৮ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১০:৪৮

আসামি অজ্ঞাতনামায় আতঙ্ক

রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে গত শনিবার হামলার অভিযোগ এনে সোমবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডি থানায় দু’টি মামলা দায়ের করেন আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। দুই মামলাতেই অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। এতে অজানা আতঙ্কে আছেন শত শত শিক্ষার্থী ও অবিভাবক। ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা এক গৃহিনী বলেন, আমার মেয়ে ঢাকা সিটি কলেজে পড়ে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে সেও ছিল। শনিবারের ঘটনার সময় আমার মেয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া খেয়ে একটা বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরে তার বাবা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এ ঘটনার দুদিন পর ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামী করায় আতঙ্কে আছি। না জানি কখন নাম বসিয়ে ধরে নিয়ে যায়। ওই অবিভাবক বলেন, শুধু আমি একা না, আমার মতো বহু অবিভাবকই এরকম অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। আতঙ্কে অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গাড়ি ভাংচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার শাহবাগ থানায় আরও একটি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে গতকাল পর্যন্ত মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২টি। মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসাবে হাজার হাজার আসামী করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটকের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে গণমাধ্য ও সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, মামলা ও গ্রেফতারের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। অজ্ঞাতনামা হিসেবে মামলা দায়েরের পর চরম আতঙ্কে আছে শিক্ষার্থী ও তাদের অবিভাবকরা। অজ্ঞাতনামার স্থানে নাম বসিয়ে কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় এ আতঙ্কে অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্যাহ বলেন, আমি মনে করি শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক আন্দোলন করেছে। শুরুর দিকেও তাদের আন্দোলন অহিংস ছিল, শেষ দিকেও অহিংস ছিল। বরং বিভিন্ন ধরনের তৃতীয় শক্তি ঢুকে তাদেরকে সহিংস করে তুলেছে। এই তৃতীয় শক্তি কারা- তা দেশবাসী খুব ভালোই জানে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখ-কান খুলে দিয়েছে।

প্রবীণ এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, সহিংসতার অভিযোগ তুলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা হিসাবে যে সব মামলা দেয়া হয়েছে তাতে একটা ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থী এবং অবিভাবকদের মধ্যে এই ভয় কাজ করছে। আমি বলবো, যারা এই ভয় ও আতঙ্ক তৈরী করছেন তারা আবারও ভুল করছেন। এটা দেশের জন্য, সরকারের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। মামলা না দিয়ে বাচ্চাদের আদর সোহাগ দিয়ে অন্যভাবে ম্যানেজ করা যেতো।
জানা গেছে, গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই ছাত্রছাত্রীর প্রাণহানির পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ভাংচুর করা হয় বেশকিছু গাড়ি। এরপর টানা আটদিন ধরে সড়কে অবস্থান নেয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা লেন মেনে যান চলাচল করতে সাহায্য করে। একই সাথে রাস্তায় চলমান গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চালকের লাইসেন্স আছে কি না তা পরীক্ষা করতে থাকে। যাদের কাগজপত্র নেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে পুলিশকে বাধ্য করে। এভাবেই চলছিল গত কয়েক দিন ধরেই। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে মাথায় বাজ পড়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। তারা প্রতিশোদ নিতে সারাদেশের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। চতুর্থ দিন থেকে তারা শ্রমিকদের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া জাগায়। আন্দোলন চড়িয়ে পড়ে জেলা থেকে উপজেলা হয়ে একেবারে গ্রামে-গঞ্জে।

প্রথম দিকে শুধুমাত্র স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে যোগ দিলেও চতুর্থ দিন থেকে তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এর মধ্যেই গত শনি ও রবিবার ঢাকার ধানমন্ডিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। রবিবার শাহবাগে গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় একটি মামলা এবং ছয়জনকে আটক করা হয়। এর পর দিন থেকে ক্রমেই মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, গতকাল শাহবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলাসহ এ পর্যন্ত ৩২টি মামলা করা হয়েছে। ভাংচুর, হামলাসহ নানা অভিযোগে পুলিশের মিরপুর ও উত্তরা বিভাগে ৩টি করে, ওয়ারী বিভাগে ২টি, রমনা ও মতিঝিল বিভাগে ৬টি করে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া শাহবাগ, তেজগাঁও, লালবাগ ও গুলশান বিভাগে একটি করে মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ৩৪ জন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ছোট শিক্ষার্থীরা গাড়ি ভাংচুর, মারামারি করেনি। এখানে তৃতীয়পক্ষ ঢুকে ভাংচুর ও মারামারিসহ পুলিশের ওপর হামলা করেছে। সুতরাং ওইভাবে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া সংঘর্ষের সময় আটক অনেক শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে, রাজধানীর শাহবাগে গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা করেছে পুলিশ। শাহবাগ থানার এসআই রমজান রাতেই মামলাটি করেন বলে ওসি আবুল হাসান জানান। তিনি বলেন, সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশকে গুরুতর আহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামি কারো নাম ও সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।

জানা গেছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদী মিছিলে বাধা পেয়ে গত সোমবার বিকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টার পর প্রায় ২০ মিনিট ধরে এই সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন বলে শিক্ষার্থীদের ভাষ্য। এই ঘটনায় ইটের আঘাতে পুলিশের এক সদস্য রক্তাক্ত আহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, পিকেটারের ইটের আঘাতে ইমানুল নামে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনায় সময় ছয়জনকে আটক করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে ওসি জানান। তবে পুলিশের করা মামলা নিয়ে অনেকেই আতঙ্কে আছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ১০টি থানায় দায়ের করা মামলাগুলোতে হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে গ্রেফফতার দেখানো হয়েছে গণমাধ্য ও সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে।
এদিকে, আট দিনের টানা আন্দোলনে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে গত দুদিনে শুধু সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও ঝিগাতলাতেই দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে আন্দোলনের খবর সংগ্রহকালে ধানমন্ডি এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৫ সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, শনিবার ধানমন্ডি থানায় করা একটি মামলায় ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পরে রোববার এ থানায় আরও দুটি মামলা করা হয়েছে, যাতে ৭৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা এসব মামলা শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে জানিয়ে রামপুরার এক অবিভাবক বলেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের এভাবে আতঙ্কে রাখা ঠিক হয়নি। তাদের চেয়ে আমরা যারা অবিভাবক তারা আরও বেশি আতঙ্কে আছি।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ৫৭ শিক্ষার্থীকে আটকের ২৪ ঘণ্টা পর অবিভাবকদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে আটক শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটি ও সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থী বাড্ডা আফতাব নগরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। হাতিরঝিল এলাকায় সড়কে পুলিশের ওপর তারা চড়াও হয়। ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। পরে সেখান থেকে ৫৭ জনকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৫ জন নারী শিক্ষার্থী।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আটকরা সকলেই শিক্ষার্থী হওয়ায় এবং ভবিষ্যত জীবন নষ্ট হবে ভেবে তাদের অবিভাবকদের খবর দেওয়া হয়। অবিভাবকরা এসে মুচলেকা দিয়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে যান। ওই কর্মকর্তা বলেন, এরপর এ ধরণের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে দেখলে অবিভাবকদের না জানিয়েই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মুচলেকা দেওয়া অবিভাবক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ছেলেকে থানায় ২৪ ঘণ্টা আটক রাখার পর অঙ্গীকার নামা দিয়ে ছাড়িড়ে নিলাম। রাতে ছেলের চিন্তায় ওর মা ও আমি ঘুমাইনি। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও অনেকে জেগেই ছিল। মুচলেকায় কী লেখা ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে ধরণের অপরাধে ৫৭ জনকে আটক করা হয়েছে। পরবর্তীতে এরকম কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে অবিভাবকরা আর তদবির করতে থানায় আসবেন না বলে লিখে নিয়েছেন। খালেদুজ্জামান নামে এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের যখন আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয় তখন নারী পুলিশ কেউ ছিলেন না। পুরুষ পুলিশ দিয়েই টেনে থানায় নিয়ে আসা হয়। রাতে তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়নি। ছাড়া পেয়ে সাদিয়া আফরিন দোলা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, রাতে খেতে দেয়নি। মশার কামড়ে অনেক কষ্ট হয়েছে। কোন দোষ করিনি, তারপরেও ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল। পুলিশ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে বলেও অভিযোগ করেন ছাড়া পাওয়া শিক্ষার্থীরা।
আলাপকালে আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজন বলেছেন, মামলা হওয়ার পর তারা স্কুল কলেজে যেতে ভয় পাচ্ছেন। আবার সন্তানদেরকে পাঠাতে অবিভাবকরাও ভয় পাচ্ছেন। এজন্য গত কয়েক দিনে স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। কয়েকজন অবিভাবক বলেন, সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভরসা পাচ্ছেন না তারা। যে অভিভাবকরা সাহস করে সন্তানকে পাঠাচ্ছেন, তারাও সন্তান ঘরে না ফেরা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকছেন।
স্কুল-কলেজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। গতকাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় হোস্টেলগুলোতে পুলিশ তল্লাশী চালিয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানায়, এরই মধ্যে ভয়ে আতঙ্কে অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। ঈদের আগে তারা হয়তো আর ফিরবে না। ##

https://www.dailyinqilab.com/article/146482