৬ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ১০:৫৩

অঘোষিত বাস ধর্মঘট

তৃতীয় দিনের মতো অচল দেশ

বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম ; সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশা ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ ; চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

অঘোষিত বাস ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে গতকালও রাজধানীসহ সারা দেশ অচল ছিল। গতকালও রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি এবং রাজধানীতেও কোনো বাস আসেনি। সকালে রাজধানীতে দু-একটি বাসের দেখা মিললেও সকাল ১০টার পর একেবারেই উধাও হয়ে যায়। পরিবহন সেক্টর সূত্র জানায়, ধর্মঘট নিয়ে ইতোমধ্যেই মালিক পক্ষ ও শ্রমিক পক্ষ দুইটি ভাগ হয়ে গেছে। শ্রমিকেরা গাড়ি চালাতে চাইলেও বাধা দিচ্ছে মালিক সমিতি। এ দিকে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। অপর দিকে, রাজধানীসহ সারা দেশে কাঁচাপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান কমে যাচ্ছে। এতে দাম বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের।

ছাত্র বিক্ষোভের মুখে অঘোষিত ধর্মঘট চলছে পরিবহন সেক্টরে। গতকাল তৃতীয় দিনের মতো সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। রাজধানীর কোনো টার্মিনাল থেকেই গতকাল বাস ছেড়ে যায়নি। সকালে গাবতলী টার্মিনালে খবর নিয়ে জানা যায়, কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। একাধিক কাউন্টারে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, তারা কাউন্টার খোলা রেখেছেন মালিক সমিতির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। মালিক সমিতি নির্দেশ দিলেই তারা বাস ছেড়ে দেবেন। শত শত বাস টার্মিনালের ভেতরে অপেক্ষা করছে। মহাখালী টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, আগের দুই দিনের মতোই টার্মিনালে সারিবদ্ধ রাখা আছে বাস।
সায়েদাবাদ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, বাসগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। শিহাব নামে এক শ্রমিক জানান, মালিক সমিতি যতক্ষণ পর্যন্ত নির্দেশ না দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত গাড়ি চলবে না। গতকালও সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের মহড়া দিতে দেখা যায়।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, পরিবহন সেক্টরে ধর্মঘট নিয়ে এখন মালিক সমিতি ও শ্রমিকেরা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছেন। শ্রমিকেরা চাচ্ছেন গাড়ি চলুক। কিন্তু মালিক সমিতির নির্দেশেই সবকিছু হচ্ছে। দিনের বেলায় না হলেও রাতে গাড়ি চালাতে চান শ্রমিকেরা। কিন্তু তাতেও বাধা দেয় মালিক সমিতি। গত শুক্রবার রাতেও শ্রমিকেরা গাড়ি চালিয়েছেন। কিন্তু পরদিন শনিবার থেকে রাতেও গাড়ি চলছে না। বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বলেন, শ্রমিকরাতো চাচ্ছেন গাড়ি চালাতে। কিন্তু মালিক সমিতির সম্মতি নেই।
গতকাল সকালে রাজধানীতে কিছু বাস দেখা গেছে। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে তাও উধাও হয়ে যায়। একাধিক শ্রমিক জানিয়েছেন, তারা দু-একটি বাস নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে সেসব গাড়ি আটক করে পুলিশ। যে কারণে তারা একেবারেই বন্ধ রেখেছেন গাড়ি। গতকাল রাজধানীর কোথাও লেগুনা-টেম্পোও দেখা যায়নি। ফলে মানুষ পড়েন চরম বিপাকে। জরুরি প্রয়োজনে যারা রাস্তায় বের হন তাদের বেশির ভাগ রিকশা বা সিএনজি অটোরিকশায় যাতায়াত করেন। কিন্তু ওসবের ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছেন।
সারা দেশে বাস চলাচল না করায় মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। যেসব এলাকায় যাওয়ার বিকল্প পথ নেই সেখানকার মানুষ জরুরি প্রয়োজনেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারছেন না। গাড়ি চলাচল না করায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও বেড়েছে। মাছের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। যে চিংড়ি মাছের কেজি ছিল সাড়ে ৪০০ টাকা, তা এখন এক হাজার টাকা। বেড়েছে সবজির দামও।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, পরিবহন শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন চট্টগ্রামের মানুষ। গতকাল সারা দিন সড়কে কোনো গণপরিবহন ছিল না। হাতেগোনা যে কয়েকটি গাড়ি ছিল, তারা আদায় করেছে তিন-চারগুণ ভাড়া। পরিবহন মালিকেরা বলছেন, গাড়ি ভাঙচুরের কারণে চালকেরা বাস চালাতে চাইছেন না।
শনিবার থেকে শুরু হওয়া ট্্রাফিক সপ্তাহের কারণেও কাগজপত্র না থাকায় রাস্তায় যানবাহন আটকে রাখছে বলে অভিযোগ মালিক-শ্রমিকদের। ফলে গতকাল দিনভর ভোগান্তির শেষ ছিল না বন্দরনগরীর মানুষের। কর্মজীবী মানুষ কেউ রিকশায়, কেউ দীর্ঘপথ হেঁটে আবার অনেকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গাড়ি চড়ে অফিসে গেছেন।
গতকাল চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার কোনো বাস। নগরীর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, জিইসি, ওয়াসা, লালখান বাজার, আগ্রবাদ এলাকায় ঘুরে এসব চিত্র দেখা যায়। কোম্পানীগঞ্জে যাওয়ার জন্য কদমতলি বাস টার্মিনালে এসেছিলন মোহাম্মদ মিয়া মণ্ডল। তিনি বলেন, জরুরি কাজে কোম্পানীগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন, এখন ফিরে যেতে পারছেন না। এ দিকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিআরটিসি ও কদমতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে সব বাসের টিকিট কাউন্টার বন্ধ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ আন্তঃজেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি হাজী রুহুল আমিন বলেন, সড়কে নিরাপত্তা না থাকায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন। তিনি আরো বলেন, আগামীকাল সংসদে পরিবহন আইন উত্থাপন করা হবে, যে আইনে মানুষ মারা গেলে চালকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন জেল। এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চালকেরা গাড়ি চালাবে না।

খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় তিন দিন ধরে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। আসাদুজ্জামান নামে এক যাত্রী বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঢাকায় যাওয়ার দরকার, কিন্তু বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকায় যেতে পারছি না।
খুলনা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, খুলনা থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় কাউন্টার ম্যানেজার ও শ্রমিক নেতারা বলেন, শিক্ষার্থীরা যে মুহূর্তে তাদের আন্দোলন বন্ধ করলেই বাস চলাচল শুরু হবে।
ট্যাংক লরি শ্রমিকদের কর্মবিরতি : এ দিকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত আইন শিথিল করার দাবিতে ট্যাংকলরি শ্রমিকেরা জ্বালানি তেল উত্তোলন ও বিপণন বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেছেন। গতকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে ২৪ ঘণ্টার এ কর্মবিরতি পালন করা হয়। খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিকদের চারটি সংগঠন এ কর্মবিরতির ডাক দেয়। খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আলী আজিম বলেন, প্রস্তাবিত আইন এখনই শিথিল করা সম্ভব। কালক্ষেপণ করলে তেল সেক্টরে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হবে।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে গত শুক্রবার রাজশাহী থেকে সব আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। রাতে কিছু বাস চললেও গতকাল রোববার থেকে তাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলার সাথে সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অচল হয়ে পড়েছে রাজশাহী।
অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের তৃতীয় দিন গতকাল রোববারও চরম ভোগান্তিতে পড়েন রাজশাহীর সাধারণ মানুষ। সকাল থেকে রাজশাহী নগরী থেকে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। সকালে নগরীর তালাইমারী মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, যানবাহন না পেয়ে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। দূরের গন্তব্যের জন্যও দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাত্রীরা রিকশা-অটোরিকশায় উঠছেন।
রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মনজুর রহমান পিটার জানান, নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাস না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যাত্রীদের হয়রানির কথা ভেবে দুই দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সব রুটে বাস চালানো হয়। কিন্তু পরিবহন মালিক সমিতির সিদ্ধান্তে রোববার থেকে রাতেও বাস চলাচল বন্ধ রাখা হবে।
এ দিকে রাজশাহী থেকে বিভিন্ন রুটে বিআরটিসির বাসগুলো শিডিউল অনুযায়ী কয়েকটি জেলায় চলাচল করছে। তবে বাস কম থাকায় দুর্ভোগ কাটছে না।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে পটুয়াখালী ও ঝালকাঠির অভ্যন্তরীণ এবং দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে এসব জেলার যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। যাত্রীরা বাড়তি ভাড়ায় বিকল্প যানবাহনে যাতায়াত করছেন।

নগরের রূপাতলির মিনিবাস মালিক সমিতির সম্পাদক কাওসার হোসেন শিপন জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে দুর্বৃত্তরা প্রবেশ করে গাড়ি ভাঙচুর করছে। এ জন্য চালকেরা গাড়ি চালাচ্ছেন না। বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া বাসস্ট্যান্ড থেকেও অভ্যন্তরীণ ছয় রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বরিশালের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ থেকে অভ্যন্তরীণ ১৫টি রুটে বাস চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি আফতাব আহমেদ। পটুয়াখালী জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন মৃধা জানান, গত শুক্রবার সকাল থেকে পটুয়াখালীর অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
ঝালকাঠি জেলা বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বাহাদুর চৌধুরী জানান, ন্যায্য হিস্যার দাবিতে গত বুধবার থেকে ঝালকাঠির আট রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। বরিশাল বিভাগীয় ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইমান আলী শরীফ জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বরিশাল থেকে ট্রাক চালানো বন্ধ রয়েছে। চালকদের এ সিদ্ধান্তে বিভাগীয় শ্রমিক ইউনিয়ন সমর্থন দিয়েছে। তবে এ রকম কোনো বিষয় শোনেননি বলে জানিয়েছেন জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কালাম মোল্লা। বিভাগীয় ট্যাংক-লরি শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সাধারণ সম্পাদক শেখ মো: কালাম হোসেন মোল্লা জানান, পরিস্থিতি শান্ত হলে গাড়ি চলবে।
রংপুর অফিস জানায়, রংপুর জেলায় দূরপাল্লা, আন্তঃজেলা ও উপজেলা রুটগুলোতে গণপরিবহন গত শুক্রবার থেকে বন্ধ থাকায় কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। কবে থেকে বাস চলাচল শুরু হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ পরিস্থিতিতে চাপা ক্ষোভের আগুনে পুড়ছেন যাত্রী সাধারণ।
রোববার সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীর স্বজন জানান, শনিবার রাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার কোনো বাহন নেই। অগ্যতা রোগী নিয়ে হাসাপাতালের বারান্দাতেই থাকছেন তিনি। দুপুরে নগরীর কামারপাড়ায় কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজরিন নাহারের সাথে। তিনি বলেন, আমার ক্লাস চলছে। টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল। তিন দিন থেকে আসছি স্ট্যান্ডে। কখন বাস ছাড়বে, কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের রংপুর বিভাগীয় এবং রংপুর জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ জানান, কেন্দ্রীয় সংগঠনের ডাকে পরিবহন ধর্মঘট চলছে। কখন থেকে বাস চলবে, তা আমার জানা নেই। রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান সাইফ (এ সার্কেল) জানান, সড়কে নিরাপত্তা না থাকায় মালিকেরা গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছেন না।
বগুড়া অফিস জানায়, পরিবহন ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে শহর বগুড়া। গত কয়েক দিনের ধর্মঘটে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী কোচ বন্ধের কারণে শহরে জনসমাগম কমে গেছে। শহর অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পড়েছে।

শনিবার থেকে বাস মালিক সমিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর বগুড়া শহরের বাস কাউন্টারগুলোতে তালা ঝুলছে। ঢাকাসহ দূরপাল্লার যাত্রীরা অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তারা জরুরি প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে ট্রেনসহ প্রাইভেট গাড়িতে চলাচল করছেন। এর ফলে কর্মরত মোটর শ্রমিকেরা বেকারজীবন যাপন করছেন। তারা অনেকেই এ ধরনের ধর্মঘটের সাথে একমত নন। তবুও তারা বাস মালিক সমিতির কর্মসূচি পালন করছেন। রোববার বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া কোচ টার্মিনাল, চারমাথাস্থ আন্তঃজেলা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে সুনসান পরিবেশ। যাত্রীরা অনেকে বাস কাউন্টারগুলোতে গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
দিনাজপুর সংবাদদাতা জানান, গতকাল রোববার তৃতীয় দিনের মতো দিনাজপুর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশের সাথে সকল প্রকার দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস, কোচ, ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। গত ৩ আগস্ট শুক্রবার সকাল থেকে দিনাজপুরের সাথে ঢাকাসহ সারা দেশের সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ইজিবাইক ও রিকশায় বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করছেন।
দিনাজপুর জেলা মোটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ জানান, দিনাজপুর থেকে সারা দেশের সাথে সকাল প্রকার যানবাহন বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে যানবাহন চলাচল করবে না বলে জানান তারা।
নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, গতকাল রোববার তৃতীয় দিনের মতো নোয়াখালীতে বাস চলাচল করেনি। গত শুক্রবার ও শনিবার জেলার অভ্যন্তরীণ বাসগুলো চলাচল করছিল। কিন্তু গতকাল থেকে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। সিএনজি ইজিবাইক চলাচল করেছে। এগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাস চলাচল না করায় জেলার ৯টি উপজেলার হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান, পঞ্চগড়েও চলছে পরিবহন ধর্মঘট। শ্রমিকেরা শনিবার যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রাখলেও গতকাল রোববার ভোর থেকেই তারা আন্তঃজেলার সব ক’টি রুটে যাত্রীবাহী বাসসহ সকল যানবহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। পঞ্চগড় জেলা মোটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, চালকেরা গাড়ি চালাতে ইচ্ছুক নন। তিনি বলেন, এটা কোনো ধর্মঘট না এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কোনো দিকনির্দেশনাও নাই। আমরা আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়ি চালাচ্ছি না।
এ দিকে সড়ক মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় চাপ পড়েছে ট্রেনের ওপর।
বান্দরবান সংবাদদাতা জানান, পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বান্দরবানে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও যান চলাচল করছে না। এমনকি হালকা যানবাহনও চলাচল করছে না। ফলে জনসাধারণ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। স্কুল- কলেজের ছাত্রছাত্রী ও রোগীদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। সকালে বান্দরবান কেরানীরহাট সড়কের সুয়ালক এলাকায় পরিবহন শ্রমিকেরা কিছু যানবাহন আটকালে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।
বান্দরবান বাস মালিক সমিতির নেতা ঝন্টু দাশ জানান, কেন্দ্রের নির্দেশে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
শরীয়তপুর সংবাদদাতা জানান, বাস ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে শরীয়তপুরের সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাত্রীরা বেবি, টেম্পো ও অটোরিকশায় যাতায়াত করলেও সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে পারছেন না। রোববার ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে শরীয়তপুর থেকে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। ফলে সারা দেশের সাথে জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।
শরীয়তপুর আন্তঃজেলা বাস ও মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক চৌকিদার বলেন, গাড়ি ভাঙচুর এবং শ্রমিকদের মারধর করার শঙ্কায় বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গাড়ি চলাচল শুরু হবে।

মেহেরপুর সংবাদদাতা জানান, মেহেরপুরের পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। এ দিকে ট্রাক ও ট্রাংকলরি চলাচল বন্ধ থাকায় সবজি ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। মেহেরপুর জেলা ট্রাক ও ট্রাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আলিকদর জানান, নিরাপত্তার অভাবে চালকেরা গাড়ি চালাচ্ছেন না।
মেহেরপুর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান জানান, কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের সিদ্ধান্তে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত বাস চলাচল বন্ধ থাকবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা জানান, গতকাল তৃতীয় দিনের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থেকে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। এ দিকে জেলা শহরের ভাদুঘর পৌর বাস টার্মিনালের সামনে আন্দোলনরত বাস শ্রমিকেরা রাস্তায় এসে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলে বাধা দেন। এতে পণ্যবাহী বিভিন্ন যানবাহন সড়কের দুই পাশে আটকা পড়েছে।
ভাদুঘর পৌর বাস টার্মিনালের পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, বাস ও চালকদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেননি কেউ।
জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: সেলিম মিয়া জানান, বাস ও চালকদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাস না চালানোর জন্য কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নির্দেশনা রয়েছে। পাশাপাশি চালকরাও বাস চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করবে না।

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রোববার সকাল থেকে কোনো ধরনের গণপরিবহন চলাচল করেনি। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে শত শত কর্মজীবী মানুষকে। সপ্তাহের প্রথম দিন হওয়ায় অনেকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হলেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করলেও ভাড়া গুনতে হয়েছে প্রায় ৭-৮ গুণ বেশি।
চট্টগ্রাম জেলা বাস মিনিবাস হিউম্যান হলার মালিক সমিতির সভাপতি রফিক উদ্দিন বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা সড়কে গাড়ি চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছি।
বড়াইগ্রাম (নাটোর) সংবাদদাতা জানান, নাটোরের বড়াইগ্রামসহ পাশর্^বর্তী উপজেলাগুলোতে টানা তিন দিন ধরে অঘোষিত বাস ধর্মঘট চলছে। ধর্মঘটে ঢাকাসহ সারা দেশের সাথে এ এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তিসহ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
জালশুকা গ্রামের মকবুল হোসেন জানান, ডাক্তার দেখাতে রাজশাহী যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় কোনো বাস না থাকায় ফিরে আসতে হলো। সুফিয়া বেগম জানান, দুই দিনের জন্য ঢাকা থেকে বাবার বাড়িতে এসেছিলাম। কিন্তু এখন কোনো বাস না পাওয়ায় ফিরে যেতে পারছি না। বনপাড়া বাইপাসের সামি-জনি পরিবহনের টিকিট মাস্টার বাবু জানান, রাস্তায় ভাঙচুর করাসহ লাইসেন্স চেকের নামে চালক- হেলপারদের নাজেহাল করায় তারা বাসসহ অন্যান্য যানবাহন বন্ধ রেখেছেন।
পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, পূর্বঘোষণা ছাড়াই গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১৯ রুটের সব ধরনের গণপরিবহন উধাও হয়ে যাওয়ায় দূরপাল্লার ও স্থানীয় যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়কে দাঁড়িয়েও কোনো গণপরিবহনের দেখা মেলেনি।

মোড়ে মোড়ে পরিবহন শ্রমিকদের অবস্থান থাকায় নিজস্ব বাহন নিয়েও অনেক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি বিপাকে পড়েন। তবে সিএনজি অটোরিকশায় শহর থেকে কর্মস্থলে আসা আবার ফিরে যাওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়েছে সবাইকেই। কবে নাগাদ পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হবে এ প্রশ্নে আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: জহির ও সাধারণ সম্পাদক মো: মুছা বলেন,আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/339166