জিগাতলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষ। ছবি: যুগান্তর
৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:২৯

গুলি সংঘর্ষ টিয়ার শেল

শতাধিক আহত, ১০ জনের অবস্থা গুরুতর * গণপরিবহন উধাও, চরম দুর্ভোগ * সন্ধ্যার পর মোবাইল ইন্টারনেটের গতি হ্রাস * আজও রাজপথে নামার ঘোষণা

নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ এবং ঘাতক বাসচালকের ফাঁসিসহ ৯ দফা দাবিতে শনিবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে নানা সহিংস ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর ঝিগাতলা, ধানমণ্ডি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একদল যুবকের সংঘর্ষ হয়। এদের মধ্যে অনেকেই হেলমেট পরা ছিল। তারা ফাঁকা গুলি করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সবমিলিয়ে শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডির ঝিগাতলা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষার্থী-পথচারীসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে নিলয় নামের এক শিক্ষার্থীসহ ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। আহতদের ঢাকার পপুলার এবং জাপান ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। ধানমণ্ডিতে হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যার পর প্রগতি সরণির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান ফটকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নতুন করে অবরোধ করে। পরে অবশ্য একদল যুবকের হামলার মুখে তারা চলে যায়। আন্দোলনের মধ্যে সন্ধ্যার পর মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
শিক্ষার্থীরা দিনভর ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখে। আন্দোলনের সপ্তম দিন শনিবার ঢাকার অন্তত ২০টি পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে। সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের ওই অবস্থানের কারণে গোটা রাজধানী অচল হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে শিক্ষার্থীরা এদিনও আন্দোলনে নামে। সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের অবস্থান অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ছিল। পাশাপাশি গত কয়েক দিনের মতো শনিবারও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন যানবাহন ও চালকের লাইসেন্স এবং কাগজপত্র যাচাই করে। তবে দুপুরের পর ঢাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। ঝিগাতলা ও ধানমণ্ডি এলাকায় এ সংঘর্ষ হয়। এর আগে আওয়ামী লীগদলীয় সভানেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে স্কুল ড্রেস পরে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় বলে দলীয় নেতারা অভিযোগ করেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহর থেকে আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রী ও অভিভাবকদের লাঞ্ছনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলমান এ আন্দোলনের মধ্যেই শনিবার গাজীপুরে রাস্তা পারাপারের সময় সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রীকে বেপরোয়া কাভার্ড ভ্যান পিষে যায়। ঘটনাস্থলেই নির্মম মৃত্যু হয় তার। শিক্ষার্থীদের কাছে ওই খবর পৌঁছালে বাড়তি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন ঘিরে রাজধানীতে এক ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে বিকালে ধানমণ্ডিতে হামলার ঘটনার পর উত্তেজনা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর রোডে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ঘটনার পর থেকে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ এবং ঘাতক বাসচালকের ফাঁসিসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের কারণে এদিনও ঢাকার গণপরিবহন বন্ধ ছিল। ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীমুখী দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে সড়কপথে দেশের অন্য শহর থেকে রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আন্দোলন ঘিরে এদিন নানা গুজবও রটে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্দোলন উসকে দেয়ার মতো নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে এদিন অভিযোগ উঠে।
এদিকে সন্ধ্যার পর মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে এমন ঘটনা নিয়েও নানা গুজব রটে। তবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তরফে বলা হচ্ছে, মোবাইল ইন্টারনেটের থ্রিজি থেকে ফোর-জিতে রূপান্তর সংক্রান্ত কাজের প্রয়োজনে সাময়িক সময়ের জন্য ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্রাহকরা টুজি মানের সেবা পাবেন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আন্দোলন সামাল দিতে পুলিশের সুপারিশে ইন্টারনেটের গতি কমানো হয়। কেননা ফেসবুক ব্যবহার করে আন্দোলনের প্রচার ও গুজব রটানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি মোবাইল অপারেটররা। বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক ইন্টারনেটের গতি কমানোর সিদ্ধান্তের বিষয়টি নাকচ করেননি ।
ঢাকায় গণপরিবহন না থাকায় এবং দূরপাল্লার বাস চলাচল না করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তবে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন অসুস্থ ও বিদেশগামীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, তারা রাজপথে আছেন। যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলন করছে। আজও রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
সরেজমিন দেখা গেছে, শনিবার সকাল থেকে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, নিউমার্কেট, বনশ্রী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, শান্তিনগর, মতিঝিল, খিলক্ষেত, ভাটারা, বাড্ডা, উত্তরা, গুলশান, কাকরাইল, বেইলি রোড, মিন্টো রোড, শান্তিনগর, ফার্মগেট যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেয়। সিটি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা কলেজ, ধানমণ্ডি আইডিয়াল, উইলস ফ্লাওয়ার, নটর ডেম কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, হাবিবুল্লা বাহার কলেজ, উত্তরা ও মিরপুর এলাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। স্কুল-কলেজের পোশাক পরে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে রাস্তা অবরোধ করে তারা। সকালের গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, দুপুরের ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা সপ্তম দিনের মতো এ আন্দোলনে অংশ নেয়। তবে এদিন আন্দোলনকারী শিক্ষার্র্থীরা যানবাহন বন্ধ না করে রাজধানীজুড়ে শৃঙ্খলা ও লেন অনুসরণ করে গাড়ি চলাচলে সহায়তা করেছে। পাশাপাশি লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করেছে। এদিন উল্টোপথে তেমন গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে শাহবাগ থেকে বাংলামোটর যাওয়ার সময় রেলমন্ত্রীর গাড়ি আটকে দেয় শিক্ষার্থীরা। গাড়িতে অসুস্থ মেয়ে রয়েছে জানালে মন্ত্রীর গাড়ি ছেড়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। শাহবাগে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের মিষ্টিমুখ করিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দেন তারা। এদিকে আন্দোলনের সপ্তম দিনে এসেও আন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, আজ থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করবে পুলিশ। এ সময় গাড়ির চালকের লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটকসহ ট্রাফিক আইনে যা যা করণীয় সব করা হবে।
রণক্ষেত্র ধানমণ্ডি : শনিবার শান্তিপূর্ণভাবেই কর্মসূচি শুরু হয়। কিন্তু দুপুরের পর থেকে অবস্থা পাল্টাতে থাকে। ঝিগাতলা, ধানমণ্ডি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে দু’পক্ষই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া দেয়। মাথায় হেলমেট পরা এক দল যুবক শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে মারধর করে। রাজধানী ঢাকার জিগাতলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গেটের কাছে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি হাতে হামলা চালিয়েছে একদল যুবক। তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছোড়ে। এ যুবকদের মাথায় হেলমেট ছিল। শনিবার দুপুর ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে ওই এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুপুর ২টার দিকে বিজিবি গেটের সামনে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ওপর হঠাৎ করে হেলমেট পরা, লাঠি হাতে ২৫ থেকে ৩০ জনের একদল যুবক হামলা চালায়। শিক্ষার্থী ও হামলাকারীরা একে অপরের দিকে ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী একজনকে আওয়ামী লীগের এক কর্মী ধরে নিয়ে গেছে এবং আন্দোলনকারী চার ছাত্রীকে আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডির কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছে, চোখ তুলে নেয়া হয়েছে এক শিক্ষার্থীর এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ছাত্ররা হঠাৎ করে ঝিগাতলা মোড় থেকে ধানমণ্ডির দিকে যেতে থাকে। তখন হেলমেট পরা যুবকদের দলটি তাদের বাধা দেয়। ছাত্ররা বাধা না মানলে বাকবিতণ্ডা হয়। ছাত্রছাত্রীরা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পার্টি অফিসের নেতাকর্মীরাও তাদের বাধা দেয়। হেলমেট মাথায় যুবকদের ওই দলটি শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। শিক্ষার্থীরাও তাদের পাল্টা ধাওয়া করে। বিকাল ৫টার দিকে আম্বালা হোটেলের সামনে থেকে স্টার কাবাবের দিকে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি ইট ছুড়তে দেখা যায় হেলমেট পরা ওই যুবকদের। তাদের মধ্যে একজনকে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে দেখা যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেল ছোড়ে। এ ঘটনায় পথচারীসহ অন্তত শতাধিক আহত হয়। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল সমন্বয়ক ডা. মোহাম্মদ ইশতিয়াক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, আহত ৪০ থেকে ৫০ জনকে এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের সরকারি মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা চিকিংসা নিয়ে চলে গেছে। এদিকে রাজধানীর জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে ডা. দুলাল চন্দ্রশীল জানান, এ পর্যন্ত ৪০ জনের মতো চিকিংসা নিয়েছে। এদের মধে ১৩ জনকে এক্সরে করা হয়েছে, দু’জনকে অন্যান্য পরীক্ষা করা হয়েছে। বর্তমানে তিনজন ভর্তি আছে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিক থেকে কয়েকজন যুবককে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে কয়েকজন এসে পুলিশের সঙ্গে পুরো কার্যালয় ঘুরে দেখে। তারপর আওয়ামী লীগ কার্যালয়েই সংবাদ সম্মেলন করে ওই শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের একজন ঢাকা আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী কাজী আশিকুর রহমান তূর্য বলেন, দুপুরের পর হঠাৎ কিছু লোক এসে বলে, আমাদের চারজন বোনকে আর ক’জন ছেলেকে আওয়ামী লীগ অফিসে আটকে রাখা হয়েছে। পরে আমাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে চলে আসে। আমরা আওয়ামী লীগ অফিসে এসে দেখলাম এমন কিছু ঘটেনি। সেখান থেকে বেরিয়ে তূর্য আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের মেরে ফেলা ও আটকে রাখার যে তথ্য আমরা পেয়েছিলাম, তা গুজব। আপনারা কেউ গুজবে কান দেবেন না। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ধানমণ্ডিতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
শাহবাগে চকলেট দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ছাত্রলীগের : বেলা ১১টার দিকে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে স্লোগান শুরু করে তারা। ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি চলাচল বন্ধ না করার অনুরোধ করে। শিক্ষার্থীরা পুলিশের অনুরোধ মেনে যানবাহন চলাচল করতে সহায়তা করে। লাইসেন্স যাচাইয়ের পাশাপাশি লেন অনুসরণ করে চালকদের গাড়ি চালাতে বাধ্য করে। চালকরা যেন বারবার হয়রানি না হয় এজন্য শিক্ষার্থীরা একটি অভিনব পদ্ধতি অনুসরণ করে। লাইসেন্স যাচাই করে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হাতের বৃদ্ধাঙুলে মার্কার দিয়ে দাগ দিয়ে দেয়। পরে তল্লাশিতে এ দাগ দেখালে ছেড়ে দেয়া হয় তাদের।
এ সময় শিক্ষার্থীরা এক পুলিশ সদস্যের গাড়ির লাইসেন্স না থাকায় মামলা করে। লাইসেন্স যাচাইয়ের সময় এক ব্যক্তির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বেপোরোয়াভাবে গাড়ি চালনোয় এক অ্যাম্বাসির গাড়ি ভাংচুর করে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে শিক্ষার্থীরা। এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য চকলেট নিয়ে গিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর কোনো ধরনের আঘাত হানা হবে না বলেও আশ্বস্ত করেন তারা। কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চড়াও হওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে শাহবাগে যান সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। বিকাল ৪টার দিকে শাহবাগ মোড় থেকে চলে যায় শিক্ষার্থীরা।
সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের শিক্ষার্থী মদিনা আক্তার বলেন, আমরা নেতা হতে নয়, ন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। দাবি আদায় না হলে ঘরে ফিরব না। আমার সঙ্গে আমার মাও এ আন্দোলনে এসেছেন। সলিমুল্লাহ কলেজের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ যুগান্তরকে জানান, আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই।
ভাটারা, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, শান্তিনগর ও মতিঝিল : কুড়িল থেকে রামপুরা ব্রিজ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মূল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। এতে রাস্তার এক পাশ বন্ধ হয়ে যায়। অন্য পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। শনিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে রামপুরায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার চেষ্টা করে একদল দুর্বৃত্ত। এ সময় শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে হামলার চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেয়। এদিকে প্রগতি সরণি এলাকায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তরায় জাতীয় সঙ্গীত গেয়েই সড়ক ছাড়ল শিক্ষার্থীরা : জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে শনিবার সকাল ১০টায় উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় রাজপথ অবরোধ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ৬ ঘণ্টা পর বিকাল ৪টার দিকে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েই রাজপথ ছেড়ে দেয় তারা। রাজপথ ছেড়ে দেয়ার আগে তারা রোববারের কর্মসূচি ঘোষণা করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টার দিকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলে, আজকের (শনিবার) মতো কর্মসূচি স্থগিত করা হল। আমরা এখন রাজপথ ছেড়ে দেব। আজ (রোববার) সকাল ৯টায় আমরা আবারও রাজপথে নামব। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না। এদিকে বিকাল ৪টার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
মিরপুরে ছিল টানটান উত্তেজনা : শনিবার মিরপুরে দিনভর বিরাজ করছিল উত্তেজনা। শেষদিকে আক্রমণের গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করেছিল অনেকেই। এ সময় বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরতে শুরু করে। আন্দোলনকারীরা বেলা ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত গোল চত্বরে অবস্থিত পুলিশের পল্লবী জোনের ট্রাফিক সহকারী কমিশনারের অফিস ঘিরে রাখে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের পাশাপাশি গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের উৎসাহিত করে। আজ সকালে তারা আবার রাস্তায় নামবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সরেজমিন মিরপুর ২, ১০, ১১, ১২ এবং ১৩ নম্বর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা যাতে রাস্তায় নামতে না পারে সেজন্য সকাল থেকেই মিরপুর এলাকার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা অলি-গলিতে অবস্থান নেয়। বেলা ১১টার দিকে মিরপুর ২ নম্বর থেকে একটি মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা ১০ নম্বর গোল চত্বরে এলে দুর্বৃত্তরা সটকে পড়ে। মিরপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একের পর এক মিছিল এসে যোগ দেয় মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে। তারা নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। অনেকে জাতীয় পতাকা মাথায় এবং গায়ে জড়িয়ে আসে। একপর্যায়ে ওই এলাকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে অ্যাম্বুলেন্স, রোগীবাহী যানবাহন, নারী-শিশুদের গাড়ি এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ জরুরি সেবার যানবাহনের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল দেখা গেছে আন্দোলনকারীদের।
রাজধানীতে ১১ মামলা : আন্দোলনের ঘটনায় গত ৭ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাসমালিক সমিতি বাদী হয়ে মামলাগুলো করেন। মামলার মধ্যে মতিঝিলে তিনটি, পল্টনে দুটি, রামপুরায় একটি, ক্যান্টনমেন্টে দুটি এবং নিউ মার্কেট থানায় দুটি।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/77171/