৬ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ১০:৪৬

জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন প্রয়োজন

আমাদের ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন রাজপথে ন্যায়বিচার চেয়ে গলা ফাটাচ্ছে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকার এমন কায়েমি স্বার্থের শেকলে বাঁধা পড়েছে যে, তার পক্ষে আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি সুবিচার করা কিংবা তাদের ও আমাদের জীবন নিরাপদ করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে তা কেমন করে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হয় তা তাদের জানা নেই; তারা কেবল জানে জনপ্রিয় দাবি-দাওয়া কেমন করে পুলিশি শক্তি প্রয়োগ করে দাবিয়ে রাখতে হয়। জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারি ব্যর্থতার এটাই প্রধান কারণ এবং এটাই চরম উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে কিশোর ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করা হচ্ছে। তাদের অনেককে গুরুতরভাবে আহত করা হয়েছে। সরকারের শুভচিন্তার লক্ষণ দেখছি না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নেই।
বেপরোয়া গাড়ি চালানো থামছে না। গত শনিবার গাজীপুর ও নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনে লিপ্ত, তার মধ্যে ৪ আগস্ট সাভারে এবং রাজধানী ঢাকার প্রান্ত সীমানায় বাসের ধাক্কায় আরও পাঁচটি মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এখন এটি সবার কাছে পরিষ্কার, পচন বহুদূর ছড়িয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

আমরা তো আমাদের সন্তানদের রাস্তায় একাকী ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের শক্তিকে যুক্ত করতে হবে আমাদের সন্তানদের শক্তির সঙ্গে; তারপর যেতে হবে সুদীর্ঘ কঠিন পথ এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে সরকারি কর্মকাণ্ডে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ। জনজীবনে বিরাট ভুলভ্রান্তি হয়েছে অথচ অগ্রজ হিসেবে অসহায় রয়ে গেছি এবং তা প্রতিরোধে আমরা ঐক্যবদ্ধ কোনো ভূমিকা রাখিনি। দুর্নীতি আর সরকারি অপশাসনে পরিবহন সেক্টরে কীভাবে বছরের পর বছর ধরে সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে সেটা দাসসুলভ চাটুকারিতায় অভ্যস্তরা দেখতে পাননি। এ গভীর সংকটের যে সহজ সমাধান নেই, হয়তো তারা সেটিও স্বীকার করবেন না। তাই সরকার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিচার পাওয়ার জন্য এবং জনগণের কাছে সরকারি কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার দরকার, তা নিয়ে গুরুত্বসহকারে পুনর্ভাবনা করা জরুরি হয় পড়েছে।

জনগণের নেতা হিসেবে জনগণকে সেবা করা যে ক্ষমতাসীনদের অবশ্য করণীয় অথবা ক্ষমতায় থাকলে যে সরকার পরিচালনায় যোগ্যতা দেখাতে হয়, এ দুটি ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের পেছনে যে কারা রয়েছেন, পর্দার আড়ালে থাকা সেই নেপথ্যের লোকদের আমরা দেখতে পারছি না। অন্যরা যখন সর্বত্র অপশাসন এবং দুর্নীতির ছড়াছড়ি দেখতে পান, তখন নিজেদের ভেতরে নেতৃত্বকে প্রশংসা করার প্রতিযোগিতায় নেমে তাকে সফল প্রমাণ করা যায় না। আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম অভিশাপ হচ্ছে চাটুকারিতা। সবসময় যে ব্যক্তিস্বার্থে চাটুকাররা চাটুকারিতা করে তা কিন্তু নয়, বদঅভ্যাসের কারণেও তারা এটি করে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে তারা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে চান না।
চাটুকারিতা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খেদের সঙ্গে এ বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন যে, আমরা বাঙালি থেকে গেছি, মানুষ হতে পারিনি। সৎ চিন্তা সহজে মাথায় আসে না।
মিথ্যাচার এবং প্রতারণা আমাদের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার সহজাত প্রবণতা। যারা দায়িত্বশীল নেতা তাদের প্রত্যেককে এসব লোক সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ, তারা জটিল সমস্যাবলির সমাধান একজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে থাকেন।

সড়কে বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ অনেকদিন ধরেই চলছে এবং নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া পুলিশ সহজেই যে কাউকে ক্রসফায়ারে ফেলতে পারছে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও আমরা মেনে নিয়েছি। নিখোঁজ হওয়াটাও এ সময়ের কঠিন বাস্তবতা। বাস-ট্রাকের চাকার নিচে জনগণ নিয়মিত তাদের জীবন হারাচ্ছে। এমনকি আমাদের সন্তানরা যখন ঢাকার রাস্তায় বন্ধুদের জীবন হারানোর ঘটনায় কাঁদছে, তখনও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে জীবনহানির ঘটনা ঘটেছে। আসলে অন্যের জীবনের কোনো মূল্য নেই। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে আসে না।

সহজে অর্থ কামাই করার লোভ এবং যোগ্যতার অভাবের কারণে সরকারি অব্যবস্থাপনার শেকড় অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। ভুল শুধরানোর ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে; কিন্তু সরকার কোনো কথা কানে তোলেনি, বরং স্বীয় অবস্থানে অটল থেকেছে। আমরা কেউ কিছু নই। আসল সত্য হচ্ছে পরিবহন খাত দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সঙ্গে থাকা সরকারের এবং বাইরের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে সর্বদা উদাসীন থেকেছে। তাদের কাছে অর্থ উপার্জনের ব্যবসাটাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। শোনা যায়, পরিবহন খাত থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন হয় কয়েকজনের মধ্যে।
দুর্নীতি করার জন্য যোগাযোগ খাতের সর্বস্তরে একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। অবশ্য একই কাজ করার জন্য এরকম শক্তিশালী নেটওয়ার্ক অন্যান্য মন্ত্রণালয়েও আছে। তাই সামগ্রিকভাবে সরকার পরিচালনার ব্যাপারটি পরিণত হয়েছে দুর্নীতির ব্যবসায়। জনগণের কাছে সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই। মন্ত্রিসভার সদস্যরাও জানেন যে, তারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের মন্ত্রী নন।
এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে আমাদের পক্ষে যোগ্য, দক্ষ এবং সংগঠিত সরকার পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক যাই হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু মিথ্যুক আর মোসাহেবদের প্রশংসা পেয়েই মনে করেন তার পক্ষে বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। সরকারকে এভাবেই বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
ঘাতক বাস-ট্রাক সড়কে জীবনহানি ঘটিয়ে আজ যে সংকটের সৃষ্টি করেছে সেটা মূলত সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের সংকট। তাই সরকারকে জনগণের সরকারে রূপদান করা ছাড়া সংকট মুক্তির আর কোনো বিকল্প নেই।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/77489