৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:২৭

ওষুধের দাম বাড়াতে লাগে না কারণ

দাম বেড়েছে কিনা জানে না অধিদফতর * প্রয়োজন আইন সংশোধন ও কমিউনিটি ফার্মেসি-বিশেষজ্ঞ * সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে : ড্রাগিস্ট সমিতি

কোনো কারণ ছাড়াই সারা বছর ধরে বাড়ে ওষুধের দাম। প্রায় ২৪ বছর আগের একটি নির্দেশনার বলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো বাড়ায় তা। বিধি অনুযায়ী দাম বাড়ানোর বিষয়টি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে জানানোর কথা। কিন্তু কোনো ওষুধের দাম বেড়েছে কিনা এমন তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে। এমনকি প্রশাসনের ওয়েবসাইটে যে টেবিলে ওষুধের মূল্য সম্পর্কিত তথ্য থাকার কথা সেখানে নেই এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য। এভাবে কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ রোগীরা। চিকিৎসায় ব্যয় বাড়ে।
ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো ভূমিকা না থাকায় কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়তে থাকে। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভূত ওষুধের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। সেই নির্দেশনার বলে ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে যে কোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের ছিল। ’৯৪-এর আদেশের পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধের দাম ঠিক করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে জানায়। ওই দাম নির্ধারণ করার যুক্তিও তারা তুলে ধরে। ২৪ বছর ধরে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো যে দাম চাইছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সেই দামেই বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। ফলে ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি থেকে যাচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রের বাইরে।
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি ও ওষুধের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে নিউরোলজি, হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস এমনকি অস্ত্রোপচারের জন্য যেসব ওষুধের প্রয়োজন সেগুলোর দাম বেড়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর অ্যাজমাসল (২০০)। আগে ওষুধটির দাম ছিল ১৯৫ টাকা, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩০ টাকা। একইভাবে স্কয়ারের নিউরো-বি ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, নিউরো ক্যাল ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা, রসুভাস (১০) ১৫০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা, রসুভাস (৫) ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টোসার ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা, অ্যাডোভাস ৫৫ টাকা থেকে ৬৫ টাকা ইত্যাদি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দাম বাড়িয়েছে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোও।
ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসভাপতি আবদুল হাই যুগান্তরকে বলেন, সারা বছরই কিছু কিছু ওষুদের দাম বেড়েছে। তবে মে-জুন মাসের দিকে বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক, হার্টের ওষুধ, প্রেসারের ওষুধ, ভিটামিন কিছুই বাদ যায়নি। তিনি বলেন, একটি কোম্পানি কোনো ওষুধের দাম বাড়ালে সবাই লাগাতারভাবে বাড়াতে থাকে। দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে কোম্পানির লোক বলেন, দাম বাড়ানো হয়নি সমন্বয় করা হয়েছে। দোকানিরাও দাম বাড়ায় এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো ওষুধের গায়ে দাম পরিবর্তন করতে পারি না। ওই কাজটা কোম্পানিই করে থাকে।
তবে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে কিনা জানে না ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। অধিদফতরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া ও মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনকে না জানিয়ে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয় না। ওষুধের দাম বাড়ানো হলে আমরা অবশ্যই জানতাম। তাছাড়া দাম বাড়াতে হলে প্রাইস ফিক্সেশন কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হয়। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে। ওয়েবসাইটে ‘সার্র্চ প্রাইস’ একটি বার রয়েছে। সেখানে ক্লিক করলে একটি পাতা আসে। পাতায় সার্চবার থাকলেও নিচে লেখা রয়েছে ‘নো ডাটা অ্যাভাইলেবল অন টেবিল’। ওয়েবসাইটে তথ্য নেই কেন জানতে চাইলে প্রশাসনের পরিচালকদ্বয় কোনো উত্তর দেননি।
১১৭টি ওষুধ সরকারের কাছে রেখে বাকি ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো- এমন প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ৩০ জুলাই হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ আবেদনটি করা হয়। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করবেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি জানান, হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ রিটের ওপর শুনানি হতে পারে। তিনি বলেন, দ্য ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ মতে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সাত শতাধিক ওষুধের মূল্য সরকার নির্ধারণ করত। কিন্তু ১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যেখানে মাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ সরকারের কাছে রাখে। বাকি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। এটা তো আইনের ব্যত্যয়। তাই ওই প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়েছে। আবেদনে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ওষুধ শিল্প সমিতির দাবির ভিত্তিতে ১৯৯৪ সালে সরকার যে নির্দেশনা জারি করে সেটি পরিবর্তন করা যেতে পারে। তাছাড়া ২০১৬ সালে যে ওষুধ নীতি করা হয়েছে সেখানে এ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির আলোকে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ সরকারের হাতে থাকলে কোম্পানি এবং রোগী সবার জন্যই ভালো। তিনি বলেন, তাছাড়া মাঝে মাঝে দোকানিরাও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে থাকেন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি কমিউনিটি ফার্মেসির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সম্প্রতি মডেল ফার্মেসি হচ্ছে। সঠিক দামে নকল, ভেজাল ও অনিবন্ধিত ওষুধ বন্ধ করতে হলে এ ধরনের ফার্মেসি বাড়াতে হবে। কারণ মডেল ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সারা দেশে যেখানে প্রায় আড়াই লাখ ওষুধের দোকান সেখানে মডেল মাত্র ৬৫০টি। এটি পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে মুদিখানার মতো ওষুধের দোকান বন্ধ করতে হবে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/77177/