৮ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১০:৪৬

সড়কে গাড়ি কম ভিড় বিআরটিএতে

‘নিরাপদ সড়ক’ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে বন্ধ হয়ে যাওয়া গণপরিবহনের বেশিরভাগ বাস আর সড়কে নামছে না। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও মালামাল বহনকারী যানবাহন কমেছে সড়কে। রাস্তায় যানবাহন কম হলেও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির কার্যালয়ে যানবাহন ও চালকের লাইসেন্স আবেদনের হিড়িক পড়েছে। গাড়ির ফিটনেস সনদ নেয়ার জন্য সেখানে যানবাহনের ভিড় হচ্ছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। চাপ বাড়ায় সেখানে বেড়েছে দালালের দৌরাত্ম্য। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবি মেনে নেয়ার পর সরকারি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের ছয়দিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বিআরটিএ কার্যালয় খোলা রাখার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ঠুনকো অজুহাতে সারা দেশে অঘোষিত ধর্মঘটে বন্ধ হয়ে যাওয়া গণপরিবহনের বেশিরভাগই গতকাল পর্যন্ত সড়কে নামেনি। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ যানবাহনের লাইসেন্স, ফিটনেস বা চালকের লাইসেন্স না থাকায় এগুলো সড়কে নামছে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই তড়িঘড়ি করে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হওয়ায় আটকের ভয়ে অনেকে এসব যানবাহন সড়কে নামাচ্ছেন না। যানবাহন কম হওয়ায় যারা নিয়মিত বাসে যাতায়াত করেন তাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন রুটে চলা বাসের ২০ থেকে ৫০ ভাগের মতো চলাচল করছে। তাই সড়কে বাস থাকলেও যাত্রীদের তাতে উঠার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার অনেক সময় গাদাগাদি করে চলাচল করতে হচ্ছে। সড়কে যানবাহন কম থাকায় গত দুইদিন প্রধান প্রধান সড়কে যানজটও দেখা যায়নি খুব একটা।

রাজধানীর গণপরিবহনের ৯০ শতাংশেরই কাগজপত্র ঠিক নাই বলে মনে করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক মানবজমিনকে বলেন, ঘোষণা দিয়ে অভিযান চালালে কাগজপত্র ঠিক নেই এবং ফিটনেসহীন গাড়ি অভিযানের সময় তো বের করবে না। যখন পুলিশের অভিযান শেষ হয়ে যাবে তখন বের করবে গাড়ি। আর এতে জনগণ ভোগান্তির শিকার হন। কাজের কাজ কিছুই হয় না। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি বুঝতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে অভিযান পরিচালনা করে না। তারা সারাবছর ধরে দেখভাল করে। এটা অভিযানসর্বস্ব কাজ হলে চলবে না। লোক দেখানো হলে কিছুই হবে না। আমাদের সংশোধন হতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জামেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, রাজধানীতে যেসব গণপরিবহন চলাচল করে তার ৯০ শতাংশের কাগজপত্র ঠিক নেই। এসব গাড়ি পুলিশকে ম্যানেজ করে সড়কে চলে। এখন ট্রাফিক পুলিশের সপ্তাহ চলছে। ফলে ওইসব গাড়ি রাস্তায় নামাতে ভয় পাচ্ছে। আমরা জনগণ গণপরিবহনের সংকটে ভুগছি। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ির ১০ শতাংশের কাগজপত্র ঠিক না। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা ও নগর বাস টার্মিনাল বাস মালিকদের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, অনেক গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই। এজন্য গাড়ি নামাতে মালিকরা ভয় পাচ্ছেন। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে গাড়ি চেক করছেন। এজন্যও অনেকে গাড়ি নামাচ্ছেন না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর গত সোমবার সকাল থেকে রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু হয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গণপরিবহন সংকটে গতকালও অফিস ও বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। সকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। বাসস্ট্যান্ডে একটি বাস আসলেই সবাই হুড়োহুড়ি করে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। অপরদিকে বাস সংকটে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও রিকশাচালকদের পোয়াবারো। গতকালও কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দাবি করছেন তারা। বাস বা অন্য যানবাহন না পেয়ে অনেকে হেঁটেই গন্তব্যে রওয়ানা দিয়েছেন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী মানবজমিনকে বলেন, ফিটনেস না থাকলে গাড়ি তো রাস্তায় ভয়ে নামাবে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং অভিযানের কারণে কাগজপত্র ঠিক করতে মানুষের তৎপরতা বেড়েছে।

বিআরটিএতে ভিড়, আছে দালালের দৌরাত্ম্য: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটি)-এর মিরপুর কার্যালয়ে যানবাহন চালানোর কাগজপত্র, ফিটনেস, ড্রাইভিং, রুট পারমিট, মালিকানা পরিবর্তন ও নবায়ন সনদ নেয়ার আবেদনের হিড়িক পড়েছে। এতদিন স্বাভাবিক কার্যক্রম চললেও গত তিন চারদিন ধরে আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে অনেকগুণ। সমানতালে বেড়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য। এদিকে সোমবার থেকে বিআরটিএ’র কর্মঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, সপ্তাহে ছয়দিনই বিআরটিএ খোলা থাকবে। গত সপ্তাহে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনে নেমে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষা শুরুর পর টনক নড়ে প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশের। তারাও আটঘাট বেঁধে গাড়ির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শুরু করেন। এর প্রেক্ষিতে বিআরটিএ’র এ কার্যালয়ে ত্রুটিযুক্ত যানবাহনের কাগজ ঠিক করাতে ভিড় বেড়ে যায়। গতকাল সকাল ১১টায় বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়ের ভেতরে-বাইরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। গাড়ির দীর্ঘ সারি বিআরটিএ’র সমানের সড়ক থেকে ১৩ নম্বর ফুটওভার ব্রিজ ছাড়িয়ে যায়। ভেতরের প্রত্যেকটি বুথেই সেবা গ্রহীতাদের দীর্ঘ লাইন। এরমধ্যে গাড়ি চালানোর অনুমতি বা ড্রাইভিং লাইসেন্স আর বিভিন্ন যানবাহনের ফিটনেস নবায়নের জন্য সনদ নিতে যাওয়া লোকজনের সংখ্যাই ছিল বেশি। বিআরটিএ’র ভেতরে গাড়ির লাইনে দেখা যায় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, বিআরটিসির বাস এবং গণমাধ্যমের যানবাহন। আবদুর রশিদ। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পিকআপ ভ্যানের চালক। সোমবার এসে গাড়ির ফিটনেস নবায়নের টাকা জমা এবং কাগজপত্র ঠিক করে যান। গতকাল যান গাড়ি নিয়ে। ভোর পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে সিরিয়াল দেন। ঘড়ির কাঁটায় যখন দুপুর ১২টা তখন রাস্তা থেকে বিআরটিএ’র কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। তখনও তার সামনে শতাধিক গাড়ি রয়েছে। চালক আবদুর রশিদ মানবজমিনকে বলেন, খুব ভোরে এসে সিরিয়াল ধরেও বিআরটিএ’র ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিলাম না। আমি সিরিয়ালে থাকার পরেও গেট থেকে গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছিলো। এখানে আনসার সদস্যরা বাগড়া দেন। আমার কাছে সরাসরি টাকা না চাইলেও তাদের বাধা দেয়ার কারণ টাকাই ছিল। আমার গাড়ির ফিটনেস মেয়াদ ছিল। গত চারদিন আগে শেষ হয়েছে। এজন্য আবার করাতে আসছি।

মিরপুর-১ নম্বর থেকে বিআরটিএতে এসেছেন শামসুল আলম। কি কাজের জন্য এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার প্রাইভেটকারের ফিটনেস কাগজ নবায়ন করতে এসেছি। তবে সোমবার দুপুর থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা জমা দিতে পারেননি। আজ (গতকাল মঙ্গলবার) খুব ভোরে এসেছি টাকা জমা দিয়েছি। এবছর বাজেটে সরকার ফিটনেস ফি বাড়িয়েছে। ১৫ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। তারপরেও একদিনে কোনোভাবে কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। চিড়িয়াখানা রোডের আয়াত পরিবহনের চালক শাহজাহান এসেছেন গাড়ির ফিটনেস নিতে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, রাত তিনটায় এসে সিরিয়াল ধরেছেন। আর দুপুর সাড়ে ১২টায় বুথের সামনে এসে পৌঁছেছেন।

বিআরটিএতে একদিকে যেমন আবেদনের হিড়িক পড়েছে ঠিক তেমনিভাবে বেড়েছে দালালের সংখ্যা। বিআরটিএ ঘিরে রয়েছে দালালদের আনাগোনা, জটলা। বিআরটিএর গেটের সামনে এবং পাশের গলিতে তাদের জটলা দেখা যায়। নতুন গাড়ি আসলেই তার পিছুপিছু ছুটে। কারো হাতে আবার কাগজপত্রের ফাইল দেখলেই এগিয়ে যায়। জানতে চায় তাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা লাগবে কিনা। বিআরটিএ’র দ্বিতীয় ফটকের পাশে ৫/৬ জনের একটি দালালের দল জটলা করে বসেছিল। হঠাৎ একজনের হাতে কাগজ দেখে একজন তার কাছে জানতে চান কি কাজ করতে এসেছেন। এসময় তিনি কিছু দিলে যে কাজই হোক করে দিতে পারবেন বলে জানান। ওই ব্যক্তি কষাকষি করে দুই হাজার টাকা বেশি দিয়ে তার কাজটি দালালের মাধ্যমে করিয়ে নেন। সবুজ নামের আরেক দালালের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দিতে পারি এজন্য আমাকে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। আর ১৫ দিনের মধ্যে করতে পারি সে জন্য লাগবে ১৮ হাজার টাকা। সবুজের কাছে জানতে চাওয়া হয় কীভাবে দ্রুত একমাসের মধ্যে লাইসেন্স করিয়ে দেবেন। সবুজ জানান, বিআরটিএ’র ভেতরে লোক রয়েছে। মূলত তাদের এজেন্ট হয়েই কাজ করেন। তাদেরকে দেয়া হয় কমিশন। গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এটা করতে সময় লাগে। মালিকানা হস্তান্তর ফি ৩ হাজার ৬০০ টাকা। এসব করতে দালালরা দ্বিগুণ পর্যন্ত টাকা নিয়ে থাকে। দালালদের একটা দল ব্যাংকে দ্রত টাকা জমা দিয়ে দেন। এ জন্য তাদেরকে বাড়তি ৪০০/৫০০ টাকা দিতে হয়। সেবা নিতে আসা হাসান নামের একজন চালক বলেন, এখানে আমরা আনসার-দালালদের কাছে কাছে জিম্মি। বিআরটিএ সূত্র জানায়, গত ছয় দিনে বিআটিএর মিরপুর কার্যালয়ে নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়েছে দুই শতাধিকের উপরে। আর নবায়নের জন্য প্রতিদিনই গড়ে একশ’র উপরে আবেদন জমা পড়ছে। তবে গাড়ির ফিটনেস নবায়ন ও নতুন ফিটনেস সনদ ও মালিকানা হস্তান্তরের আবেদনের সংখ্যা প্রতিদিন ৫ শতাধিকের উপরে পড়ছে। সহকারী পরিচালক নাসির উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, সময় বাড়ায় আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে

http://mzamin.com/article.php?mzamin=129762