৭ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৬

সরকার ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের তাণ্ডব প্রসঙ্গে

গত ২৯ জুলাই থেকে চলে আসা শিশু-কিশোরদের আন্দোলনটি সরকারের দমনের মুখে ৬ আগস্ট এসে একটা হোঁচট খেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ ড্রাইভার এবং নিবন্ধনবিহীন চলাচলের অনুপোযোগী যানবাহনই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সড়ক দুর্ঘটনার এটি অন্যতম প্রধান কারণও।
স্কুল ছাত্রদের সাম্প্রতিক তল্লাশিতে অন্য যে তথ্যটি বেরিয়ে এসেছে সেটি আরো মারাত্মক। এতে দেখা যায় যে, সরকারের যে বাহিনীট আইনশৃঙ্খলা এবং যানবাহন বিধি ও নিয়ম-নীতি বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত তারাই বিধি ভঙ্গের জন্য বেশি দায়ী। কোন কোন পুলিশের গাড়ির যেমন নিবন্ধন নেই, তেমনি তাদের লাইসেন্সও নেই। একই অবস্থা অনেক মন্ত্রী, সচিব, নির্বাচন কমিশনারসহ আমলা-কর্মচারীদেরও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উচ্চ আদালতের কোন কোন বিচারক ও তাদের গাড়িও এই কাতারে পড়ে। বিষয়টি ধরা পড়েছে বিস্ময়করভাবে স্কুলের কিশোর-কিশোরী-বালক-বালিকাদের হাতে, অনেকটা শিশুদের পেশাবে আছাড় খাবার মত।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনের প্রথম তিন দিনের ফলাফল সম্পর্কিত পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। রাস্তায় আমার গাড়িও শিশুদের কবলে পড়েছিল। প্রেসের গাড়ি বলে তারা বিশেষ সুযোগ দেয়নি। কাগজপত্র তন্নতন্ন করে দেখেছে। লক্ষ্য করলাম, শিশু হলেও তাদের এই দেখার মধ্যে পেশাদারিত্ব ছিল, যা আমাদের সরকারের ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সদস্যদের তুলনায় কম নয়। ট্রাফিক পুলিশ পয়সা খায় এরা খায় না। পুলিশ পয়সা দিলে ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করে, না দিলে হাঁ’কে ‘না’ করে এবং মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। যানবাহন পরিস্থিতি যাচাই করতে আরো হোঁচট খেতে হলো এবং এক ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হলো। পরিস্থিতিটি এমন:
দেশে বর্তমানে ৩৫.৩৬ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে। এর বিপরীতে সরকারি সংস্থা বিআরটিএ কর্তৃক ইস্যুকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্স-এর সংখ্যা হচ্ছে ২৬.৩৯ লাখ। এর অর্থ হচ্ছে দেশে প্রায় ৯ লাখ যানবাহন এমনসব ড্রাইভারদের হাতে রয়েছে যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এসব ড্রাইভারের মধ্যে ১৪-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরও রয়েছে বলে জানা গেছে। আবার যাদের লাইসেন্স আছে তাদের মধ্যে হাজার হাজার অদক্ষ ট্রাফিক আইন না জানা ব্যক্তিও আছে, পরিবহণ শ্রমিক নেতা ও মন্ত্রী শাহজাহান খানের সুপারিশে যাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। নেতৃত্ব ধরে রাখা, পয়সা কামানো ও ভোটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য তিনি এদের এই অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন। এরাই পরিবহণ খাতের কিলার নামে পরিচিত। এখানেই শেষ নয়, সরকারি আমলা এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আশীর্বাদপুষ্ট আরো প্রায় ২০ লাখ যানবাহন দেশের রাস্তাঘাটে চলাচল করে যেগুলোর কোনও নিবন্ধন নেই। এগুলো অপেক্ষাকৃত ধীরগতির এবং সড়ক মহাসড়কে চলাচলের অনুপযোগী। উচ্চতর আদালত মহাসড়কে তাদের চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু তথাপিও তারা চলে এবং অহরহ দুর্ঘটনা ঘটায়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, বিআরটিএ কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রফেশনাল লাইসেন্সের সংখ্যা হচ্ছে ১২ লাখ ১৫ হাজার, এর মধ্যে ১১,১৬,৬০০ ব্যক্তিকে গণপরিবহণ চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবছর রাস্তায় চলাচলকারী ১০ লাখ গাড়ির ফিটসেন সার্টিফিকেট নেয়ার কথা, কিন্তু ক্লিয়ারেন্স নেয় গড়ে মাত্র সাড়ে ছয় লাখ গাড়ি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নিবন্ধনকৃত যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ১,৩৮,৪১০টি ট্রাক, ৪৫,৩৪৭টি বাস, ২৮,০৬৩টি মিনিবাস, ৯৯,১৮৭টি মাইক্রোবাস, ৩৪,০৮৯টি প্রাইভেট কার, ৫৫,৮৬৩টি জীপ, ৪৫,২৯৫টি ট্যাক্সি, ২২,৩৪,৮৯২টি মোটরসাইকেল এবং ৫,৪৯,০২৪টি অন্যান্য যান (মোট ৩৫,৩৬,৩৭০টি যানবাহন)। এর বিপরীতে লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে ৯,২৫,৫১০টি মোটরসাইকেল, ৫৪,৪৮৪টি সিএনজি, ১৪,৫৯,০৪২টি হালকা যান, ৬০,২৩৮টি মাঝারি যান, ১,৩৮,৫৯৭টি ভারী যান এবং ৭৮৭টি অন্যান্য যানের বিপরীতে (মোট ২৬,৩৯,৬৯৮)।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি স্কুলের দুজন ছাত্রকে বাসের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করার প্রতিবাদে স্কুলছাত্ররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলন শুরু করে। নিহতদের মধ্যে একজন ছাত্র এবং আরেকজন ছাত্রী। তারা সড়কের নিরাপদ স্থানেই ছিল। কিন্তু তিন তিনটি বাসের যাত্রী তোলার ভয়াবহ প্রতিযোগিতায় পড়ে তারা বাসচালকের নির্মম হত্যার শিকার হয়। ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী সেখানে ৫ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। পত্র-পত্রিকায় এই ঘটনাটির প্রকৃত প্রতিফলন হয়নি। নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য স্কুলের কিশোর-কিশোরী-ছাত্ররা ঘাতক বাসের ড্রাইভারের মৃত্যুদ-সহ নয় দফা দাবি পূরণের জন্য আন্দোলন শুরু করেছে এবং রাস্তায় নেমে নিজেরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেছে। এটা করতে গিয়েই যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, চালকের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রভৃতি সংক্রান্ত পরিবহণ সেক্টরের বিদ্যমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির বিষয়টি উঠে আসে। আমাদের যোগাযোগ ও পরিবহণ খাত দেখার জন্য একজন মন্ত্রী আছেন। তিনি আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, জেনারেল সেক্রেটারি, সভাপতি শেখ হাসিনার পরই তার ক্ষমতা। পরিবহণ খাতের শ্রমিক-কর্মচারী-ড্রাইভার, যারা এই খাতের প্রাণ, তাদের একটি ইউনিয়ন আছে, তার সভাপতিও একজন মন্ত্রী। এই খাত যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারাও সরকারি লোক, ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএ কর্মকর্তা। এত জাঁদরেল অবস্থানে থাকার পরও এই খাতের এত বিশৃঙ্খল অবস্থা মানুষকে হতবাক না করে পারে না। আমরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করতে দেখি, চাঁদাবাজি করতে দেখি। কাগজপত্র বৈধ করার ব্যাপারে তাদের ভূমিকা কি আদৌ নেই? ঘটা করে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন কি জন্য?

এই দেশের মানুষের পয়সায় পোষা ট্রাফিকের এত বড় বহর থাকতে পরিবহণ খাতের অনিয়ম স্কুল ছাত্রদের হাতে ধরা পড়া সত্যি বিস্ময়কর। অনেকে মনে করছেন পরিবহণ খাতের এই নৈরাজ্যের জন্য আমাদের ট্রাফিক পুলিশরাই দায়ী। রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স এবং ফিটনেস এর সমস্যার সমাধান হোক তারা তা চান না। কেন না এ সমস্যার সমাধান হলে তারা চাদাবাজির উসিলা হারাবেন। ক্ষমতাসীন দলেরও এর সাথে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। বাজারে গুজব রয়েছে যে পরিবহণ খাতে দৈনিক চাদাবাজির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। এই টাকার ভাগ পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, পাতি নেতা, শ্রমিক ইউনিয়নের কর্তা ব্যক্তি হয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে। ফলে এই খাতের রোগগুলোর আর উপসম হয় না। অদক্ষ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ড্রাইভারদের হাতে যখন সড়কের চলাচলের অনুপযোগী গাড়িগুলো ছেড়ে দেয়া হয় এবং বলা হয়, যে দৈনিক তাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অংকের টাকা উপার্জন ও প্রদান করতে হবে তখন তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে, পরস্পর পরস্পরের সাথে ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতায় নামে। এই প্রতিযোগিতার বলি হয় সাধারণ যাত্রী। এই কারণেই আমাদের দেশে বার্ষিক গড়ে আট হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। এর সবগুলো accident (দুর্ঘটনা) নয়, incident (ঘটনা) যা অনেকটা ইচ্ছাকৃত। সড়কে সাধারণ যাত্রী বা পথচারীদের হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় এই হত্যার ঘটনা ক্রমবর্ধিষ্ণু। শ্রমিক ইউনিয়ন এই শাস্তির বিরুদ্ধে। আদালত যদি কঠোর শাস্তির রায় দেয় তাহলে ইউনিয়ন ও যানবাহন মালিকরা রাস্তায় বেরিকেড দেয়, পরিবহণ ধর্মঘট করে দেশকে অচল করে দেয়। মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়। বর্তমান সময়ে মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়ন তো সারা দেশকেই জিম্মি করে রেখেছে। তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারবে না। করলে অপকর্মের পরিমাণ ও পরিসর কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে তারা তার জবাব দেয়।

গত ২৯ শে জুলাই ঢাকার কর্মীটোলায় দু’জন ছাত্র-ছাত্রীর (মতান্তরে ৫ জন) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সূচিত শিশু-কিশোর আন্দোলনের প্রথম সাত দিনের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। এই সাত দিন অর্থাৎ আগস্টের ৪ তারিখ পর্যন্ত রাজধানীর ও তার উপকণ্ঠ সাভার, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানে বেপরোয়া ড্রাইভিং-এর ফলে আরো ১১ ব্যক্তি নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হবার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আবার পরিবহণ মালিকরা রাস্তায় পরিবহণ চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ঢাকাসহ আন্তঃজেলা রুটের সকল বাস কোচ চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং জনদুর্ভোগ চরমে উঠে। শুধু তাই নয়। অভিযোগ উঠেছে যে পরিবহণ শ্রমিক, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিলে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর উপর হামলা করে তাদের হতাহত করেছে। সরকারও এই আন্দোলনের মধ্যে সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন এবং কঠোর হস্তে তা দমনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে হয়ত তারা সফল হবেন। বিরোধী দলকেও তারা দমন করবেন। জনান্তিকে বলে রাখি সরকার এই আন্দোলনে উস্কানি দেবার জন্যে বিরোধী দলকে দায়ী করলেও বিরোধী দলগুলো কিন্তু গতি টলটলায়মান করা এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এর অনুকূলে তাদের কর্মীদের মাঠে নামায়নি। এটা তাদের দূরদর্শিতা না দুর্বলতা সময়ই তা বলে দিবে। একজন চিকিৎসক লেখকের দৃষ্টিতে দেশের জনগণ এখন দু’শ্রেণির ভয়ানক অপরাধীদের হাতে জিম্মি। একটি হলো রাজপথে লাইসেন্সহীন ড্রাইভার। অপরটি হলো রাষ্ট্রের উপর লাইসেন্সহীন তথা জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার। উভয়ে মিলে জনগণের জীবন থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে। লাইসেন্সহীন ড্রাইভার ও ফিটনেস ও নিবন্ধনহীনতার কারণে রাস্তার অনেক যানবাহন পরিণত হয়েছে মানুষ খুনের হাতিয়ার। অপরদিকে সরকারের কারণে শাসকরা পরিণত হয়েছে খুন, গুম, লুটপাট, দুর্নীতি ও নৃশংস নির্যাতনের হাতিয়ারে

http://www.dailysangram.com/post/340863