৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:১১

দেশে ফিটনেসহীন গাড়ি পাঁচ লাখ

রাজপথ থেকে গ্রামীণ সড়ক, সর্বত্র চলাচল করছে ফিটনেসহীন গাড়ি। রাজধানী ঢাকায় বাসগুলোর চেহারা ঝলসানো, রংচটা। কোনোটি চলতে চলতে ব্রেক ফেল করে, কোনোটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়। সামনের ‘লুকিং গ্লাস’ নেই বেশির ভাগের। চলাচলকারী যাত্রী সাধারণ প্রতিনিয়ত এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে।

রাজধানীর সড়ক ছাড়াও মহাসড়ক, বিভিন্ন গ্রামীণ সংযোগ সড়কে চলছে এসব ফিটনেসহীন গাড়ি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনার বড় কারণ এই ফিটনেসহীন গাড়ি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে মোটরসাইকেল ছাড়া প্রায় ১২ লাখ গাড়ির পাঁচ লাখ চলাচলের উপযোগী নয়। মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ নিতে হয় না।
বিআরটিএর সূত্রে জানা গেছে, কোনো গাড়ির ফিটনেস আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য রাজধানীর মিরপুর কার্যালয়ে গাড়ি পরিদর্শন কেন্দ্র আছে। বিআরটিএর অন্যান্য কার্যালয়ে এ ধরনের কেন্দ্র নেই। মোটরযান পরিদর্শকদের বেশির ভাগ খালি চোখে গাড়ি দেখে সনদ দিয়ে দেন। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানায়, ঘুষ দিলেই সনদ দেওয়া হয়। চলাচলের জন্য গাড়ি উপযোগী কি না তা পরীক্ষার যন্ত্র বসানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও ওই প্রকল্পের কাজ এগোতে দেওয়া হয়নি। ২০১৬ সালে সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের চেষ্টায় মিরপুর বিআরটিএর কার্যালয়ে এ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতায় ডিজিটাল গাড়ি পরিদর্শন কেন্দ্র (ভিআইসি) চালু করা হয়েছে ২০১৬ সালের ২৯ মে। ভিআইসি পরিদর্শন শেষে ওই দিন সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, প্রথমবারের মতো গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা পদ্ধতি ডিজিটাল করা হলো। এটি শুরু হলে দালালি বন্ধ হবে অনেকটা। সরাসরি গাড়ি নিয়ে এসে কম্পিউটারের মাধ্যমে গাড়ির ফিটনেস দেখা হবে। ওয়েবপোর্টালের মাধ্যমে গাড়ি পরীক্ষা করা যাবে।
বিআরটিএর ইকুরিয়া, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা কার্যালয়ে মোটরযানের ফিটনেস পরীক্ষা ডিজিটালাইজড করতে এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ জন্য উন্নয়ন প্রকল্প ছক তৈরি করা হয়েছে। তবে এসব কেন্দ্র স্থাপন পরিকল্পনাতেই থেকে যাচ্ছে আমলা ও কর্মকর্তাদের কালক্ষেপনে। কারণ এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করা হলে তাদের ঘুষবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।
গাড়ির নির্মাণকালীন নকশা অক্ষত থাকা, ব্রেক-গিয়ার ঠিক থাকা, দরকারি বাতি থাকা, কালো ধোঁয়া বের না হওয়া এবং রং ঠিক থাকলেই কেবল গাড়ি রাস্তায় চলাচলের উপযোগী বলা যাবে। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসারে, ফিটনেস পেতে অন্তত ৩৬ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক বিষয় পরীক্ষা করতে হয়। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসারে, মোটরসাইকেল ছাড়া বাস-মিনিবাস বা প্রাইভেট কারের মতো গাড়ি বছরে একবার ফিটনেস পরীক্ষা করিয়ে নিতে হয় বিআরটিএ কার্যালয় থেকে। বিআরটিএ এর মোটরযান পরিদর্শকরা তা খালি চোখেই পরীক্ষা করছেন।
সেবাগ্রহিতা গাড়ি মালিক নবী হোসেন অভিযোগ করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়ে ফিটনেস সনদ নিতে হয়। পরীক্ষা না করিয়ে ৫০০ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে গাড়ির ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করা হয়।
সড়কে দুর্ঘটনার পর উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলে কিংবা সমাজের মানুষ আন্দোলনে গেলে অভিযান শুরু করে বিআরটিএ, পুলিশসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। ২০১৫ সালে উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফিটনেসহীন গাড়ি বন্ধ ও ভুয়া লাইসেন্স জব্দ করতে বিআরটিএকে নির্দেশ দিয়েছিল।
জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, মহাসড়ক পুলিশ, বিআরটিএ, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় দায়িত্বশীলদের দায় এড়ানোর প্রবণতায় দেশে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে বিআরটিএ এর শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। অভিযানের উদ্যোগ নিলেও তা বন্ধ করে দিতে হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, অভিযান জোরদার করা হলেই পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দুর্ভোগের খড়গ চালানো হয় যাত্রীদের ওপর। তখন অভিযান থামিয়ে দেওয়া হয়। এই ফাঁকে পার পেয়ে যায় ফিটনেসহীন গাড়ি।
গত রবিবার দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর বিআরটিএ অভিযান শুরু করে ঘটা করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে নির্দেশ দেওয়ার পর লাইসেন্সহীন চালকদের ধরতে অভিযানে নামে বিআরটিএ। গত বৃহস্পতিবার বিআরটিএ ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সহীন চালকদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে। অভিযানে ১৮ মামলা ও ১৯ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ ঢাকায় গাড়ির চাপ সামাল দেয়। তারা কি অভিযান পরিচালনা করেন, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন সমানভাবে অভিযান চালাতে পারি না। তবে মোটরযান অধ্যাদেশ অমান্য করার অপরাধে দিনে গড়ে দুই হাজার ৮০০ মামলা হয়। পিক আওয়ারে আমাদের বেশি মনোযোগী হতে হয় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে। পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে আমরা গত বছর উল্টো পথে গাড়ি চালানো বন্ধে অভিযান শুরু করেছিলাম। সেটা আরো জোরদার করা হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যানুসারে, চলতি বছর গত ৩০ জুন পর্যন্ত মোটরযান আইন অমান্য করাসহ বিভিন্ন অপরাধে চার লাখ ৩১ হাজার ৩০০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ২১ হাজার পাঁচটি মামলা হয় লাইসেন্স-সংক্রান্ত। ফিটনেস না থাকায় মামলা হয় ২৯ হাজার ২১৬টি। জেলা পর্যায়ে পুলিশের সহযোগিতায় এ ধরনের অভিযান কম হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে অভিযান চালানোর গুরুত্ব আরোপ করে চিঠি দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকদের জানানো হয়। তবে অভিযানের চিত্র মূল্যায়ন ও তদারকির বিষয়টি গুরুত্ব পায় না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফিটনেস পরীক্ষার জন্য মিরপুরেই কেন্দ্র আছে আর কোথাও নেই। অন্যত্র স্থাপন করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের এখানে বা অন্য কোথাও ঘুষ বা অন্যান্য অনিয়ম যারা করে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন নেতাদের চাপে সব জায়গায় অভিযান হয় না। এ কারণে ফিটনেসহীন গাড়ি চলছে অবাধে।
বিআরটিএর সচিব মুহম্মদ শওকত আলী জানান, ফিটনেসহীন ৫৪ হাজার সরকারি, বেসরকারি গাড়ি আর রাস্তায় চলতে পারবে না। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সরকারি হিসাবে, দেশে বছরে সড়কে দুর্ঘটনায় দুই থেকে আড়াই হাজার প্রাণ ঝরে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রাণহানির এই সংখ্যা ২১ হাজার। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে সড়কে বছরে প্রাণ হারায় ১২ হাজার মানুষ। সরকারি তথ্য ধরে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট দেখতে পেয়েছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫৩ হাজার ১৯১টি সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ ফিটনেসহীন গাড়ি।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/08/05/665987