জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস
৯ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৭

বেপরোয়া চালকদের দৌরাত্ম্য থামছে না

নিয়ন্ত্রণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ * মোটরসাইকেল চালকরাও বেপরোয়া * শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা

ঢাকার রাজপথে বেপরোয়া বাস চালকদের দৌরাত্ম্য থামছে না। তাদের থামানোর যেন কেউ নেই। শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের কয়েক দিন রাজধানীতে নিয়ম মেনে গণপরিবহন চললেও এখন সেই আগের অবস্থা। আবারও গণপরিবহন চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা স্বভাবগত ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।
ট্রাফিক সপ্তাহ চলার মধ্যেই চলছে এ ভয়ানক প্রতিযোগিতা। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানো হচ্ছে। আগের চেহারায় ফিরে গেছে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো। এদিকে, রাজধানীর সড়ক-মহাসড়কসহ অলি-গলিতে মোটরসাইকেল চালকরাও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সুযোগ পেলেই আইন অমান্য করে ফুটপাত দিয়ে বাইক চালাতে শুরু করেন বেপরোয়া চালকরা। এতে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় অনেকে আহত হচ্ছেন। ফুটপাত দিয়ে চলা পথচারীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অনেক সময় নিয়ন্ত্রহীনভাবে চালাতে গিয়ে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী আহত হন। এতে তাদেরও প্রাণ যাচ্ছে।
বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, বাসচালক থেকে শুরু করে রিকশাচালকরা বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালাচ্ছেন। কার আগে কে যাবে, কে আগে যাত্রী তুলবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ তৎপর হলেও চালকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগ চৌরাস্তায় আগের চিত্র ফুটে উঠে। সিগন্যাল না দিতেই চালকরা বাস চালাতে তড়িঘড়ি শুরু করে দেন। সিগন্যাল ছাড়ামাত্র মিনিট খানেকের মধ্যেই কে আগে গিয়ে বেশি যাত্রী উঠাবেন সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন তারা। তাড়াহুড়ো করে বাস চালাতে গিয়ে বাসের সঙ্গে বাসের ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। এ নিয়ে হেলপাররা পরস্পরকে গালাগাল করেন। এরই মধ্যে আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসে উঠছিলেন যাত্রীরা।

সিএস লাবণী বাসের এক চালক জানান, সব কিছু আগের মতো চলছে। প্রতিদিন নির্ধারিত টাকা দিতে হচ্ছে বাস মালিককে। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা যে কোনো প্রতিকূলতার মধ্যেও মালিককে নির্ধারিত টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়। এ কারণে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তাদের গাড়ি চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যত ট্রিপ তত টাকা। আগে যেতে পারলেই বেশি যাত্রী পাওয়া যায়। কারণ বেশি যাত্রী বেশি টাকা।
শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী রোজিনা আক্তার জানান, কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, চালকরা যেভাবে গাড়ি দাঁড় করান তাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বাসে উঠতে হয়। স্কুল পোশাক পরা বেশ কয়েক জন শিক্ষার্থী জানায়, আগেও ঝুঁকি নিয়ে গণপরিবহনে উঠতে হতো। আর আন্দোলনের পর এখন বাসে উঠতেই ভয় করে। চালক ও হেলপাররা বাঁকা চোখে তাকায়। হেলপাররা মাঝেমধ্যে তুই-তোকারি ব্যবহার করে।
দুপুর ২টার দিকে কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার চৌরাস্তায় দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে রোভার স্কাউট সদস্যরা সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এ মোড়ে ট্রাফিক ও থানা পুলিশের সঙ্গে প্রায় ১৫ জন রোভার স্কাউট সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, বাসের কোনো চালকই ট্রাফিক আইন মানছেন না। সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই তারা ভয়ংকর হয়ে উঠছিলেন। সামনে কার আগে কে যাবেন ও যাত্রী তুলবেন এমন প্রতিযোগিতায় এলোপাতাড়ি তারা বাস চালানো শুরু করেন। বিআরটিসি বাসগুলোর চালকদের বেপরোয়া ভাব ছিল একটু বেশি। চৌরাস্তায় যাতায়াতের নির্ধারিত জেব্রাক্রসিং থাকলেও পথচারীরা সড়ক পার হচ্ছিলেন ইচ্ছেমতো। জেব্রাক্রসিংয়ের ওপর যত্রতত্র গাড়িও দাঁড়িয়েছিল।

সার্ক ফোয়ারায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট রইচ উদ্দিন যুগান্তরকে জানান, মিডিয়া কর্মীরা দেখুক চালকরা কি করে গাড়ি চালাচ্ছেন। আইন দিয়ে তাদের কিছু করা যাবে না। তিনি বলেন, বোরাক টাওয়ার বরাবর বাস দাঁড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও বেপরোয়া চালকরা চৌরাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী তুলছেন। অপর একজন সার্জেন্ট জানান, শত চেষ্টা করেও এমন অনিয়ম রোধ করতে পারছি না।
রোভার স্কাউট সদস্য কামরুজ্জামান জানান, এ মোড়ে তারা ১৫ জন দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো অবস্থাতেই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। বাস কিংবা বাসের চালককে তো পিটিয়ে আইন মানানো সম্ভব নয়। রাস্তার পাশে পর্যাপ্ত জায়গাও নেই যে, বাস আটক করে রাখা যাবে। চালককে জরিমানা করা যাবে।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, প্রেস ক্লাব, মৎস্যভবন, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, ফার্মগেট, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, সায়েদাবাদ, মানিকনগর, কমলাপুর, মুগদা, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, বারিধারা ইত্যাদি এলাকার সড়কে ঘুরে বেপরোয়া বাস চলাচলের দৃশ্য দেখা যায়। রাস্তায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম হলেও চলছে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। যাত্রীদের ভাষ্য, কোনো চালকই আইন মানছে না। আগের স্টাইলেই চলছে গণপরিবহনগুলো।
গুলিস্তান এলাকায় নিউ ভিশনের বাস চালক বলেন, রাজধানীতে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই বাস চালাতে হয়। প্রতিযোগিতা ছাড়া এখানে টিকে থাকা যায় না। স্পেশাল সার্ভিসের এক হেলপার জানান, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এখন আমাদের বাসে চড়ছে। অথচ তাদের জন্য আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ৫-৬ দিন বাস চালাতে পারিনি। এ সময় এ হেলপারের চোখেমুখে আক্রোশের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠে।
মানিকনগর সড়কে বাস চালক সিরাজুল ইসলাম জানান, রেসিংয়ের মধ্য দিয়েই রাজধানীতে বাস চালাতে হচ্ছে। সিরিয়ালের গাড়ি হলেও অন্য গাড়িকে পেছনে ফেলতে না পারলে অতিরিক্ত টাকা রোজগার করা যায় না। ফলে একটি বাস আরেকটির সঙ্গে গা ঘেঁষে চলছে। তিনি বলেন, কোনোটি খানিক চাপ দিলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যাত্রী উঠা-নামার সময় একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে সাইড না দেয়ার ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। ওই সময় কেউ কেউ গুরুতর আহত হন। আবার কারও কারও প্রাণ যায়। ভয়ডরহীনভাবেই এসব কথা বলেন বিহঙ্গ পরিবহন বাসের এক চালক।

এক পরিবহন নেতা বলেন, পরিবহন মালিকরা খুবই প্রভাবশালী। অধিকাংশ চালক রোজভিত্তিতে গাড়ি চালান। এ কারণে বেশি টাকা তুলতে চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এছাড়া শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাব তো আছেই। প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে তাদের মধ্যে সচেতনতাবোধটাও কম। তিনি বলেন, হাজার হাজার চালকের জাল লাইসেন্স থাকলেও কাউকে আইনের আওতায় আনা হয় না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, চুক্তিতে বাস চালাতে দেয়ার কারণেও দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে কোনো অবস্থাতেই চুক্তিতে বাস চালাতে দেয়া হবে না। এ সিদ্ধান্ত কোনো মালিক অবজ্ঞা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বাসচালকরা কাউকেই মানছে না। এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে গাড়ি চালাচ্ছেন। চাকায় পিষ্ট হয়ে কিংবা ধাক্কায় কেউ আহত হলে বা মরলেও তা দেখার সময় তাদের নেই। তিনি বলেন, আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন যুগান্তরকে জানান, চালকরা আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। পুরো সড়ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে ভয়ংকর দুর্ঘটনা আরও ঘটতে পারে। শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে রাজধানীতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন সিস্টেম করতে হবে যাতে কোনো অবস্থাতেই সিরিয়াল ব্রেক করে কোনো বাস ওভারটেক করতে না পারে।

সড়কে যাতায়াত করতে গিয়ে এখন শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। আইইউবিএটি ইউনিভার্সিটির ছাত্র হাসনাত জানান, সাধারণ ছাত্ররা ৯ দফা দাবি নিয়ে অহিংস আন্দোলন করেছি। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরির শিক্ষার্থী সোনিয়া হক জানান, এখন রাস্তা পার হতে অনেক ভয় করে। শরীর কাঁপতে থাকে। কখন যে বেপরোয়া চালক প্রাণটা কেড়ে নেয়।
দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী মো. কামরুল ইসলাম বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পরও আমরা স্বস্তিতে নেই। বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান বলেন, সড়কে চলতে গিয়ে এখনও আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়ছি। ওভারটেকিং করাসহ মাঝপথেও যত্রতত্র বাস থামানো হচ্ছে।
নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী মো. শামীম হোসেন বলেন, কোনোভাবেই যাতে অল্পবয়স্ক ও মাদকসেবী চালক যানবাহনে চালাতে না পারেন। এজন্য ট্রাফিক পুলিশসহ হাইওয়ে পুলিশের তদারকি জোরদার করতে হবে। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী বলেন, এত কিছুর পরও সড়কে চালকদের বেপরোয়া ভাব কমেনি। কমেনি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ সড়ক শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, সারা দেশেও করতে হবে।

রাজধানীর সড়ক-মহাসড়কসহ অলি-গলিতেও মোটরসাইকেল চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। অনেক সময় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাইক চালাতে গিয়ে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীও প্রাণ হারান। বেপরোয়া বাইক চালকরা সুযোগ পেলেই আইন অমান্য করে ফুটপাত দিয়ে বাইক চালাতে শুরু করেন। এতে করে প্রায় সময় ফুটপাত দিয়ে চলা পথচারীরা আহত হন।
ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানীতে অধিকাংশ বাইক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আবার রেজিস্ট্রেশন থাকলেও অনেকের মেয়াদোত্তীর্ণ। এক শ্রেণীর উঠতি বয়সী বাইক চালক প্রতিযোগিতামূলক চালাতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/78588