বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের মদদপুষ্ট ছাত্রলীগের হামলায় গতকাল শনিবারও রাজধানী ছিল অচল। হামলার ফলে সৃষ্ট সংঘর্ষে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানে আহত হয়েছে শতাধিক ছাত্র। এ ঘটনার পর ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয় লক্ষ্য করে ছাত্ররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ছাত্র হত্যা ও ধর্ষণের গুজব বারবার ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি সদস্যরা সেখানে অভিযান চালায়। সাদা পোশাকের কিছু যুবককে ঘটনাস্থলে লাঠি হাতে মহড়া দিতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সপ্তম দিনের মতো রাজধানী ছিল অচল। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলা শহরেও ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে। কোথাও কোথাও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়।
ধানমন্ডি রণক্ষেত্র : দুপুরের পর দফায় দফায় সংঘর্ষে রাজধানীর ধানমন্ডি, ঝিগাতলা ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বেলা ১১টার পর থেকে ওই এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। তারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় জড়ো হয়ে রাস্তার দখল নেয় এবং সেখানে যানবাহনের লাইসেন্স চেক করে। বেলা দেড়টায় ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোড থেকে বের হয়ে ১০-১২ জন যুবক লাঠি হাতে ছাত্রদের ধাওয়া করে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এ সময় বেশ কয়েকজন ছাত্র লাঠি পেটায় আহত হয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে ধানমন্ডির দিকে যায়। এ সময় তারা ঝিগাতলা ও ধানমন্ডির ৩ নম্বর রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। বেলা ৩টায় আবারো কিছু লাঠিধারী যুবক ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। তখন কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দও শোনা গেছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। ঘটনার সময় লাঠিপেটায় বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাঠিপেটা ও ইটপাটকেলে শতাধিক ছাত্র আহত হয়েছে। ছাত্ররা অভিযোগ করেছে, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এই খবরে ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোডের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে গিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ছাত্ররা। তখন পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজিবি সদস্যরা তখন লাঠিধারী যুবকদের ধাওয়া করে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়। আর ছাত্রদের সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে আটকে রাখে। এ সময় সেখানে বেশ কয়েকজন মিডিয়া কর্মীকে পিটিয়ে আহত করে ওই যুবকেরা। তারা কয়েকটি মিডিয়ার ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। ঘটনার পর থেকে সেখানে অবস্থান করে শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ৭টায় আবারো লাঠিধারী যুবকেরা ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা খুঁজে খুঁজে ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়। কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা এই দৃশ্য ধারণ করতে গেলে তাদের ক্যামেরা কেড়ে নেয়া হয়।
বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার পর রাস্তায় নামে। আসাদ গেটে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে রাস্তা দখল করে। সেখানে তারা যানবাহনের লাইসেন্স ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে। উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। একপর্যায়ে তারা বিমানবন্দরের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ করে দেয়। এ সময় সেখানে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। শাহবাগ এলাকায় ছাত্ররা জড়ো হয়ে লাইসেন্স চেক করে। বেলা ১টায় শাহবাগে জাতিসঙ্ঘ মিশনের একটি গাড়ির কাগজপত্র চেক করার চেষ্টা চালালে চালক তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তখন সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা ওই গাড়ির একটি লুকিং গ্লাস ভেঙে ফেলে। পরে পুলিশ গাড়িটি নিয়ে শাহবাগ থানায় চলে যায়। পরে জাতিসঙ্ঘ মিশনের কর্মকর্তারা থানায় গিয়ে গাড়িটি নিয়ে যান। ফার্মগেট এলাকায় ছাত্ররা জড়ো হয়ে সেখানে যানবাহন তল্লাশি করে। এভাবে তেজগাঁও, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, বাসাবো, শান্তিনগর, মালিবাগ, মানিকনগর, মতিঝিল, টিকাটুলি ও কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে।
ছাত্রলীগের মহড়া : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল ছাত্র বিক্ষোভের বিপক্ষে ছাত্রলীগের অবস্থান লক্ষ করা গেছে। যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের সাথে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মহড়া দিতে দেখা গেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সরকার সমর্থকেরা সায়েদাবাদ জনপদ মোড়, জয়কালী মন্দির, হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে, কাজলা, দনিয়া, শনির আখড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। বিকেলে বিজয় সরণি এলাকায় দেখা যায় কিছু যুবক জড়ো হয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। এ ছাড়া কবি নজরুল কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ রাস্তায় নামে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
একের পর এক গুজব : এ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক নারীকে দেখা যায় ফেসবুক লাইফে এসে ছাত্র হত্যার কথা প্রচার করছে। একই সাথে প্রচার করছে ছাত্রী ধর্ষণের কথা। দুপুরের পর থেকে এই গুজব সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে।
গাড়িতে লিখে দেয়া হয় ওকে : ছাত্ররা বিভিন্ন স্থানে গাড়ি চেক করে যেসব গাড়ির লাইসেন্স নেই বা চালকের লাইসেন্স নেই সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে পুলিশকে মামলা নিতে বাধ্য করে। আবার যেসব গাড়ির কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে সেসব গাড়ির সামনের গ্লাসে ওকে লিখে দিচ্ছে। মতিঝিলে বিক্ষোভরত এক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, একাধিক স্থানে যাতে কাগজপত্র দেখাতে না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
রমিজ উদ্দিন কলেজকে ৫টি গাড়ি প্রদান : প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য পাঁচটি গাড়ি প্রদান করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে গতকাল এই গাড়িগুলো হস্তান্তর করা হয়।
রাস্তা ছিল ফাঁকা : অবরোধের কারণে গতকালও রাজধানী ছিল ফাঁকা। রাস্তায় পাবলিক বাস খুব একটা চলাচল করতে দেখা যায়নি। অনেকে ব্যক্তিগত গাড়িও রাস্তায় বের করেননি। যারা রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন তাদের কেউ কেউ বিড়ম্বনায় পড়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গণপরিবহনের জন্য শত শত মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দু-একটি গাড়ি এলেও তাতে ঠাঁই হয়নি অনেকের। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করেনি। পরিবহন শ্রমিকেরা বলছেন নিরাপত্তার কারণে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুলাই দুপুরে ছুটির পরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম ওরফে সজীব এবং একই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিম নিহত হন। তারা রাস্তার পাশে ফুটপাথে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এই ঘটনার পর ৯ দফা দাবিতে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলোর সাথে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবিও পরে যুক্ত হয়।