৯ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৭

দৃশ্যপটে সড়ক : সমস্যা আসলে সুশাসনের

এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! সড়ক ব্যবস্থাপনায় রাজধানীতে নেমেছে কিশোর-কিশোরীরা। তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র তল্লাশি করছে। গাড়ি চালনায় লেন অনুসরণের নির্দেশনা দিচ্ছে। তল্লাশিকালে লক্ষ্য করা গেছে, অনেক বড় বড় রথী-মহারথী গাড়ির কাগজ দেখাতে সমর্থ হননি, অনেকের ড্রাইভারের লাইসেন্স নেই। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন সেই পুলিশেরও গাড়ির কাগজ নেই, চালকের লাইসেন্সও নেই।
গত কয়দিনে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় যে চিত্র লক্ষ্য করা গেছে তাতে উপলব্ধি করা যায়, দেশে সুশাসন তথা আইনের শাসনের অবস্থা কতটা করুণ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা যে আন্দোলনে নেমেছে তার দীর্ঘ প্রেক্ষাপট রয়েছে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছাত্রদের আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, সড়ক নিরাপদ নেই। যাত্রী মেরে পানিতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ দু’জন শিক্ষার্থীকে বাস চাপা দিল। সড়ক নিরাপদ ছিল না- এই বিষয়টি অনেকদিন চাপা পড়ে ছিল। শিক্ষার্থীরা সবার সামনে বিষয়টি নিয়ে এসেছে। দুর্ঘটনার খবরে মন্ত্রীরা যখন মুখে হাসি এনে কথা বলেন, তখন এটা পরিষ্কার হয় যে, রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় কোনো জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতা নেই পুলিশেরও! পুলিশের সদস্যরা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন না। অন্যদিকে দুর্ঘটনায় পুলিশের আয় বাড়ে। রাষ্ট্র ও পুলিশের জবাবদিহিতা না থাকার প্রভাব পড়ে চালকের ওপর। একসময় শ্রমিক নেতা মালিক হয়। এখন মালিকেরাই রাষ্ট্র ক্ষমতায়। অদক্ষতা ও নৈরাজ্য জায়গা করে নিয়েছে সবখানে। সড়কে ট্রাফিক বাতি কোনো কাজে লাগে নাÑ এই অভিজ্ঞতা নগরবাসীর আছে। শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সড়ক পথে চলছে অরাজকতা। একদিকে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এই দুইয়ে মিলে আমাদের সড়ক-মহাসড়ক অনিরাপদ করে তুলেছে। সারাদেশে এখন ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। আর প্রায় ৯ লাখ যানবাহন চালাচ্ছেন ভূয়া বা অদক্ষ চালক। হাইকোর্টের নির্দেশনা ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ সত্ত্বেও অদক্ষ চালকের দৌরাত্ম্য কমছে না। ত্রুটিপূর্ণ যান ও ভুযা চালকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছেই। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩শ’ ৯৭ জন। আহত হয়েছেন ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০১৫ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং ভুয়া লাইসেন্স জব্দ করার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্দেশ দেন। এরপরও কাজ হচ্ছে না। আন্দোলনত শিক্ষার্থীরা কয়েকদিন ধরে চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই করছে। এর ফলে রাজধানী ঢাকায় যানবাহন চলাচল কমে গেছে। বাস চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর বড় কারণ চালকের লাইসেন্স ও ফিটনেছ সনদ হাল নাগাদ না থাকা। প্রশ্ন জাগে, এসব কাজের তল্লাশিতে কিশোর-কিশোরীদের নামতে হলো কেন? আমাদের সরকার কোথায়, প্রশাসন কোথায়?
জাতীয় পত্র-পত্রিকায় এখন নিরাপদ সড়কের বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠেছে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। পরিবহণ খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে বাংলাদেশের কিশোর শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে বিশ্বের ইতিহাসে তার নজির মিলবে না। তারা আঙ্গুল দিয়ে আমাদের অনেক কিছুই দেখিয়ে দিয়েছে। তারা যা দেখিয়েছে তা সবই সত্য, সেখানে কোন ব্লেমগেম বা মিথ্যে নেই। এখন প্রশ্ন হলো, উদ্ভূত এই পরিস্থিতি থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে সমর্থ হবো? করণীয় কি ঠিক করতে পারবো? শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পক্ষ থেকে কিছু দাবি তুলে ধরেছে। দেশের শিক্ষাবিদরা এবং সরকারপক্ষের লোকজনসহ প্রশাসকরাও শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার ও কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিকতভাবে অগ্রসর হয়।

আমরা দেখেছি, সরকারের তরফ থেকে মেযন শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোকে যৌক্তিক হিসেবে স্বীকার করে তা পূরণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে, তেমনি ডিএমপি কমিশনার নিজেও স্বীকার করেছেন যে, তাদের অনেক ঘাটতি ও ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে। তিনি আরো স্বীকার করেছেন যে, যেভাবে এত দিন চলছিল সেভাবে আর চরতে পারে না। তাহলে এখন তো পরিস্থিতি পরিবর্তনের মূল দায়িত্ব এসে পড়ে সরকার ও প্রশাসনের কাঁধে। তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ছাত্রদের সড়ক ছেড়ে বাড়ি ফেরার পথ তৈরি হতে পারে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পাশাপাশি লক্ষ্য করা গেছে প্রতিশোধের ধর্মঘট। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে শ্রমিকদের রাস্তায় নামানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারা বেআইনিভাবে অঘোষিত ধর্মঘটের পথ বেছে নেয়। তাদের প্রতিশোধের এই ধর্মঘটে সারা দেশের মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। অতীতেও পরিবহণ, মালিক-শ্রমিকরা ঘোষণা ছাড়া ধর্মঘট ডেকে দেশের মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছিল। অথচ মোটরযান আইন ও শ্রম আইনে এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। উল্লেখ্য যে, পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আছেন সরকারের দুই মন্ত্রী ও এক নেতা। মূলত তারাই পরিবহণ খাতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। অঘোষিত ধর্মঘটেও তাদের ইশারা ছিল বলে পত্রিকায় খবর মুদ্রিত হয়েছে। অবশ্য তাদের এই পরিকল্পনায় সরকারের সায় না থাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছে। এখন সরকারের উচিত ক্ষমতা ও দলের স্বার্থের চাইতেও দেশের স্বার্থকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া। সময়ের এই চাহিদা সরকার কতটা পূরণ করতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

৬ আগস্ট তারিখে প্রথম আলো পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘পুলিশ পাহারায় ছাত্রলীগের হামলা’। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষার্থীদের বিশাল জমায়েতে এলোপাতাড়ি হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই হামলা চালানো হয় পুলিশ পাহারায়। পুলিশ পেছন থেকে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে। আর সামনে এগিয়ে এসে আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাদের হাতে ছিল লাঠি-রড-রামদা-চ্যালা কাঠ। আর পরিচয় লুকাতে মাথায় ছিল হেলমেট। শিক্ষার্থী ছাড়াও কর্তব্যরত সাংবাদিকদের খুঁজে খুঁজে নির্মমভাবে পিটিয়েছে তারা। এমনকি নারী চিকিৎসক, বৃদ্ধ পথচারীও রেহাই পাননি। বিভিন্ন ভবনের ওপর বা ভেতর থেকে যারাই মুঠোফোনে হামলাকারীদের ছবি তুলেছেন, দেখামাত্র তারাও মারধরের শিকার হয়েছেন। ৫ আগস্ট রোববার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় পুলিশের পাহারায় করা এই হামলায় অংশ নেয় ছাত্রলীগের কয়েকশত নেতা-কর্মী। এতে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছেন সাংবাদিকরা। লাঠিসোঁটা, রড ও রামদা দিয়ে তাদের বেধড়ক আঘাত করা হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গাড়ি। খোঁজা হয়েছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিকদের।

পুলিশ পাহারায় শিক্ষার্থীদের বিশাল সমাবেশে ছাত্রলীগের নির্মম হামলার খবর মোটেও ভাল খবর নয়। সন্ত্রাসী এমন হামলায় ফ্যাসিবাদের ধমক লক্ষ্য করা গেলেও কোনো সুষ্ঠু সমাধানের আভাস পাওয়া যায় না। আর হাতাশা ও লজ্জার বিষয় হলো, ছাত্রলীগ হামলাটি চালিয়েছে পুলিশের ছত্রছায়ায়। দেশের সরকার ও পুলিশ প্রশাসন দেশ পরিচালনার এ কেমন নজির স্থাপন করলেন? ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও সরকারদলীয় সংগঠনের সদস্যদের হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্নস্থানে ৫ আগস্ট রোববার মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশসহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা হামলাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে আন্দোলনরত শিশু-কিশোর ও তরুণদের নিরাপত্তা নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার উদ্বেগ বাড়ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করা তরুণদের ওপর নৃশংস হামলা আর সহিংসতাকে যৌক্তিক প্রমাণ করা যায় না। ঢাকায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং মার্কিন দূতাবাস ৫ আগস্ট রোববার তাদের ফেসবুক পেজে পৃথক বিবৃতিতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলন নিয়ে এসব মন্তব্য করেছে। আমরা আশা করবো বিষয়টির গভীরতা সরকার উপলব্ধি করবে। ভুল পথের বদলে সরকার যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত পথ অবলম্বন করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

http://www.dailysangram.com/post/341137