৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:১৭

ধর্মঘটের নামে জনগণকে শাস্তি

গত দুই দিনে যানবাহন ভাঙচুর বা শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন হয় এমন কিছু হয়নি সড়ক-মহাসড়কে। তারপরও টানা চতুর্থ দিনের মতো পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে অচল ছিল পুরো দেশ। আগের তিন রাতে কিছু যাত্রীবাহী বাস চললেও গতকাল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে নৈশকোচ না চালানোর ঘোষণা দেয়া হয়। দূরপাল্লার বাস ও গণপরিবহন না চলায় গতকালও দিনভর চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, ক্ষমতাবান নেতাদের নির্দেশনায় তারা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। গত দু’দিন বাস ছাড়া অন্য ছোট যানবাহন চলাচলে পরিবহন শ্রমিকদের বাধা দিতেও দেখা যায়।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেট দেশবাসীকে শাস্তি দেয়ার জন্য পরিবহন বন্ধ রেখেছে, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি অজুহাত।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘নিরাপত্তাহীনতার’ অজুহাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘট চলছে ঢাকাসহ সারা দেশে। ভাঙচুরের ভয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন না তারা- এমন দাবি মালিকদের। এতে রাজধানী ছাড়াও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে শুক্রবার সন্ধ্যার পর দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু করলেও শনিবার সকালেই ফের তা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ শিক্ষার্থীরা কোথাও গাড়ি চলাচলে বাধা দিয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি।

গতকালও রাজধানীতে গণপরিবহন না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে গন্তব্য গেছেন। মতিঝিল একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন মাহফুজ। থাকেন মোহাম্মদপুর। তিনি জানান, কোনো গণপরিবহন না পেয়ে তিনি রিকশায় চড়ে সকাল ১০টায় অফিসে গেছেন। দেড়শ’ টাকা খচর হয়েছে তার। মোতাছিন বিল্লাহ নামের এক যাত্রী সদরঘাট থেকে মিরপুর-১০-এ যাওয়ার জন্য পরিবহনের অপেক্ষা করছিলেন সদরঘাট। দুপুর ১২টা তিনি কোনো গণপরিবহন না পেয়ে সিএনজি অক্টোরিকশা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছান। সিএনজি চালক ভাড়া নিয়েছেন সাড়ে ৫শ’ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কোনো আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়েনি। বাস মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা বলেছেন, নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা বাস বের করছেন না।

সর্বশেষ শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কিছু গাড়ি চলাচল করেছিল। এরপর থেকে বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকরা। বাস মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঢাকামুখী গাড়ি চালাতেও পথে বাধা পাচ্ছেন তারা। ঢাকার তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী থেকে সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ। টার্মিনালের ভেতরে ও সামনের সড়কে সারি করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন গন্তব্যের বাস। রাজধানী থেকে সকালে দূরপাল্লার কোনো গাড়ি ছেড়ে যায়নি। উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণের জেলাগুলো, সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে সড়কপথে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঢাকার ভেতরও সাধারণ গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে।

যেসব রুটে ঢাকার সঙ্গে ট্রেনের যোগাযোগ আছে সেসব পথে মানুষ ট্রেনে চলাচল করছে। ফলে ট্রেনে ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। গতকাল রাজধানীর ভেতরে কয়েকটি বিআরটিসির বাস চলতে দেখা গেছে। তবে সংখ্যায় খুবই কম। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি ঢাকার ভেতরে চলাচল করেছে। গাবতলী বাস টার্মিনালের হানিফ পরিবহনের ব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন বলেন, প্রতিদিন আমাদের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে গাবতলী থেকে ২৫০টির মতো ট্রিপ থাকে। কিন্তু শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৫০টির মতো ট্রিপ হয়েছে।

ঢাকামুখী কিছু বাস সাভারের কাছে সকালের দিকে বাধা পেয়েছে। ৩রা আগস্ট মহাখালী বাস টার্মিনালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে রাতেও কোনো বাস চলাচল করবে না। গতকালও রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোন বাস ছেড়ে যায়নি। সকাল থেকে বাসের চালক ও হেলপারদের টার্মিনালের মধ্যে আড্ডা দিতে গেছে। টার্মিনাল থেকে কোনো বাস যাতে বের না হতে পারে সেদিকে তাদের কড়া নজরদারি ছিল। এছাড়াও টার্মিনালের মধ্যে আন্দোলনরত কোনো শিক্ষার্থী যাতে না আসতে পারে সেইদিকেও কঠোর নজরদারি ছিল বাসের চালক ও শ্রমিকদের।

গতকাল সকালে সরজমিনে মহাখালীর বাস টার্মিনালে দেখা যায়, দূরপাল্লার বাসগুলো সব টার্মিনালের অভ্যন্তরে সারি করে রাখা আছে। সেখান থেকে যেমন কোনো বাস বের হয়নি তেমনি বাইরের জেলা থেকে কোনো বাস টার্মিনালে আসেনি। অনেক যাত্রী টার্মিনালে এসে ফিরে গেছেন। অনেককে বাস ছাড়ার আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। টার্মিনালের যাত্রী ছাউনিতে বসে থাকা রহমত হোসেন জানান, শুক্রবার কোনো পরিবহন ঢাকা ছেড়ে যায়নি। শনিবার বাস ছাড়বে এই আশায় টার্মিনালে এসেছি। জরুরি কাজে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে যেতে হবে। টার্মিনালের কয়েকজন বাস চালক জানিয়েছেন বাস মালিক সমিতির ধর্মঘট থাকার কারণে বাস কোনো গন্তব্যস্থলে যাবে না। ময়মনসিংহগামী আদর্শ পরিবহনের চালক রিয়াজুল ইসলাম রাজু জানান, বাসের মালিকগণ আমাদের বলেছে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আমাদের বাস নিয়ে সড়কে নামতে নিষেধ করেছেন।

এদিকে দিনভর রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকেও কোনো বাস গতকাল ছেড়ে যায়নি। বাসের আশায় টার্মিনালে গিয়ে ফিরে গেছেন অনেক যাত্রী। সন্ধ্যায় বাস ছাড়তে পারে এমন আশায় অনেকে টার্মিনালে গেলে তারাও আশাহত হন। এদিকে সায়দাবাদ টার্মিনালেও একই চিত্র দেখা গেছে। কোনো ধরনের বাস ছাড়েনি টার্মিনাল থেকে। ওই এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের সড়কে অবস্থান নিয়ে অন্য ছোট যানবাহন চলাচলে বাধা দিতে দেখা যায়। এদিকে দেশের প্রায় সব জেলার বাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল। অনেক জেলায় স্থানীয় সড়কে চলাচল করা বাসও বন্ধ রাখেন শ্রমিকরা

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=129275&cat=2/