৫ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:০৮

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের কারণ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ

বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ৪৭ বছরেও আইনসঙ্গত আদর্শ গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এর কারণ হিসেবে সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। ফলে গণপরিবহনে নিয়োগপ্রাপ্ত বৈধ কোনো শ্রমিক নেই। বৈধ শ্রমিক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা না থাকায় বাস-ট্রাক চালাতে লাইসেন্সও বাধ্যতামূলক হচ্ছে না। পরিবহন সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গত দশ বছরে রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থার চরম অবনতি হয়েছে। কাউন্টারভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বিশৃঙ্খলা বাড়ানো হয়েছে।
এলাকাভিত্তিক নতুন সিন্ডিকেটের উৎপত্তি হয়েছে। সহনীয় ভাড়ার ট্যাক্সিক্যাব তুলে দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রাজপথ ছেয়ে ফেলা হয়েছে। অপর একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় যারা বাস, পিকআপ, হিউম্যান হলার চালায়, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই প্রশিক্ষণার্থী চালক। ঢাকার রাস্তায় দু-তিন বছর গাড়ি চালিয়ে 'হাত পাকা' হলে তাদের পাঠানো হয় আন্তঃজেলা রুটে। ফলে রাজধানীর রাজপথ দেশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ করে ফেলা হয়েছে। আলাপকালে এসব সমস্যার অনেক কিছুই স্বীকার করে নিয়ে পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন একাধিক পরিবহন নেতাও।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সড়ক আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া সমকালকে বলেন, বর্তমানে দেশে যে গণপরিবহন ব্যবস্থা আছে সেখানে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে আইনসঙ্গত কোনো কাঠামো নেই। মালিকরা কখনও শ্রম আইন অনুযায়ী নিয়োগপত্র দিয়ে চালক নিয়োগ করেন না। চালকদের মাসিক ভিত্তিতে বেতনের ব্যবস্থাও নেই। দিন চুক্তিতে চালকদের কাছে গাড়ি দেওয়া হয় এবং চালকরাও এ কারণে দায়িত্ব নিয়ে গাড়ি চালায় না। নিয়োগপত্র দিতে হয় না বলে চালকের বৈধ লাইসেন্স আছে কি-না তাও যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেন না মালিকরা।
তিনি বলেন, চালক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে শ্রম আইন মানার বাধ্যবাধকতা না থাকার সুযোগটাই নিচ্ছে পরিবহনের মাফিয়াতন্ত্র। মাফিয়া-সিন্ডিকেটের লোকজন মালিক-শ্রমিকের পরিবর্তে পরিবহন ব্যবস্থাটাকে গডফাদার-ক্যাডারকেন্দ্রিক করে ফেলেছে। এর ফলে পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের নৈরাজ্য রেখে সুবিধাভোগী হচ্ছে মাফিয়া ও তাদের সহযোগীরা। তিনি বলেন, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খার ফল হিসেবে অদক্ষ ও বেপরোয়া চালকের ফুটপাতে গাড়ি তুলে দেওয়া কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। পরিবহন খাতকে মাফিয়া সিন্ডিকেটমুক্ত করে আইনসঙ্গতভাবে আদর্শ ব্যবস্থায় না নিতে পারলে নৈরাজ্য বন্ধ হবে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে গণপরিবহনের বাস্তবচিত্র তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে অনেকবার তুলে ধরা হয়েছে; কিন্তু সরকারের কেউই তা আমলে নেয়নি। সরকার বাস্তবচিত্র আমলে নিয়ে আগে থেকেই সমস্যার সমাধান করলে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
রাজধানীর গণপরিবহনে অরাজকতা চরমে : একাধিক পরিবহন নেতা সমকালকে বলেন, গত দশ বছরে রাজধানীর গণপরিবহনে সবচেয়ে বেশি অরাজকতা হয়েছে। দশ বছর আগেও রাজধানীতে কাউন্টারভিত্তিক শৃঙ্খল যানবাহন ব্যবস্থা ছিল। তারও আগে নিরাপদ, রোডস্টার ও প্রিমিয়াম বাসের মতো কম খরচের উন্নত বাস সার্ভিস চালু ছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং বাসচালকদের পরিচয়পত্র সামনে ঝুলিয়ে রাখা, বাসের নম্বর ও কোম্পানিতে অভিযোগ জানানোর টেলিফোন নম্বর বাসের ভেতরে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে প্রদর্শন এবং বাস-ট্রাক চালকদেরও ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ট্যাক্সিক্যাব ও অটোরিকশা চালকের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখা এবং বাসের ভেতর নম্বরসহ অভিযোগ জানানোর টেলিফোন নম্বর ঝুলিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও হয়েছিল। ২০১২ সালের শেষের দিক থেকে গণট্যাক্সিক্যাব ও অটোরিকশায় চালকদের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখাসহ বাসে অভিযোগ জানানোর নম্বর প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়। এর পাশাপাশি ট্যাক্সিক্যাব তুলে দেওয়া হয় এবং এ সময় থেকে রাজধানী ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ছেয়ে যায়। এক বছরের মাথায় উচ্চমূল্যের কিছু ট্যাক্সিক্যাব নামানো হয়; কিন্তু সে উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। একই সঙ্গে এ সময় থেকেই রাজধানীর গণপরিবহনে নিম্নমানের বাসকে নতুন রঙ করে তথাকথিত 'সিটিং সার্ভিসে'র আবির্ভাব ঘটে। এগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। ভিআইপি নামে একটি বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকাও করা হয়। বিশেষ করে মিরপুর-মোহাম্মদপুরকেন্দ্রিক একটি নব্য মাফিয়া সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এই সিন্ডিকেট পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজিসহ মিরপুরের কালশী হয়ে মিরপুর-উত্তরার বিভিন্ন রুটে বৈধ অনুমোদন ছাড়াই গাড়ি চালানো শুরু করে। তাদের অধিকাংশ গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটও নেই। এসব গাড়িতে প্রায় একশ' ভাগ চালকেরই লাইসেন্সও নেই।
পরিবহন নেতাদের বক্তব্য : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দেশে চালক সংকট তীব্র। এ কারণে বেছে বেছে ভালো চালক নিয়োগ দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। আগে চালক সংকট দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রচণ্ড যানজটের কারণে রাজধানীতে ভালো চালকরা গাড়ি চালাতে চান না বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক তালুকদার সোহেল সমকালকে বলেন, মালিকরা নিয়োগপত্র দিতে প্রস্তুত, কিন্তু চালকরা চায় না। কারণ নিয়োগপত্র নিতে হলে প্রকৃত লাইসেন্স দেখাতে হয় এবং কোম্পানি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও নিময়-কানুন মানতে হয়। কিন্তু চালকরা একটি কোম্পানির বাসে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে গাড়ি গ্যারেজে রেখে অন্য কোম্পানির বাস চালাতে চলে যায়। এ সুবিধা পাওয়ার জন্য চালকরাই নিয়োগপত্র চায় না।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, গণপরিবহন ঘিরে নানা বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এসব অরাজকতা নিয়ে শুধু দোষারোপ আর সমালোচনা না করে সব পক্ষকে নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটাই হবে উত্তম এবং মঙ্গলজনক।

http://samakal.com/bangladesh/article/1808229/