৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:২৬

ব্যাংকিং খাতে চলছে বহুমুখী বিশৃঙ্খলা

২৬ ব্যাংকে ছাড়িয়েছে ঋণ-আমানত অনুপাতসীমা * ঋণ পাচ্ছেন না ভালো উদ্যোক্তারা

ব্যাংকিং খাতে এখন বহুমুখী বিশৃঙ্খলা চলছে। একদিকে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর ঘোষণা কার্যকর করা নিয়ে জটিলতা, অন্যদিকে এটি কার্যকরে খেলাপি ঋণ কমানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। এ ছাড়া ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের অনুপাত (রেশিও) বা এডিআরে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনাও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে বেশকিছু ব্যাংক এই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বর্তমানে ভালো গ্রাহকরা ঋণ পাচ্ছেন না। এ তালিকায় বর্তমানে ২৬টি ব্যাংকের নাম রয়েছে। যদিও চলতি বছরের শুরুতে বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়া ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ১৮টি।
৩১ জুলাই চলতি বছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ব্যাংকগুলোর এডিআর নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মনিটরিংয়ের পাশাপাশি নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। যাতে নতুন করে কোনো ব্যাংক আর এ সংকটে না পড়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের এমডি যুগান্তরকে বলেন, এডিআর সংকটের মূল কারণ বেনামি ঋণ। বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার মতো বেনামি ঋণ রয়েছে। এটি খেলাপি ঋণের থেকেও ভয়ংকর। খেলাপি ঋণ চেষ্টা করলে আদায় করা যায়। কিন্তু বেনামি ঋণ আদায় করা যায় না। বেনামি ঋণ মূলত প্রভাবশালী উদ্যোক্তা পরিচালকরা নিয়ে থাকেন। ফলে এখানে ব্যাংকের এমডিরাও অসহায় বলে জানান তিনি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঋণ বিশৃঙ্খলার শীর্ষে রয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ ও আমানত এডিআর ছিল ১১২ দশমিক ২০ শতাংশ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী এডিআর সাড়ে ৮৩ শতাংশে সীমিত রাখার কথা ছিল। মূলত দুর্নীতি, অনিয়ম এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ফারমার্স ব্যাংক ঋণ দেয়ার কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক এডিআরের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পুরো খাতের মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে ভালো গ্রাহক এবং যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন তারা বর্তমানে ঋণ পাচ্ছেন না। এভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ১০১ দশমিক ৯৮ শতাংশে। এটিও থাকার কথা সাড়ে ৮৩ শতাংশ। একইভাবে বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের এডিআর ১০২ দশমিক ৪২ শতাংশ। এভাবে ব্যাংক তিনটি চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে খাতটিকে অস্থির করে দেয়।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এডিআর এক সময় ১০৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। এখন সেটা কিছুটা কমে এসেছে। তিনি বলেন, চেষ্টা করছি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে। আমানত পেলেই সেটি সম্ভব হবে।
এ ছাড়া মধুমতি ব্যাংক ৯৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, এবি ব্যাংক ৯২ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ৮৯ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং এনআরবি ব্যাংক ৮৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ এডিআর নিয়ে ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়েছে। এর বাইরে ন্যাশনাল ব্যাংক ৮৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ৮৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ৮৮ দশমিক ৬০ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৮৭ দশমিক ৯২ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ৮৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৮৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংক ৮৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৮৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৮৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ৮৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৮৪ দশমিক ১১ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ৮৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং ঢাকা ব্যাংকের এডিআর ৮৩ দশমিক ৫১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আরও দেখা গেছে, জুন শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ-আমানত রেশিও রয়েছে এক্সিম ব্যাংকের। ব্যাংকটির এডিআর ৯৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ তালিকায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকসহ পাঁচটি ব্যাংকের নাম রয়েছে। সব ব্যাংকই এডিআরসীমা ছাড়িয়েছে। এতে পুরো ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সার্কুলার অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকগুলোর এডিআরসীমা ৮৯ শতাংশ এবং নন-ইসলামী ব্যাংক বা কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোর এডিআরসীমা সাড়ে ৮৩ শতাংশে সীমিত রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু উল্লিখিত ২৬টি ব্যাংক নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্যাংকিং খাতে এ বিপর্যয় নামে। তখন ইসলামী ও কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোর এডিআরসীমা ছিল যথাক্রমে ৯০ ও ৮৫ শতাংশ। সে সময় ১৮টি ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করে এবং ব্যাংকিং খাতে চরম তারল্য সংকটের সৃষ্টি হয়। পরে এডিআরসীমা আরও কমানো হয় এবং দ্রুত এটি সমন্বয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। তিন দফায় এটি সংশোধন করে সর্বশেষ ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে এডিআরসীমা সমন্বয়ের কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় বলা হয়- যে ব্যাংক যে অবস্থানে আছে, তা থেকে নিচের দিকে নামাতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এডিআরসীমা লঙ্ঘনের তালিকা আরও বড় হয়েছে। অর্থাৎ ১৮ থেকে ২৬টি ব্যাংকে এসে দাঁড়িয়েছে

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/77178/