৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:১৪

গোড়াতেই গলদ বিতর্ক

গোড়াতেই গলদ! এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র নিয়েই শুরু বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের কাউকে সোয়া তিন হাজার কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিতে মরিয়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। আর তা করতে গিয়ে মাত্র এক মাসের মাথায় এ মেগা প্রকল্পের দরপত্রে দ্বিতীয় দফা সংশোধনী আনা হয়েছে। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে তিনবার। তবে প্রকল্প পরিচালক এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, স্বচ্ছতার ভিত্তিতেই ‘লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের’ টেন্ডার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ ঠিকাদারই নিয়োগ করা হবে। 

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পৌনে তিন বছরের মাথায় সাড়ে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করছে সিডিএ। বিতর্কের মূলে রয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ কতৃক আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করে স্থানীয় দরপত্র আহ্বান করার কারণে। দীর্ঘ এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বাংলাদেশি যথোপযুক্ত ঠিকাদার নেই বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে সিডিএ যুক্তি দেখাচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে স্থানীয় দরপত্র আহ্বান করতে হবে।
প্রথম দফায় দেয়া দরপত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা তিন কিলোমিটার চাওয়া হয়েছিল। বিতর্কের মুখে পরবর্তীতে এ ধারণা থেকে সরে এসে দ্বিতীয় দফা দরপত্র সংশোধন করা হয়। এতে আট কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। এ দরপত্রে প্রয়োজনে বিদেশি কোম্পানি অংশগ্রহণ করতে পারবে উল্লেখ করে বলা হয়, দরদাতা কোম্পানির বাংলাদেশে ৫ শ’ কোটি টাকার একটি সিঙ্গেল চুক্তিনামা থাকতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ একটি কোম্পানির ছাড়া এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর নেই। তাদের অভিযোগ চিহ্নিত একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় এ ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।
ম্যাক্সকে এ কাজ দিতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় বারবার সংশোধনী আনা হচ্ছে, এমন অভিযোগ করে খোদ সিডিএর কিছু কর্মকর্তা সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট- সিপিটিইউ, দুদকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, মুরাদপুর ফ্লাইওভারের ঠিকাদার ম্যাক্সকে এ কাজ পাইয়ে দিতে তাদের অনুক‚লে দরপত্রে সব শর্ত সংযোজন করা হয়েছে। স্থানীয় টেন্ডার ফার্মের কারণে বিদেশি ঠিকাদাররা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অনাগ্রহী হবে বলেও এতে বলা হয়। ফলে সিন্ডিকেটের নীলনকশাই এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ গত ৩০ জুলাই দ্বিতীয় দফা সংশোধনী এনে তৃতীয়বারের মতো দরপত্র প্রকাশ করা হয়। এতে কমপক্ষে ১৮ শ’ কোটি টাকার সড়ক অবকাঠামো বা ব্রিজ নির্মাণ অথবা ১২ শ’ কোটি টাকার আট কিমি ফ্লাইওভার অথবা ব্রিজ নির্মাণের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৩ আগস্ট পর্যন্ত দরপত্রের সিডিউল কেনা যাবে। দরপত্র জমা দিতে হবে ১৪ আগস্ট। দুই দফা সংশোধনী আনা হলেও দরপত্র জমা দেয়ার সময় বাড়ানো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান ৩০ জুলাই দৈনিক ইনকিলাব প্রতিবেদককে বলেছেন, সব ধরনের নিয়ম-কানুন মেনেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কাউকে কাজ পাইয়ে দিতে শর্ত শিথিল বা সংযোজন করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অমূলক এবং ভিত্তিহীন। সিপিটিইউসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। তিনি বলেন, এতে দেশি ঠিকাদারের পাশাপাশি যৌথ প্রতিষ্ঠান এমনকি বিদেশিরাও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। ইতোমধ্যে ১৮টি টেন্ডার সিডিউল বিক্রি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী ১৩ আগস্টের মধ্যে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। দুই দফা টেন্ডার প্রক্রিয়া সংশোধন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বচ্ছতার জন্যই টেন্ডারে সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি আশাবাদী, অভিজ্ঞ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হবে এবং যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশল খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরপত্র নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখে মনে হচ্ছে- পুরোনো পথেই হাঁটছে সিডিএ। স্বঘোষিত ‘কর্মবীর’ সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম আগেও অনভিজ্ঞ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করাতে গিয়ে নগরবাসীকে বিপাকে ফেলেছেন। বহদ্দারহাট, কদমতলী এবং সর্বশেষ মুরাদপুর ফ্লাইওয়ার নির্মাণে সময় ও অর্থ দুটোই বেশি ব্যয় হয়েছে। আর তাতে নগরবাসীকে বছরের পর বছর দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। অদক্ষ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়ায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণকালে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১৪ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি অনেক মানুষ পঙ্গু হয়েছে। সর্বশেষ সেনাবাহিনীর তত্ত্ববাধানে ওই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ করতে হয়। প্রাক-সমীক্ষা বা কোনো ধরনের কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই চট্টগ্রামে কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করিয়েছেন কর্মবীর ছালাম।
২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের’ ভিত্তি স্থাপন করেন। তিন ধাপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে। নগর প্রকৌশলীরা বলছেন, প্রকল্পটিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বলা হলেও এটি মূলত ফ্লাইওভার। প্রকল্প ব্যয় বাড়াতেই এমনটা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প ব্যয় দুই হাজার ৯ শ’ কোটি টাকা থেকে বেড়ে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকায় উঠেছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/145935/