৪ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ১০:০১

নোংরা কৌশল

অঘোষিত ধর্মঘট। বন্ধ গণপরিবহন। বিআরটিসির বাসই একমাত্র ভরসা। শাহবাগে তেমনই একটি বাসে উঠতে যাত্রীদের লড়াই -ছবি: নাসির উদ্দিন
এটা নতুন কিছু নয়। পুরনো এবং নোংরা। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা অতীতে বহুবারই এ কৌশল অবলম্বন করেছেন। নিষ্পাপ শিশুরা রাজপথে। নিরাপদ সড়ক আর ন্যায় বিচারের দাবিতে তাদের আন্দোলন হৃদয় জয় করেছে বহু মানুষের। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের তাতে কিছু আসে-যায়নি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই গতকাল সারা দেশে বাস বন্ধ করে দেন তারা। আর এতে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। রাজধানীর সড়কে
গণপরিবহন না থাকায় গত তিন দিন থেকে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে রয়েছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কিছু ছোট যান চলাচল করলেও গতকাল তাও বন্ধ করে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। পরিবহন মালিকরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত তারা বাস চালাবেন না। গতকাল সড়কে বড় কোনো কর্মসূচি না থাকলেও কেন বাস চালানো হয়নি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলেনি তাদের কাছ থেকে। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সড়কে যাত্রীদের ভিড়।

তবে বিআরটিসির কয়েকটি বাস ছাড়া কোনো যাত্রীবাহী বাস নেই। জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে পরিবহন সঙ্কটে ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা। বাধ্য হয়ে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় বা রিকশায় গন্তব্যে রওয়ানা দেন। গণপরিবহন সংকটে তাদের গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়াও। মিরপুরের দুই নম্বর এলাকায় থাকেন ব্যবসায়ী উজ্জ্বল। সকাল ১০টার দিকে এই যাত্রী সদরঘাট যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হলেও কোনো গণপরিবহন রাস্তায় পাননি। এত দূরের রাস্তা হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর বলে তিনি মন্তব্য করেন। ফলে বাধ্য হয়ে সিএনজি অটোরিকশায় ৫০০ টাকায় প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে সদরঘাট গিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তার বিরক্তি নেই। ফার্মগেটে কথা হয় যাত্রী সবুজ মিয়ার সঙ্গে। গাবতলী যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো বাস মিলছে না। সিএনজি চালক এইটুকু দূরত্বের জন্য ৩০০ টাকা ভাড়া চাচ্ছিল তার কাছে। তিনি বলেন, অপেক্ষা করছি, যদি কোনো কিছুতে উঠতে পারি।
বিকাল তিনটা। ফার্মগেট মোড়। শত শত মানুষের কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। কখন আসবে একটি বাস? কারও চোখ কাওরান বাজারের দিকে। কারো বিজয় সরণি পানে। তাদের দূরদৃষ্টি হতাশ হয়ে ফিরছিল বার বার। যতদূর চোখ যায় এই ব্যস্ততম সড়কটিতে বাসের দেখা নেই। শেষ হয় না যাত্রীদের প্রতীক্ষাও। মাঝে মাঝে দু-একটি বিআরটিসির বাস আসলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু প্রাণপণ যুদ্ধেও তাতে ঠাঁই মিলছিল না অধিকাংশের। আবার সেগুলোর বেশিরভাগ একই রুটের হওয়ায় অপেক্ষমাণদের অধিকাংশকেই টানছিল না বাসগুলো। বাস না পেয়ে অনেককে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিতে দেখা গেছে। কেউ কেউ রিকশা বা অটোরিকশার সন্ধান করে ব্যর্থ হয়ে ফিরছিলেন।
উজ্জ্বল দাস, তার স্ত্রী শিশু-সন্তান নিয়ে মতিঝিলের শামীবাগের এক মন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছিলেন। বাসা থেকে বের হন দুপুর দু’টার আগে। গাড়ির অপেক্ষায় উজ্জ্বল দাস মানবজমিনকে জানান, শুভ কাজে বের হয়েছি। চেষ্টা না করে তো ফিরে যেতে পারি না। বাসের আশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন রিকশা বা অটোরিকশাও পাচ্ছি না।

দু’হাতে ভারি ব্যাগ ও বস্তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন ৫৩ বছরের বৃদ্ধা রওশন আরা। তিনি ট্রেনে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসেন। কমলাপুরে দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি বিআরটিসি বাসে কোনোমতে জায়গা করে নিয়ে ফার্মগেট পৌঁছেন। কিন্তু সেখান থেকে মোহাম্মদপুর যাওয়ার কোনো বাস না পেয়ে আটকা পড়েন।
তিনি বলেন, দু’ঘণ্টা ধরে মোহাম্মদপুরে যাওয়ার একটি বাসও দেখতে পাইনি। বাস না থাকার সুযোগে কয়েকটি রিকশাকে মিরপুরের যাত্রী বহনের জন্য লাইন দিতে দেখা গেছে। তাদের একজন মো. আলহাছ। তিনি বলেন, হাতেগোনা সরকারি বাস ছাড়া সকাল থেকে রাস্তায় পাবলিকের বাস দেখিনি। আমি মিরপুর ১০ নম্বরে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিজন ১০০ টাকা ভাড়ায় দু’জন করে দু’বার নিয়ে গেছি।

তার পাশেই পাঠাও-এর মোটরসাইকেল চালক মো. ইউসুফ। তিনি বলেন, আমি বহু জায়গায় গেছি। আজ কোথাও বেসরকারি গণপরিবহন দেখিনি। রাস্তায় রাস্তায়, মোড়ে মোড়ে মানুষ গাড়ির জন্য ভোগান্তিতে পড়েছেন। কয়েক স্থানে ছাত্ররা মাঠে নেমেছে। তারা গাড়ির লাইসেন্স চেক এবং লাইন ধরে গাড়ি চলতে বাধ্য করছে। তাকেও বেলা ১২টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড় মোড়ে ও সকালে ফকিরাপুল মোড়ে গাড়ির লাইসেন্স দেখাতে হয়েছে বলে জানান।
গতকাল সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, একদিকে বিভিন্ন বয়সী শত শত নারী, পুরুষ বাসের অপেক্ষায়। ব্যাগ, লাগেজ, ট্রলি ব্যাগ নিয়ে ঘণ্টার ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও বিকাল পর্যন্ত কোনো বাস ছাড়েনি। অন্যদিকে, পরিবহন শ্রমিকেরা অলস সময় পার করছেন। সায়েদাবাদ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে দিনরাত বাস ছেড়ে যায়। গত তিন দিন ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। অনেকেই আশায় ছিলেন শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় তারা নিজেদের গন্তব্যে যাবেন। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে সে সুযোগ আর মেলেনি। বাস না ছাড়ায় অনেকেই মনোকষ্টে ফিরে যান।

কুমিল্লার হোমনায় যাবার উদ্দেশ্যে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন তাপস সূত্রধর (৩০)। তিনি বলেন, গাড়ির চালকেরা বলছেন তারা যাবেন না। সমস্যা আছে। কিন্তু কি সমস্যা সেটি বলছেন না। আসলে মাঝে মাঝেই তারা নানা অজুহাতে এমন কষ্ট দেন। এর কোনো মানে হয় না। সিলেটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসেছেন শিব্বির আহমেদ (২৭)। যাবেন সিলেটে। সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো বাস ছাড়তে দেখেননি তিনি। দুপুর ১টার দিকে তিনি বলেন, যদি জানতাম আজ (গতকাল) কোনো বাস ছাড়বে না তাহলে এতদূর থেকে ব্যাগ লাগেজ নিয়ে আসতাম না। তিনি বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে পড়েছি। প্রায় সময়ই তারা (পরিবহন সংশ্লিষ্টরা) এ ধরনের আচরণ করেন। এর কি কোনো বিহিত নেই? কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর যাওয়ার উদ্দেশ্যে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসেছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী প্রশান্ত রায় (২৬)। এসেই জানতে পারলেন কোনো বাস ছাড়বে না। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, চালকেরা বলছে, তারা নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাড়ি চালাবেন না। কিন্তু আসলে কলকাটি নাড়ছে পরিবহন মালিক ও নেতারা। তাদের অপকৌশলের কারণেই চালকেরা গাড়ি ছাড়ছেন না। তারাই চালকদের নিষেধ করেছেন। অঘোষিত ধর্মঘটের মাধ্যমে মানুষকে জিম্মি করেছেন। এভাবে মানুষকে জিম্মি করার কোনো মানে হয় না। আমিনা বেগম (৬০) যাবেন সিলেটে। সকাল থেকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় তিনি। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও বাস ছাড়ার নাম নেই। অসুস্থ শরীরে ক্ষুধায় কাতর আমিনা বেগম ঝালমুড়ি খেতে খেতে বলেন, আমারে কইছে ২টার পরে গাড়ি ছাড়তে পারে। হেই আশায় আছি। মগবাজারের ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আল আমিন যাবেন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। শুক্রবার হওয়ায় বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি খুব আশা নিয়ে।

কিন্তু বিধিবাম। সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে জানতে পারলেন অঘোষিত ধর্মঘট চলছে পরিবহন শ্রমিকদের। তারা বাস চালাবেন না। হতাশায় বাসায় ফিরে যাচ্ছেন আল আমিন। তিনি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন যৌক্তিক। তারা ভুয়া ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। নিরাপদ সড়কের নামে আন্দোলন করছে। কিন্তু পরিবহন সংশ্লিষ্টরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে চাইছেন। এর আগেও তারা বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে এমন করেছেন। এর কি কোন প্রতিকার নেই?

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে কথা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী ‘সি ডি এম’ পরিবহনের চালক মো. জামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, যেখানে সেখানে ছাত্ররা লাইসেন্স দেখতে চাইছে। গাড়ি ভাঙছে। পরিবহন চালক ও তাদের সহকারীদের উপর হামলা করছে। আমরা একপ্রকার নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আমাদের জীবনের ভয় আছে। তাছাড়া দুর্ঘটনা ঘটলেই চালকদের ফাঁসির দাবি করা হয়। যে কারণে চালকেরা ভয়ে আছেন। গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন। জামাল হোসেন বলেন, আমরা কোনো ধর্মঘট, হরতাল করছি না। পরিস্থিতির কারণে ‘কর্মবিরতি’ পালন করছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আবারো গাড়ি চলবে। ঢাকা টু দৌলখাঁর রুটে চলাচলকারী একটি বাসের চালক মোতালেব হোসেন বলেন, ছাত্রছাত্রীদের দাবি যৌক্তিক। তাদের মতো আমরাও নিরাপদ সড়ক চাই। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও যৌক্তিক। আর দুর্ঘটনা ঘটলেই চালকদের ফাঁসির দাবি করা হচ্ছে। আমাদেরও তো ভয় আছে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায় আছি আমরা। বাস না চালানোর বিষয়ে পরিবহন মালিকদের কোনো নির্দেশনা আছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মালিকদের কোনো নির্দেশনা নেই। আমরাই নিরাপত্তার কারণে বাস চালাচ্ছি না। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা ও নগর বাস টার্মিনাল শ্রমিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী সেলিম সরোয়ার মানবজমিনকে বলেন, বিভিন্ন জায়গায় বাস ভাঙচুর করা হচ্ছে। চালক শ্রমিকদের উপর হামলা হয়েছে।

নিরাপত্তার কারণে চালকেরা যদি গাড়ি না চালান তাহলে আমরা কি করবো? শ্রমিকেরা যদি আশ্বস্ত হন যে রাস্তায় কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা হবে না, তাহলে তারা গাড়ি চালাবেন। তিনি বলেন, মূলত ছাত্ররা কোনো গাড়িতে হামলা করে না। কিছু দুরভিসন্ধি ও সুযোগ সন্ধানী লোক হামলা করছে। যে কারণে শ্রমিকেরা আতঙ্কিত। তবে, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। আজ (গতকাল) সন্ধ্যা থেকে বাস চলাচল করবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=129113