৮ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১০:৪২

চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা!

অঘোষিত ধর্মঘট শেষ হলেও পুরোপুরি সচল হয়নি অপারেশনাল কার্যক্রম * বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন ব্যবসায়ীরা * বেড়েছে কনটেইনারজট

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘট সোমবার সকালে শেষ হলেও এখনও পুরোপুরি সচল হয়নি দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের ‘অপারেশনাল কার্যক্রম’। টানা চার দিনের এ আন্দোলনে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে সারা দেশে কোনো পণ্য পরিবহন হয়নি।
প্রায় দেড় দিন বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং ডেলিভারিও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। বন্দরে কনটেইনার পৌঁছাতে না পারায় রফতানি কনটেইনার না নিয়েই ছেড়ে যায় পাঁচটি বিদেশি জাহাজ। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরা।
এ নিয়ে গত তিন মাসে তিন দফায় চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের ওপর নেমে আসে আন্দোলনের ‘খড়গ’। এর আগে ট্রেইলর অপারেটররা বিভিন্ন দাবিতে দুই দফায় ধর্মঘট পালন করে। তখনও বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ থাকে। সর্বশেষ টানা তিন দিন অচল থাকার পর সোমবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি শুরু হয়েছে। তবে কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। কারণ এরই মধ্যে বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনারের চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্দরের যে সুনাম নষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে তা ফিরিয়ে আনাও দুরূহ বলে মন্তব্য করেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, আমদানি ও রফতানিকারক ও বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে সব ধরনের আন্দোলন তথা হরতাল-ধর্মঘট-অবরোধের আওতামুক্ত রাখা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর মাশুল গুনতে হবে জাতিকে।
কঠোর আইন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারা দেশে এবং সারা দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী পরিবাহিত সব ধরনের পণ্য ধর্মঘট-অবরোধের আওতামুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে পণ্য পরিবহন না হওয়ায় বন্দরের ভেতরে বেড়ে গেছে কনটেইনারের চাপ।
বন্দর সূত্রমতে, গত শনিবার যেখানে বন্দরে আমদানি ও রফতানি কনটেইনারের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৭১১ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভেলেন্ট ইউনিটস) সেখানে মঙ্গলবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৫০৭ টিইইউএস-এ। অর্থাৎ ২ হাজার ৭৯৬ টিইইউএস কনটেইনার বেড়ে গেছে। ধারণক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক কনটেইনার এ মুহূর্তে রয়েছে বন্দরে। জেটিতে খালাস কাজ ব্যাহত হওয়ায় বহির্নোঙর থেকে জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায় থাকা জাহাজের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায় বর্তমানে ২২টি জাহাজ রয়েছে বহির্নোঙরে।

শনিবার রাত ১২টা থেকে সারা দেশে শুরু হয় অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট যা শেষ হয় সোমবার সকালে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে এর দু’দিন আগে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল ছিল কম। পণ্যবাহী পরিবহন বিশেষ করে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি চলাচল না করায় এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে থাকে বন্দরে।
বন্দর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে অবস্থানরত তিনটি জাহাজ থেকে (বাল্ক কার্গো) পণ্য খালাস বন্ধ রাখতে হয়। যদিও ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর ওই তিন জাহাজে পণ্য খালাস ফের শুরু হয়েছে।

শনি ও রোববার প্রাইভেট আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) থেকে বন্দরে পৌঁছাতে না পারায় ১ হাজার ৬৯৮ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভেলেন্ট ইউনিটস) কনটেইনার রফতানি পণ্য জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। ৫টি জাহাজে এসব পণ্য নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সময়মতো বন্দরে না পৌঁছানোর কারণে এসব পণ্য না নিয়ে বন্দর ত্যাগ করে ওই ৫টি জাহাজ। এসব পণ্যের ৮০ ভাগই তৈরি পোশাক।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিজিএমইএ’র দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, কনটেইনারগুলো এখন অন্য জাহাজে ধাপে ধাপে গন্তব্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। তবে এগুলো বিদেশি ক্রেতাদের কাছে হয়তো সময়মতো পাঠানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে। এতে দেশীয় রফতানিকারকরা বিদেশি ক্রেতা হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে পোশাক শিল্প মালিকদের।

এ অবস্থাকে ক্ষতিকর আখ্যায়িত করে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গত রোববার পুরোদিন বন্দর থেকে আমদানি পণ্য পরিবহন হয়নি। একইভাবে রফতানি পণ্যও চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করতে পারেনি। তার আগেরদিনও পণ্য পরিবহন মারাÍকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় রকমের ক্ষতি। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতি হিসাব করা কঠিন।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবচেয়ে বড় অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেকের এমডি তরফদার রুহুল আমিন মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, চলমান আন্দোলন ও অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের কারণে একটানা ১৪ ঘণ্টা বলতে গেলে ‘ডেডলক’ ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। এই ১৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫০০ কনটেইনার ডেলিভারি দিতে পারেননি তারা। এ কারণে কনটেইনার লোডিং-আনলোডিংয়ের সিডিউল পিছিয়ে গেছে। কনটেইনার না নিয়েই ফিরে গেছে বিদেশি জাহাজ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরা।
তিনি আরও বলেন, এর আগে লরি মালিকরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট করে দুই দফায়। অর্থাৎ গত তিন মাসে তিন দফায় চট্টগ্রাম বন্দর আন্দোলনের খড়গের নিচে পড়ে। এতে ‘রক্তাক্ত’ হয়েছে দেশের অর্থনীতি। এক ঘণ্টার জন্যও যাতে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ না হয়, বন্দর থেকে পরিবাহিত সব পণ্য যাতে যে কোনো ধরনের হরতাল-ধর্মঘট বা অবরোধের আওতার বাইরে থাকে সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আইন করে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে টার্মিনাল অপারেটররাও সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছেন। এটি করতে হবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘দেড় দিনের ধর্মঘটে ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কয়েকশ’ কোটি টাকা হবে। সময়মতো পণ্য রফতানি করা যায়নি। এ ছাড়া আমদানি করা শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আটকে গেছে বন্দরে। পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও সবাই একসঙ্গে পণ্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে পণ্যবাহী গাড়ি মিলছে না। বন্দরের সামনে যানজটও লেগে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।’
বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী জানান, ধর্মঘটে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে তৈরি পোশাক খাত। রফতানি পণ্যের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক। এগুলো সময়মতো বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে না পারলে ইমেজ ক্ষুণ্ণ হবে। এতে গার্মেন্ট সেক্টর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) গোলাম ছরওয়ার যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজার ৮২০ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। তবে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে কনটেইনার হ্যান্ডলিং স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কমেছে। সোমবার ৪ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ধর্মঘটের কারণে বন্দর থেকে ডেলিভারি না হওয়ায় আমদানি কনটেইনারের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
তবে তা ধারণক্ষমতা এখনও অতিক্রম করেনি। আগে বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ছিল ৩৬ হাজার। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ইয়ার্ড চালু হওয়ায় ধারণক্ষমতা বেড়ে ৪৯ হাজার টিইইউএস হয়েছে।
তিনি জানান, পরিবহন ধর্মঘটের ধকল কাটিয়ে পণ্য হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি বছর পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ২০১৬ সালে এ বন্দরে ৭ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার টন কার্গো ও ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়।

গত বছর ৭ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার টন কার্গো ও ২৫ লাখ ৬৬ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে কনটেইনারে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং কার্গোয় ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ প্রবৃদ্ধি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় পণ্য হ্যান্ডলিং কাজ প্রায়ই গতি হারাচ্ছে।
কখনও বেড়ে যাচ্ছে বহির্নোঙরে জাহাজের জট, আবার কখনও দেখা দিচ্ছে কনটেইনারজট। গত প্রায় দেড় বছর ধরে এ অবস্থা চললেও গত ডিসেম্বর থেকে বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে জাহাজজট কমে আসে। বন্দরে পণ্য খালাসের জন্য বর্তমানে ১৮টি জেটি রয়েছে। জেটি স্বল্পতার কারণে পণ্য বোঝাই জাহাজকে বার্থিংয়ের জন্য অতিরিক্ত সময় অপেক্ষা করতে হয়। এ অবস্থায় হরতাল-ধর্মঘটের খড়গের নিচে বন্দর পড়লে বহির্বিশ্বে বন্দরের সুনাম যেমন নষ্ট হয়, তেমনি বন্দরের প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/78180