নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবিতে গতকালও রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ছবিটি মিরপুর থেকে তোলা : নয়া দিগন্ত -
৩ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৭

পঞ্চম দিনের মতো অচল রাজধানী

মিরপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলা

ছাত্র আন্দোলনে পঞ্চম দিনের মতো অচল রাজধানী ঢাকা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে গতকালও বিক্ষোভ করেছে ছাত্ররা। তাদের এই কর্মসূচিতে মিরপুরে হামলা চালানো হয়েছে। ছাত্ররা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যানবাহনের কাগজপত্র তল্লাশি করে। যেসব গাড়ির কাগজপত্র বা চালকের লাইসেন্স ছিল না সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা নিতে বাধ্য করে পুলিশকে। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সাংবাদিকসহ অনেকের গাড়িই আটকে দেয় ছাত্ররা। এ দিকে ছাত্রদের এই আন্দোলন জেলা শহরেও পৌঁছে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলায় জেলায় ছাত্ররা রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। তারা নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ দাবি করে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পঞ্চম দিনের মতো সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, গুলশান, মিরপুর, তেজগাঁও, আগারগাঁও, ধানমন্ডি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, মিরপুর রোড, ফার্মগেট, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, টিকাটুলিসহ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষােভ করে।
চার দিন ধরে চলমান ছাত্র বিক্ষােভ সামাল দিতে গতকাল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সকালে ঠিকই রাস্তায় নেমে পড়ে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেলেও সে তুলনায় পুলিশের উপস্থিতি তেমন একটা চোখে পড়েনি।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বেলা ১২টায় দেখা যায় যানবাহন আটকে কাগজপত্র তল্লাশি করছে ছাত্ররা। যেসব গাড়ির কাগজপত্র ঠিক ছিল না সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে পুলিশকে মামলা দিতে বাধ্য করা হয়। বেলা আড়াইটায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়েই এক ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে শিক্ষার্থীরা কাগজপত্র চান, কিন্তু তিনি না দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হাত তোলেন, পরে তার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে বিকেলে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের পুলিশ বক্সে তালা মেরে সেখান থেকে চলে যান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
অনেক স্থানে দেখা গেছে চালকের লাইসেন্স না থাকায় গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে। যান্ত্রিক বাহন ও অযান্ত্রিক বাহনকে পৃথক লেন ব্যবহারে বাধ্য করে ছাত্ররা। কোথাও উল্টো পথে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করা হলে সেই গাড়িগুলোকে ঘুরিয়ে ঠিকপথে চলতে বাধ্য করে তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গাড়ির বৈধ কাগজপত্র না পাওয়ায় ধানমন্ডি ২ নম্বর এলাকায় সেটি আটকে গাড়ির হাওয়া ছেড়ে দেয় ছাত্ররা। গাড়ির ওপর নোট লিখে দেয়া হয় কি কারণে হাওয়া ছাড়া হলো। দুপুরের পর কুর্মিটোলা হোটেল রেডিসনের সামনে ছাত্ররা লাঠি নিয়ে পুলিশকে ধাওয়া করে। উত্তরার জসিম উদ্দিন রোডে ঢাকা মেট্রো ছ-১১-১৬৩৭ নম্বরের একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়। এ সময় এয়ারপোর্ট থানার ওসি (তদন্ত) ছাত্রদের হামলায় সামান্য আহত হন। মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা হয়েছে। এ সময় দুই ছাত্র আহত হয় বলে জানা গেছে।
মিরপুরে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা : বিকেলের দিকে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে, স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ এ হামলা চালিয়েছে। সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় অংশ নেয়।
বিকেল ৪টায় মিরপুর ১০ থেকে ১৩ ও ১৪ নম্বরের মধ্যে বিআরটিএ থেকে কাফরুল থানা হয়ে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের গেট পর্যন্ত সড়কে এই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে।
এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এক ছাত্র জানায়, মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাদের মানববন্ধন কর্মসূচি চলছিল। পুলিশ তাদের সরাতে গেলে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে।
তখন পুলিশ তাদের লাঠিপেটা শুরু করলে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই এলাকায় পুলিশের সাথে বেশ কিছু সময় বিক্ষােভকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। এ সময় পুলিশের সাথে একদল যুবককেও লাঠি হাতে শিক্ষার্থীদের পেটাতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ করছিল। এ সময় কিছু পুলিশ সদস্য ও সাদা পোশাকের লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার ইয়াসমীন সাইকা পাশা সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীরা কোনো কারণ ছাড়াই কাফরুল থানায় হামলার চেষ্টা করে। পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান ফটক ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। তারা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। তখন তারা ১০ নম্বর গোল চত্বরের দিকে যায়। বিকেল ৪টার আগে আগে ওই মারামারির পর স্কুল ইউনিফর্ম পরা তিন ছাত্রকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তাদের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গাড়ি আটক : দুপুরের দিকে লাইসেন্স না থাকায় পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গাড়ি আটকে দেয় ছাত্ররা। রাজধানীর ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ওই গাড়ির চালকের লাইসেন্স ছিল না। এ সময় শিক্ষার্থীরা মন্ত্রীর সাথে কথা বলেন। পরে মন্ত্রী অন্য একটি গাড়ি এনে সেই গাড়িতে স্থান ত্যাগ করেন।
রাস্তা ছিল ফাঁকা : অবরোধের কারণে রাজধানীর রাস্তায় পাবলিক বাস খুব একটা চলাচল করতে দেখা যায়নি। অনেকে ব্যক্তিগত গাড়িও বের করেননি। যারা রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন তাদের কেউ কেউ বিড়ম্বনায় পড়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গণপরিবহনের জন্য শত শত মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দু-একটি গাড়ি এলেও তাতে ঠাঁই হয়নি অনেকের।
ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করেনি। পরিবহন শ্রমিকেরা বলছেন নিরাপত্তার কারণে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুলাই দুপুরে ছুটির পরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম ওরফে সজীব এবং একই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিম নিহত হন। তারা রাস্তার পাশের ফুটপাথে গাড়ির জন্য অপো করছিলেন। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। পথচারীরা সাথে সাথে আহতদের কাছের কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে গুরুতর আহত কয়েকজনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। এই ঘটনার পর ৯ দফা দাবিতে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলোর সাথে পরে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবিও যুক্ত হয়।

 

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/338416/