৭ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ১:৫৫

উদ্বেগ বাড়ছে অর্থনীতিতে

দীর্ঘ দশ বছর পর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সম্ভাব্য নির্বাচন হতে যাচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলোর আছে নানা জোর দাবি-দাওয়া। আগামি মাস বাদে অক্টোবরেই ঘোষণা হতে পারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক রীতি-কালচার ও ইতিহাসের কারণে আগামি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে বোদ্ধাজনদের মধ্যে। কারণ, বিরোধী জোটগুলো বেশকিছু শক্ত দাবি নিয়ে সরব থাকলেও এসব দাবির বিষয়ে সায় নেই সরকারি দলের। এই বাস্তবতার মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ একের পর এক অরাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে দেশ অস্থির হয়ে পড়ছে; এমনকি পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ার চিত্রও দেখা গেছে গত এক সপ্তাহের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনে। এই পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা জেঁকে বসেছে ব্যবসায়ী মহলে।
গত কয়েক মাস আগে কোটা বিরোধী আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে উদ্বিগ্ন দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। সামনের দিনগুলো নিয়ে তারা আরও বেশি শঙ্কায় আছেন বলে জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে গত এক সপ্তাহে প্রায় ১২’শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাবে, ট্রাক, বাস ও অন্যান্য যানবাহন গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল। এমনকি নৈশ বাসগুলো চলাচল করেনি। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে সাত হাজার নৈশবাস সারাদেশে চলাচল করে। তাদের প্রতিদনি ক্ষতি হয়েছে ১০ কোটি টাকা। দিনের হিসাবে নৈশ কোচের ক্ষতি ৫০ কোটি টাকার উপরে। এই হিসাব সাধারণ বাস বা ট্রাক চলাচলের বাইরে বলে জানান একজন পরিবহন নেতা।
অন্যদিকে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের গার্মেন্ট রফতানিতে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। একই সঙ্গে আমদানি করা পণ্য পরিবহণ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর ও কয়েকটি স্থল বন্দরে আটকা পড়েছে। হিলি স্থল বন্দরে ভারত থেকে আমদানি করা প্রায় পাঁচ হাজার টন পেয়াজ আটকা পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন বাজারে। বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। সিদ্দিকুর রহমান জানান, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়মতো পন্য রফতানি। কিন্ত পরিবহন সংকটে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গার্মেন্ট পন্য পরিবহন করা যাচ্ছে না। এতে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। একই সঙ্গে বায়াররাও পোশাক অর্ডার করতে দ্বিধা করছে। অনেক বায়ার পোশাক কিনতে অস্বীকার করেছে। তাই তিনি দ্রæত এই পরিস্থিতির সমাধানের কথা বলেন। প্রসঙ্গত অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের এদেশে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্ক করেছে।
পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, পরিবহনের নিরাপত্তার কারণে সড়কে পরিবহন চালায়নি মালিকেরা। তবে পরিবহন বন্ধ থাকায় শুধুমাত্র মালিকদেরই ক্ষতি প্রতিদিন ৫০ কোটি টাকা।

ট্রাক কাভার্ড ও পিকআপ ভ্যান মালিক সমিতির হিসাবে তাদের প্রতিদিন ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে তাদের ৭ দিনে ক্ষতি ৭০০ কোটি টাকা।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে রাজধানীর কেনাকাটায়। ঈদকে সামনে রেখে বিপণিবিতানগুলোয় দোকানীরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসলেও নেই ক্রেতার উপস্থিতি। এমনকি সড়কের পাশের দোকানও প্রায় ক্রেতাশূন্য। বেশ কয়েকজন দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্যবার ঈদের মাস এলেই বিকিকিনি শুরু হয়ে যেত। কিন্ত এবার এখন পর্যন্ত কোনো বেচাবিক্রি নেই।
রাজধানীর অভিজাত বিপণিবিতান হিসেবে খ্যাতি রয়েছে পান্থপথে অবস্থিত বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের। বিপণিবিতানটি খোলা থাকলেও সেখানে ক্রেতাদের তেমন উপস্থিতি চোখে পড়েনি। বিপণিবিতানটির নিচতলার ফ্যাশন হাউজ সেইলরের বিক্রয়কর্মী মিরাজ বলেন, ঈদের পোশাক তোলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বেচাবিক্রি নেই। এক সপ্তাহ ধরে ক্রেতাই নেই। রাজধানীর অন্যতম বিপণিবিতান যমুনা ফিউচার পার্ক। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বিপণিবিতানটিতেও ক্রেতাসমাগম চোখে পড়ার মতো নয়। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সেখানকার দোকানীরা।
বিদ্যমান পরিস্থিতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদেরও। নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশে ট্রিপ বাতিল করেছেন বিদেশী ক্রেতা প্রতিনিধিরা। বেশ কয়েকটি ট্রিপ এরই মধ্যে বাতিল করেছেন তারা। পোশাক শিল্প মালিকরা এখন শঙ্কায় আছেন শিপমেন্ট বাতিল হওয়ার।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এফবিসিসিআই। গত রোববার সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার দাবিও জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ছাত্র আন্দোলন এবং এ থেকে উদ্ভূত পরিবহন ধর্মঘটের কারণে দেশের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা ব্যবসায়ী সমাজ এটা সমর্থন করি না। পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরা ধর্মঘটে আছেন। এতে ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি-রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এফবিসিসিআই মনে করে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পরিবহন ধর্মঘটে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বিঘি্নত হচ্ছে। এতে মূলম্ফীতি আবারও বাড়বে। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও দেশের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ বাস্তবতায় আন্দোলন কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরা এবং পরিবহন শ্রমিকসহ সবাইকে আন্দোলন থেকে বিরত থাকার আহ্বানন জানিয়েছে এফবিসিসিআই।
অন্যদিকে চলমান পরিস্থিতে উদ্বেগ জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ-আইবিএফবি। গত রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে জনসাধারণের দুর্ভোগ হচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে।

ভোগান্তিতে ই-কমার্স : ই-কমার্সের পাশাপাশি ক্ষুদ্র পরিসরে নতুন ব্যবসায় উদ্যোগের জনপ্রিয় প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে ফেসবুক-কেন্দ্রীক প্রচারণা। সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় এ মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের পণ্য বা সেবার বিপণনে সফলতাও পেয়েছেন অনেকে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা। এ জনপ্রিয়তা মূলত মোবাইল ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেট সেবার বিঘ্ন ঘটলেই ভোগান্তিতে পড়ছেন উদ্যোক্তারা। দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এর ব্যবহারকারীদেরও।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার ক্রয়াদেশ পায় এ খাতের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। খাতটির আকার বার্ষিক ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ কোটি টাকার। এ হিসাবে দৈনিক ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা কেনাবেচা হয় খাতটির মাধ্যমে।
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ই-কমার্স সেবাটি পুরোপুরি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ইন্টারনেট সেবা বিঘœ হলে তার প্রভাব পড়ে খাতটির ওপর। এক্ষেত্রেও তাই পড়েছে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা। অনেকেই নিত্যদিনের বাহন হিসেবে অ্যাপের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এ অবস্থায় ইন্টারনেটের স্বাভাবিক গতি না থাকলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসেইন মোঃ ইলিয়াস।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ব্যবসা- বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেশের স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে। দেশে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করলে অর্থনীতি, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের উপর প্রভাব পড়ে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অর্থনীতির উপর স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জনগনের আশা-আকাঙ্খার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পৃক্ত। দেশের অর্থনীতিতে প্রতিবন্ধকতা যাতে তৈরি না হয় সে জন্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবীদ। #

https://www.dailyinqilab.com/article/146288