৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৫

২০০০ কোটি টাকা নিয়ে ১৫ ব্যবসায়ী লাপাত্তা

জাহাজভাঙা শিল্পে নির্বিচারে ঋণ দিয়ে বেকায়দায় চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলো। এ খাতের ১৫ ব্যবসায়ীর কাছে আটকা পড়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। ঋণখেলাপি হয়ে এসব ব্যবসায়ীর কেউ কেউ দেউলিয়া হয়ে গেছেন। আবার কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখলেও আসছেন না অফিসে। বন্ধ রেখেছেন মোবাইল ফোনও। ঋণখেলাপি এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেও উদ্ধার করা যাচ্ছে না ঋণের টাকা। এ শিল্পে এখন তাই নতুন করে ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে ব্যাংকগুলো। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আটকে থাকা এসব ঋণের বেশিরভাগই দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। তাই কোনো কোনো ব্যবসায়ী একই জামানত একাধিক ব্যাংকে রেখে নিয়েছেন ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইআর রিপোর্ট নিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ দিলে আটকে থাকত না তাদের এত বিপুল পরিমাণের টাকা।

চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা শিল্পে সর্বোচ্চ ঋণ দেওয়া বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে পূবালী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, এনসিসি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক নির্বিচারে ঋণ দিয়েছে বেশি। এসব ব্যাংকের অধিকাংশই ইয়ার্ডে থাকা জাহাজ দেখে ঋণ দিয়েছে। কেউ কেউ বাড়তি হিসেবে জামানত রেখেছে জায়গা। মামলা করতে গিয়ে ব্যাংকাররা দেখেন, ঋণের বিপরীতে তারা যে জামানত রেখেছেন তার মূল্যমান ঋণের তুলনায় অনেক কম। তাই সম্পদ নিলামে তুলেও ঋণের টাকা তুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক বিষ্ণুপদ সাহা সমকালকে বলেন, 'ব্যাংকগুলো কাকে কীভাবে ঋণ দেবে, জামানত হিসেবে কী রাখা যাবে, ঋণের টাকা

কীভাবে উদ্ধার করা যাবে- এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। একজন ব্যবসায়ী যাতে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়ে না যান সে জন্য 'সিআইআর' রিপোর্ট সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এ আগে অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে কি-না সে বিষয়ে তথ্য থাকে। ব্যাংকগুলো এসব নির্দেশনা অনুসরণ করলে কোনোভাবেই আটকে থাকত না ঋণের টাকা।' অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'জামানতের তুলনায় ঋণের টাকা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট শাখা কর্মকর্তা দায় এড়াতে পারেন না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বড় কোনো ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় যদি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনরাই যুক্ত থাকে তাহলে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।'

ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে একই জামানত দিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। আবার ভুয়া ঠিকানা ব্যবহারের পরও তা যাচাই না করে ঋণ দিয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। যেমন চট্টগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদের নূর চেম্বারের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে মুহিব, সাকিব ও আহমেদ মুজতবা স্টিলের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে মুহিব স্টিল ও সাকিব স্টিলের স্বত্বাধিকারী হিসেবে নাম রয়েছে মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের। আহমেদ মুজতবা স্টিলের স্বত্বাধিকারী হিসেবে রয়েছে তার ভাই মুজিবুর রহমান মিলনের নাম। একই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করে বি রহমান শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ ও সিলভা শিপব্রেকিং লিমিটেডও ঋণ নিয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, নূর চেম্বারে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই নেই। ব্যাংক কর্মকর্তাদের এমন উদাসীনতার কারণে ঋণ নিয়ে 'দেউলিয়া' হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে অনেক ব্যবসায়ী। তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে চলমান মামলা জিতলেও ঋণের টাকা উদ্ধারে অনিশ্চয়তায় থাকবে ব্যাংকগুলো।

তিন ব্যাংকের কাছ থেকে ১২৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আবরার স্টিল। অথচ এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা আছে ৭০ কোটি, পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা রয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ও ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখা পাবে ১৬ কোটি টাকা। শিপইয়ার্ডে থাকা জাহাজ দেখিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয় আবরার স্টিল।

ঋণ নেওয়ার পর 'নিখোঁজ' হয়ে আছেন শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন কুসুমও। ব্যাংক এশিয়ার সীতাকুণ্ড ভাটিয়ারী শাখা থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন ১০১ কোটি টাকা। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি ব্যাংক কর্মকর্তারা। তার বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানায় ব্যাংকের তৎকালীন সিনিয়র অফিসার এমরানুল হক মামলাও করেন। তার সম্পদের মধ্যে ব্যাংকের কাছে জামানত রয়েছে ১৭১ দশমিক ১১ শতকের একটি ভূমি।

জানা গেছে, তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ নেন ব্যবসায়ী গিয়াস। শাহ আমানত আয়রন মার্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংক এশিয়া থেকে ৪১ কোটি ৬৯ লাখ চার হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। আবার আল মদিনা এন্টারপ্রাইজ নামের আরও একটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে একই ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তিনি ৫৯ কোটি ৯২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭৬ টাকা। আরেক প্রতিষ্ঠান তানহা স্টিল দেখিয়ে এবি ব্যাংক জুবিলি রোড শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি ৫০ কোটি টাকা। সুদাসলে এটি এখন দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি টাকায়।

এ প্রসঙ্গে এবি ব্যাংক জুবিলি রোড শাখার ম্যানেজার ওসমান গনি চৌধুরী বলেন, 'কয়েক বছর ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও হদিস পাইনি তানহা এন্টারপ্রাইজের মালিক গিয়াসের। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করছেন। বাধ্য হয়ে তাই তারা আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন।' তবে নিয়ম না মেনে ঋণ দেওয়ার অভিযোগে ব্যাংক এশিয়ার ভাটিয়ারী শাখার তৎকালীন ম্যানেজার হাসানুজ্জামান ও সেকেন্ড অফিসার মিজানুর রহমানকে কিছুদিন আগে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এক্ষেত্রে দুদক কিছুটা কঠোর হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে নীরব। আবার ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকায় সংশ্লিষ্ট শাখার বিরুদ্ধে নেওয়া যাচ্ছে না শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা।

যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে জাহাজভাঙা শিল্পের আরেক প্রতিষ্ঠান ম্যাক ইন্টারন্যাশনালও। এ প্রতিষ্ঠানের অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখায় প্রায় ১৬০ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ৫৭ কোটি, পূবালী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় প্রায় ৪৪ কোটি, পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় সাড়ে ২২ কোটি, যমুনা ব্যাংক ভাটিয়ারী শাখায় প্রায় ১৩ কোটি ও ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ১২ কোটি টাকার পাওনা রয়েছে ম্যাকের কাছে। এ গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান এমকে স্টিলকে ৮৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েও তা আদায় করতে পারছে না এবি ব্যাংক ইপিজেড শাখা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামে পূবালী ব্যাংকের ডিজিএম ফারুক আহমেদ বলেন, 'জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে তারা বিপদে আছেন। মোস্তফা স্টিল ও চিটাগাং ইস্পাত নামের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলাও চলছে।' তিনি দাবি করেন, যখন ঋণ দিয়েছিলেন তখন তাদের অনেক সম্পদ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সেই সব সম্পদও অন্যদের কাছে জামানত রেখেছেন তারা। তাই ঋণের টাকা উদ্ধার করতে মামলার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, মোস্তফা স্টিল নামের আরেক শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের কাছে সাউথইস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১১৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, ব্যাংক এশিয়া সিডিএ এভিনিউ শাখার ২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৪২ কোটি ও এনসিসি ব্যাংকের ২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। জাহাজভাঙা শিল্পের আরেক প্রতিষ্ঠান এইচ স্টিলকে একসঙ্গে সাড়ে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে বিপদে আছে ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখা। একই প্রতিষ্ঠানকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ঋণ দিয়েছে ২০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, 'যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে যারা বড় ঋণ দিয়েছেন তাদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কাউকে বদলি করা হচ্ছে, কাউকে পদাবনতি করা হচ্ছে। পাশাপাশি টাকা উদ্ধারের জন্য আদালতে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।'

জানা গেছে, চিটাগাং ইস্পাত নামের আরেক প্রতিষ্ঠানের কাছে অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখা প্রায় ৭৪ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক সিডিএ শাখা ৩৬ কোটি টাকা ও ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা পাবে ১৪ কোটি টাকা। বিএম স্টিলের কাছে প্রিমিয়ার ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা রয়েছে সাড়ে ৩৯ কোটি টাকা। সাকিব স্টিলের কাছে ৩৩ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ঢাকা ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখার। ন্যাশনাল স্টিলের কাছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার। এসএম স্টিলের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনার পরিমাণ ৪৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রিসাইক্লিংয়ের বিরুদ্ধে অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১১২ কোটি টাকা, আহমেদ মুজতবা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে এনসিসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ও ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ৬৩ কোটি, কিউএস স্টিলের বিরুদ্ধে এনসিসি ব্যাংক ৩২ কোটি টাকা আদায়ে মামলা হয়েছে। এভাবে জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের আটকা রয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংক দক্ষিণ জোনের প্রধান মতিউর রহমান বলেন, 'ব্যবসায় উত্থান-পতন থাকতে পারে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বিনিয়োগকৃত টাকা কীভাবে উদ্ধার করা যাবে সেই কৌশল ঠিক করবে। ব্যাংক কর্মকর্তার গাফিলতি কিংবা যোগসাজশের কারণে যদি কোনো ঋণ আটকে থাকে তবে কঠিন শাস্তি হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে জাহাজভাঙা শিল্পে ঋণ দিয়ে এভাবে বেকায়দায় পড়ায় এখন এ খাতে ঋণ দিতে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করছে চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলো। শুধু ইয়ার্ডে থাকা জাহাজ দেখে এখন আর ঋণ দিচ্ছে না অনেক ব্যাংক। বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রামে ব্র্যাক ব্যাংকের এরিয়া হেড সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, 'জাহাজভাঙা শিল্পে তারা নতুন করে কোনো বিনিয়োগ করছেন না। অতীতে এ খাতের অনেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এখন বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।'
- See more at: http://bangla.samakal.net/2017/02/05/268040#sthash.lgHSsUF9.dpuf