্টেছে কিছুটা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট থামলেও এখনও গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। চালক এবং গাড়ির সনদ না থাকায় অর্ধেকের বেশি যানবাহন সড়কে নামছে না। এ ছাড়া লাইসেন্স ছাড়া চালকরাও গাড়ি চালাচ্ছেন কম। বেড়েছে মোটরবাইক চালকদের হেলমেট ব্যবহার। কিছু সড়কে বাসগুলোকে লেন মেনেও চলতে দেখা গেছে। তবে সড়কজুড়ে অনেক ক্ষেত্রে আগের চিত্রই দেখা যাচ্ছে। যত্রতত্র পথচারি পারাপার। যেখানে সেখানে যাত্রী উঠানো। ফুটপাথ দিয়ে মোটরবাইক চালানো এবং সড়ক দিয়ে পারাপারের দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে আগের মতো। ট্রাফিক সপ্তাহ চলায় রাস্তায় লক্কড় ঝক্কড় যানবাহন কমেছে। লক্কড় ঝক্কড় গাড়ি রাস্তায় নামলেই দেদারছে মামলা খাচ্ছে। ভিক্টর পরিবহনের একটি গাড়ি একদিনে ৫টি মামলা হজম করেছে। এতে ২৫০০ টাকা জরিমানা দিয়ে মামলা ভাঙাতে হবে। বললেন পল্টন মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট সাইফুল। তিনি জানান, এজন্য গাড়িটি ২০ দিন সময় পাবে। এরপর যদি রাস্তায় নামে রেকারে যাবে ডাম্পিংয়ে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এই কয়দিনে মানুষের মধ্যে সিগন্যাল মানার প্রবণতা একটু বেড়েছে। মানুষ পুলিশকে সহায়তা করছে। এটা ভালো লক্ষণ। তিনি জানান, আড়াইটা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চারটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মোটরসাইকেলকে মামলা করা হয়। এগুলো লাইসেন্স সংক্রান্ত। অপরটি সিএনজি। এখানে স্কাউটের আটজন শিক্ষার্থী ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে ট্রাফিক ব্যবস্থায় পুলিশকে সহযোগিতা করছেন। তারা বললেন, ফিটনেসবিহীন এবং কাগজপত্র ঠিক নেই এমন গাড়ি রাস্তায় নামছে না। রাস্তায় দায়িত্বরত স্কাউটের শিক্ষার্থীরা শুনেছেন, আয়াত পরিবহনের ২৭টি বাসের মধ্যে ১৪টি গাড়ি বন্ধ রয়েছে। কারণ কাগজপত্র ঠিক নেই।

এদিকে, সিগন্যাল বাতি সচল থাকলেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পুরোপুরি সনাতন পদ্ধতিতে। এতে একদিকে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত শ্রম অপরদিকে অপচয় হচ্ছে বিদ্যুতের। ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পরার আগেই সমন্বিত একটি পদ্ধতি প্রণয়নের দাবি জনগণের। সিগন্যালে জ্বলছে লালবাতি তবুও চলছে গাড়ি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর ৬ই আগস্ট থেকে রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু হয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গণপরিবহন সংকটে গতকালও অফিস ও বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। সকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী জাবালে নূর বাসের চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরে শুরু হয় আন্দোলন। গত ২৯শে জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে প্রথমত দাবি ছিল বাসচাপায় নিহতের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। প্রথম দুইদিন এ নিয়ে পুরো শহর উত্তাল হয়ে উঠে। পরবর্তীতে আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। আর সেটা হয়ে যায় ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থায় ‘পরিবর্তনের’ আন্দোলন।

গতকাল কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় সরজমিন দেখা যায়, কোনো বাস, প্রাইভেটকার, রিকশা কিংবা মোটরসাইকেল চালক ট্রাফিক আইন মানছেন না। দ্রুত যাওয়ার জন্য সবাই এলোমেলোভাবে ছুটে চলছেন। সকাল সাড়ে এগারোটার দৃশ্য, কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে একটি সুপ্রভাত বাস দ্রুত গতিতে এসে তুরাগ বাসকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। আচমকা ধাক্কায় সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরে তুরাগ বাসটি একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সুপ্রভাত আবার তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। এরপর কিছু দূর যেতেই শুরু হয় দুই বাসের পাল্টাপাল্টি প্রতিযোগিতা। এ সময় একটি অ্যাম্বুলেন্স পেছন থেকে সাইরেন বাজিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বাস দুটি তাদের গতিতেই যাচ্ছিল। ট্রাফিক সপ্তাহের মতো এমন একটি সময়ে এই সড়কটিতে কোনো পুলিশের দেখা মেলেনি। কুড়িল বিশ্বরোডের পরের স্টপেজ বসুন্ধরা গেট। এখানেও একই হাল। অনাবিল, ছালছাবিল, তুরাগ, সুপ্রভাত সব এলোমেলোভাবে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামায় ব্যস্ত দেখা যায়। এই স্টপেজটিতে দুজন ট্রাফিক পুলিশ দেখা গেলেও সেদিকে তাদের নজর নেই। তারা অন্য গাড়ির লাইসেন্স দেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আন্দোলনচলাকালীন শিক্ষার্থীরা রিকশার চলাচলের জন্য যে আলাদা লেন রয়েছে সেটার সঠিক ব্যবহার দেখানোর পরও তা কোনোভাবে মানতে দেখা যায়নি রিকশা চালকদের। প্রগতি সরণির বসুন্ধরার এই সড়কটিতে দেখা যায়, রিকশাচালকরা যেখানে ফাঁকা পাচ্ছেন সেই পথেই চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে ট্রাফিক আইন অনুযায়ী, মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও অনেক মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে থাকা অন্য আরোহীর হেলমেট ছিল না। এনিয়ে কোনো তৎপরতাও দেখা যায়নি ট্রাফিক পুলিশদের। তবে যাদের কাগজপত্রে সমস্যা তাদের আটক করে মামলা দিতে দেখা গেছে। ট্রাফিক আইন মানার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি বসুন্ধরার পরের স্টপেজ নতুন বাজারেও। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সড়কে যেমন ইচ্ছে তেমন যান চলাচল চলছে। কেউ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কাই করছেন না। এমনকি সাধারণ পথচারীর জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাথ ও রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভার ব্রিজের ব্যবস্থা থাকলেও অনেকেই সেসব ব্যবহার করছেন না। আরিফুল নামের এক পথচারীকে ফুটপাথ ব্যবহার না করে মূল সড়ক দিয়ে হাঁটছিলেন। কেন নিয়ম না মেনে হাঁটছিলেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই দেশে আইন কে মানে? দেখেন আরো কতজন ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। কেউ নিয়মের মধ্যে আসতে চায় না। একই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে উত্তরবাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, রামপুরা ব্রিজ ও রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকায়। রামপুরা টেলিভিশন ভবনের উল্টো পাশে বেশ কিছু গাড়ি অবৈধভাবে পার্ক করে রাখা হয়েছে। সে গাড়িগুলোর জন্য কিছুক্ষণ পরপরই রাস্তায় জটলা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। তবে সেখানে যে কয়টি প্রাইভেট কার পার্ক করা ছিল তার চেয়ে বেশি রামপুরা-কাওরান বাজারে আসা যাওয়ার মাইক্রোবাস। একটির পর একটি মাইক্রোবাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। এ নিয়ে এলাকাবাসী ও সাধারণ পথচারীরা প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সূত্রে জানা গেছে, রামপুরা, হাতিরঝিল ও কাওরানবাজারের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং এসব এলাকায় মোট ছয়টি থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মাইক্রোবাসগুলো চলাচল করে। যেগুলোর কোনোটিরই ফিটনেস, লাইসেন্স কিছুই নেই। নেই চালকদেরও লাইসেন্স। এদিকে সড়কের এই বিশৃঙ্খল অবস্থা, অনিয়ম দেখা যায় রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকায় এসেও। এখানে বড় একটি ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্ট হলো সোনার গাঁও সিগন্যাল। তার কিছুটা দূরে এলে আন্ডারপাসের ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণ পথচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিগন্যালে হাত দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পারাপার হন। এ দৃশ্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আগে যেমন ছিল এখনো তা-ই আছে। এছাড়া সোনারগাঁও সিগন্যাল থেকে কিছুটা এগিয়ে ওয়াসা ভবনের কাছাকাছি এলে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন পথচারী ডিভাইডারের ওপর তারকাঁটার বেড়া ভেঙে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। কিন্তু কিছুটা সামনে গেলেই একটি ফুট ওভারব্রিজ ছিল। এ রাস্তাটিতে ঘুরে আরো দেখা যায়, বাসগুলো একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমনি চালাচ্ছেন চালকরা। আবার পথচারীদের জন্য ব্যবহৃত ফুটপাথে চলছে মোটরসাইকেলও। সড়কটিতে গতকাল সারাদিন কোনো ট্রাফিক পুলিশের দেখা মেলেনি। অবশ্য ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট সবাই থাকলেও আইন ভঙ্গ করার দায়ে কোনো বাসচালক অন্য যানবাহনের চালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে কিছুটা পরিবর্তন শাহবাগ পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়। সেখানে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশ স্কাউটের ছেলে মেয়েরা কাজ করছে। তারা সিগন্যালে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সাধারণ পথচারীদের আইন মেনে পথচলায় উদ্বুদ্ধ করছেন। এর মধ্যেও শাহবাগ থেকে কাওরানবাজারগামী এক মোটরসাইকেল চালক দ্রুত যাওয়ার জন্য সিগন্যাল অমান্য করে বেরিয়ে যান। এর আগে অবশ্য দুইবার যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে বাধা প্রয়োগ করেন স্কাউটের সদস্যরা। কিন্তু তৃতীয়বার ওই মোটরসাইকেল চালক আর ট্রাফিক আইন মানলেন না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর ট্রাফিক ব্যবস্থায় বদলাতে দেখা যায়নি মতিঝিল, আরামবাগ, উত্তরা, বনানী, ধানমন্ডি, সাত মসজিদ রোডসহ শহরের অন্য এলাকাগুলোতেও। এদিকে ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে টনক নড়ে ওঠা ট্রাফিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহের অংশ হিসেবে গত চারদিনে ৩০ হাজারেরও বেশি আইন ভঙ্গের দায়ে মামলা হয়েছে। একই সঙ্গে দেড় কোটি টাকারও বেশি জরিমানা করেছে পুলিশ।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=129926