৩ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ৯:২০

আন্দোলন বানচালে ধর্মঘট পুরনো অপকৌশল

বিশিষ্টজনের উদ্বেগ পরিবহন নেতাদের অস্বীকার

গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিপরীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সঙ্গে প্রায় সব জেলার দূরপাল্লার বাস যোগাযোগ বন্ধ থাকে। এতে সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও যাত্রী অধিকার আন্দোলনের নেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের জন্য দায়ী গডফাদারদের পদ-পদবি রক্ষার জন্যই অঘোষিত ধর্মঘটের অপকৌশল নেওয়া হয়েছে। এর পেছনে হীন উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণকে জিম্মি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের ব্যবসা চলমান রাখা। যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন, কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে কোথাও ধর্মঘট ডাকা হয়নি এবং ধর্মঘট ডাকার কোনো পরিকল্পনাও নেই।

সংশ্নিষ্ট পরিবহন সূত্র জানায়, মূল মালিক-শ্রমিক সংগঠনের বাইরে এখন কিছু ভুঁইফোঁড় মালিক-শ্রমিক সংগঠনও গজিয়ে উঠেছে। এই সংগঠনগুলোই ধর্মঘট ডাকার অপকৌশল নিচ্ছে। এ ছাড়া গণপরিবহনে দীর্ঘদিনের চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেটের বহুপক্ষীয় অংশীদাররাও গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ থেকে বিরত রাখার অশুভ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। গত বুধবার রাতে এক বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাব বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে বাস চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ময়মনসিংহ মোটর মালিক সমিতি। সমিতির বাস বিভাগের সম্পাদক বিকাশ সরকার সমকালকে জানান, বুধবার রাতে সমিতির জরুরি বৈঠক হয়। এতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে বৃহস্পতিবার বাস চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইভাবে খুলনা, বগুড়া থেকেও স্থানীয় মালিক সমিতি কর্তৃক বাস চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে।

উদ্দেশ্য হীনস্বার্থ হাসিল :বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিপরীতে যদি বাস ধর্মঘট ডাকা হয় কিংবা অঘোষিতভাবে বাস চলাচল বন্ধ রেখে জনগণকে জিম্মি করা হয়, সেটা খুবই অন্যায়। এ অন্যায় রোধে রাষ্ট্রকেও ভূমিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, আজকের যে আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের যে ক্ষোভ তা একদিনের নয়, একটি ঘটনা থেকে উদ্ভূত নয়। দিনের পর দিন পরিবহনে অমানবিক সব ঘটনা ঘটেছে। আহত শিক্ষার্থীকে বাস থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া, বাসের ভেতরে গণধর্ষণ ও হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর রাস্তায় বাসগুলোর প্রতিযোগিতার মরণদৌড়ের জন্য একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেছে, প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু এসব বন্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেশের মানুষ দেখেনি। এ অবস্থায় পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে শিক্ষার্থীদের ওপর বাস তুলে দেওয়া এবং দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায়। আজকের এ পরিস্থিতির জন্য তাই গণপরিবহনের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থাপনা এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিই দায়ী। এ কারণে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যও গণপরিবহন সংশ্নিষ্টরাই প্রধানত দায়ী। এ অবস্থায় গণপরিবহন মালিকরা যদি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিপরীতে ধর্মঘট ডেকে বসেন, সেটা হবে ঘোরতর অন্যায়। মালিকদের উচিত এ আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এগিয়ে আসা।

বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া বলেন, জনগণকে জিম্মি করে নিজেদের হীন স্বার্থ আদায় পরিবহনের গডফাদারদের পুরনো কৌশল। আগেও যখন সড়কে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়েছে, তখন পরিবহনের মাফিয়ারা শ্রমিকদের পাল্টা রাস্তায় নামিয়ে নিজেদের আধিপত্য জাহির করে সরকারকে জিম্মি করেছে। তিনি বলেন, সাধারণ শ্রমিকরা বঞ্চিত। তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী নিয়োগপত্র নেই, তারা নির্ধারিত বেতন-ভাতাও পান না। তারা দিনচুক্তিতে টাকা পান। যত বেশি ট্রিপ, তত বেশি টাকা, এ কারণেই চালকরা রাস্তায় মরণরেসে মেতে ওঠেন। চালকরা যেখানে অনিশ্চিত জীবন যাপন করেন, সেখানে তাদের কাছ থেকে সুস্থ সেবা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় না। তিনি বলেন, পরিবহন মাফিয়ারা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে, তেমনি শ্রমিকদেরও অধিকার বঞ্চিত করে নিজেদের হীন স্বার্থেই ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, বৃহস্পতিবার গণপরিবহনে অঘোষিত ধর্মঘট অবস্থা দেখা গেছে। এটা আর কিছুই নয়, আসলে জনগণকে জিম্মি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। গণপরিবহন গডফাদাররা নিজেদের পদ-পদবি মন্ত্রিত্ব বাঁচাতেই এ ধরনের অপকৌশল নিয়েছেন। তিনি বলেন, গডফাদারদের হাতে যতদিন গণপরিবহন খাত জিম্মি থাকবে, ততদিন এ খাতে নৈরাজ্য, অমানবিকতা, বর্বরতা বন্ধ হবে না।

ধর্মঘট নয়, উদ্ভূত পরিস্থিতি :বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্ল্যা বলেন, সমিতির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ধর্মঘট ডাকা হয়নি, ডাকার পরিকল্পনাও নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তার জন্য অনেক মালিক গাড়ি বের করেননি। ফলে আন্তঃজেলা রুটেও বাস খুবই কম চলেছে। এর বাইরে কিছু নয়। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই।

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, ধর্মঘট ডাকার একটা পদ্ধতি আছে। কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে সেগুলো আদায়ের জন্য আলটিমেটাম দেওয়া হয়। তারপর এ নিয়ে আলোচনা হয়। শেষ পর্যায়ে ধর্মঘট ডাকা হয়। এক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো ঘটনা নেই। এক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে সেটা হলো উদ্ভূত পরিস্থিতি। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, গাড়ি রাস্তায় চালানোর জন্য যথেষ্ট নিরাপদ পরিবেশ নেই। যে কারণে মালিকরা গাড়ি রাস্তায় বের করেননি। পরিবেশ স্বাভাবিক হলেই গাড়ি চলবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ধর্মঘট ডাকা হয়নি। নিরাপত্তা সংকট হলে এবং মালিকরা গাড়ি বের করতে না দিলে শ্রমিকরাও গাড়ি চালাতে পারে না, এটাই বাস্তবতা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে শ্রমিক ফেডারেশনেরও কোনো দ্বিমত নেই।

ভুঁইফোঁড় সংগঠনের কারসাজি :পরিবহন সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গত তিন-চার বছরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় স্থানীয়ভাবে একাধিক মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত গণপরিবহনে চাঁদাবাজিই এসব সংগঠনের মূল লক্ষ্য। এসব সংগঠনের নেতারা সব সময়ই সরকারদলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপেন।

সূত্র জানায়, এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের কিছুই কর্মী বুধবার শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় রাজধানীর শনির আখড়ায়। এসব সংগঠনই ধর্মঘট ডাকাসহ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্যাবোটাজ করার নানা অপকৌশল নেওয়ার চেষ্টা করছে। হোটেল র্যাডিসনের সামনে দুর্ঘটনা ঘটানো জাবালে নূর পরিবহনও এ ধরনের একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

সূত্র জানায়, গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধে সরকার যদি সত্যিই কার্যকর উদ্যোগ নেয়, তাহলে চাঁদাবাজির বিস্তৃত সিন্ডিকেট ভেঙে যেতে পারে- এ আশঙ্কায় সিন্ডিকেটের বহুপক্ষীয় অংশীদাররা এ আন্দোলনকে যে কোনো উপায়ে বানচাল কিংবা ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা করছে। আন্তঃজেলা রুটে বাস বন্ধ রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি এই সিন্ডিকেটেরই কারসাজি। 

http://samakal.com/capital/article/1808128/