জাতীয় প্রেস ক্লাবে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের সমাবেশে অতিথিরা হনয়া দিগন্ত
৭ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩৪

উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ সভায় বক্তারা

নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান

ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারকে সরাতে হবে : মির্জা ফখরুল

উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে শিক্ষার্থীদের ওপর চলমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাজনীতিক ও বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, চলছে গুণ্ডাতন্ত্র। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সরকার এ নৈরাজ্য পথ বেছে নিয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং তাদের ন্যায়ানুগ আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন সমাবেশে বলেন, দেশে অসুস্থ শাসন ব্যবস্থা চলছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আজকে গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা লাঠিসোটা নিয়ে নিরীহ ছাত্র-ছাত্রী ও নিরীহ মানুষের ওপরে হামলা করে যাচ্ছে, তাদের আমরা গুণ্ডা ছাড়া আর কোনোভাবে চিহ্নিত করতে পারি না।

তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, আছে গুণ্ডাতন্ত্র। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, গুণ্ডামুক্ত বাংলাদেশ চাই আমরা। এদের থেকে দেশকে মুক্ত করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে, ঐক্যবদ্ধ হোন। এ ঐক্যবদ্ধ মানুষকে গুণ্ডা লেলিয়ে ধ্বংস করা যাবে না।
ড. কামাল হোসেন বলেন, এদেশটা স্বাধীন করার জন্য লাখো শহীদ রক্ত দিয়েছেন। যে স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিয়ে যে রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনকে জীবন দিতে হয়েছিল সে বাংলাদেশে গুণ্ডাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এটা মেনে নেয়া যায় না। এ গুণ্ডাদের কারা লেলিয়ে দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করুন। গুণ্ডাদের থেকে এ দেশ মুক্ত হোক, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তা হোক। প্রয়োজনে আমাদের গুলি করা হোক। আমি গুণ্ডাতন্ত্রের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই না।
আগস্টের শোকাবহ মাসে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর গুণ্ডাদের হামলার ঘটনা ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কামাল হোসেন। আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তুলে নেয়া এবং গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনারও তীব্র নিন্দা জানান তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সমাবেশে বলেন, আমাদের কিশোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দিন হলো। সরকারি দলের গুণ্ডারা প্রকাশ্যে লাঠি-অস্ত্র হাতে পুলিশের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করছে। শিক্ষার্থীদের দাবি কী? নিরাপদ সড়ক এবং একটি সুশৃঙ্খল দেশ। এ শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি দলের গুণ্ডারা আক্রমণ করছে এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার।

তিনি বলেন, সরকার এখনো উপলব্ধি করতে পারছে না। তারা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এসব কি আইনসম্মত, শিক্ষার্থীরা বলছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। প্রতিটি পদক্ষেপ যখন জাস্টিসের বদলে অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। অবিচার যখন আইন হয়ে যায়, রুখে দাঁড়ানো তখন কর্তব্য হয়ে পড়ে।
সাবেক এ রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, আজকে বুঝতে হবে আমরা সবাই মিলে যদি এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি, এক কণ্ঠে যদি কথা না বলি তাহলে মনে হয় না এ সরকার বুঝবে। এই সরকার বুঝার মতো নয়। কারণ তাদের মূল শক্তি ইনজাস্টিসের ভিত্তিতে। এটা হতে পারে না।
শুধু দেশপ্রেমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এদেশটা সুশৃঙ্খল হোক, আরো সুন্দর হোক, কোনো অন্যায় থাকবে নাÑ এ স্বপ্নে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছে। এটাকে সমর্থন করব না। আর সমর্থন করলে আপনি (সরকার) বলবেন, আমি রাজনীতি করছি। রাজনীতি কি এদেশে নিষিদ্ধ? অবশ্যই রাজনীতি করব। দেশের মঙ্গলের জন্য কিনা সেটা দেখতে হবে।
তিনি বলেন, অন্যায় যদি আইন করে ফেলেন আমরা সব মুখ বুঝে তা সহ্য করব, বসে বসে দেখবÑএটা কেমন করে আশা করা যায়? এটা আশা করা উচিত নয়।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমরা প্রতিবাদ করবই। আমার সন্তানদের হত্যা করার অধিকার কারো নাই, গুণ্ডাদের নাই, পুলিশের নাই এবং এই সরকারেরও নাই। এটা তাদের উপলব্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, পরিবর্তন আনতেই হবে। শুভ পরিবর্তন আমরা চাই। এমন পরিবর্তন আনতে হবে যে পরিবর্তন সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা শুভ পরিবর্তনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিÑসেখানে আমরা একসাথে দাঁড়াব। ভারসাম্যের রাজনীতি থাকতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নিরাপদ সড়ক চাইÑ এটা সময়ের দাবি। আরো একটা কথা তারা (শিক্ষার্থীরা) উচ্চারণ করেছে ‘নাউ অর নেভার’। অত্যন্ত জরুরি কথা এটা। এখনই, না হয় আর কখনো হবে না। যে পাথর রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসেছে, যে ফ্যাসিস্ট শক্তি চেপে বসেছে সেই ফ্যাসিস্ট শক্তি সব কিছু তচনচ করে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের এখন একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত হয়ে এ ভয়াবহ দানবের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা, আমাদের অর্জিত সম্পদগুলো রক্ষা করা। যে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আমরা যুদ্ধ করে একাত্তর সালে নিয়ে এসেছি, যে গণতন্ত্রকে আমরা লড়াই করে নিয়ে এসেছি তাকে রক্ষা করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এ আন্দোলনে অনেক কথা ও ছবি ফেসবুকে এসেছে। এর মধ্যে একটি ব্যানার আমাকে আকৃষ্ট করেছে। সেটা হলো একটা রাস্তা বন্ধ সেখানে একটা বোর্ড লাগানো হয়েছেÑরাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্রের মেরামতের কাজ চলছে। ছেলেমেয়েরা আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এখন রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের এ সমস্যা বিচ্ছিন্ন কোনো সমস্যা নয়। এটা হচ্ছে রাষ্ট্র যে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতি জায়গায়, প্রতি মুহূর্তে তারই সমস্যা। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা এ দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে আছি, এ দেশের মানুষের সাথে আমরা আছি, আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি। ইনশা আল্লাহ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হবো এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই যে দানব, সেই দানবকে সরাতে পারব। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার নিন্দা জানান বিএনপি মহাসচিব।
তার বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, আমার নামে আরেকটা নতুন মামলা হয়েছে। আমরা এখন মামলাকে খুব বেশি কিছু মনে করি না। আমার ৮৬টি পার হয়ে গেছে। আমাদের বেশির ভাগ নেতার মামলা ৪০-৫০টি। ১৫০ থেকে ২ শ’ পর্যন্তও আছে। এগুলো এখন আমাদের কাছে কোনো সমস্যা নয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমরা বহুবার কারাগারে গেছি। আমাদের ওপর নির্যাতন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ৫শ’র অধিক নেতাকর্মী গুম হয়ে গেছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ৭৮ হাজারের ওপরে মামলা হয়েছে। ১৮ লাখ আসামি। এর মূল কারণ হচ্ছে এ আন্দোলনের কথা বলা এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। বেগম খালেদা জিয়াও এ কারণেই আজকে কারাগারে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আজকে শপথ নেয়ার দিন। আমরা এ রাষ্ট্রকে মেরামত করতে চাই। যে রকম মেরামত আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা চাইছে। আমরা কী পারি? অবশ্যই পারি।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমি টেলিভিশনে দেখলাম, একজন মা একটা কাঁঠাল নিয়ে তা ভেঙে একটা একটা করে কোয়া কিশোরদের হাতে হাতে দিচ্ছেন আর বলছেন, কাঁঠাল খাও, শক্তি অর্জন করো, না হলে আন্দোলন করতে পারবে না। এই মায়ের চেয়ে বড় তৃতীয় পক্ষ আমি তো দেখছি না। তৃতীয় পক্ষ বলতে অন্য কোনো পক্ষ নেই।
তিনি বলেন, যখন তখন পড়ে যেতে পারেন এ কারণে সরকার ছায়াকে কায়া মনে করছে, কায়াকে ছায়া মনে করছে। এই ভেবে যার তার ওপরে হামলা করছে।

প্রবীণ পেশাজীবী নেতা গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের পরিচালনায় সমাবেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, নাগরিক ঐক্যের এস এম আকরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির আবদুল মালেক রতন, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মো: মনসুর, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হাকিম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মোস্তবা আমিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে বিকল্পধারার মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবদুল মান্নান, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বিএনপির আবদুস সালামসহ বিভিন্ন পেশার নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/339452