২ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৬

যেখানে ভোটই হয়নি, ঘোষিত ভোট প্রকৃত জনমত হয় কী করে?

# সিলেটে জামায়াতের ভোট নিয়ে পানি ঘোলা করা উদ্দেশ্যমূলক
# বরিশালে বিএনপির ১৩ হাজার ভোট যেমন মিথ্যা, সিলেটে জামায়াতের ১১ হাজার ভোট তেমনি মিথ্যা
জালভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই, এজেন্টদের বের করে দেয়া, আগের রাতে সিল মারা, সাংবাদিক নির্যাতন সবই হয়েছে এবারের তিন সিটি নির্বাচনে। বরিশালে বিএনপিসহ ৪ প্রার্থীর ভোট বর্জন ঘটেছে। রাজশাহীতে মেয়র প্রার্থী বুলবুল ভোট না দিয়ে মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় বসে থেকেছেন। সিলেটে বিএনপি প্রার্থী নির্বাচন বাতিল দাবি করে বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। ভোটের দিন বিকেলে ঢাকা থেকে সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছিলেন, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে। তিন সিটিতেই একচেটিয়া পুলিশ কর্তৃক নৌকা মার্কায় সিল মারার ন্যক্কারজনক কর্মকা- দৃশ্যমান হয়েছে। গাজীপুর ও খুলনায় অল্প কিছু লোক ভোট দিতে পারলেও তিন সিটিতে সেটিও সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, তিন সিটিতে কোন নির্বাচনই হয়নি। নির্বাচন কারচুপির কোন প্রক্রিয়াই বাদ যায়নি এবারের নির্বাচনে। ভোটের হারও অস্বাভাবিক। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৩৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টিতে ৯০ শতাংশ বা এর বেশি এবং ৫৮টিতে ৮০ শতাংশ বা এর বেশি ভোট পড়েছে। আর সিলেট সিটির কোথাও ১৯ শতাংশ আবার কোথাও ৯১ দশমিক ৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে। সবাই বলছে ভোট ডাকাতি হয়েছে। যেখানে ভোটই হয়নি, সেখানে কে কত ভোট পেলো তা কাউন্টেবল হয় কী করে? সেটাই বা কী করে প্রকৃত জনমত হতে পারে? আসলে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত হলো দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
একটি জরিপ ও নির্বাচনের ফলাফল: রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে জনমত জরিপ করেছিল গবেষণা সংস্থা রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরডিসি)। নির্বাচনের আগের দিন রোববার (২৯ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এ জরিপ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, আসন্ন বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে পুরো জুলাই মাস ধরে স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (আরডিসি) মাধ্যমে আমরা তিনটি জনমত জরিপ করিয়েছি।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নিয়ে বলা হয়, সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ (আওয়ামী লীগ) : ৪৪.০%
মুজিবুর রহমান সরোয়ার (বিএনপি) : ১৩.১%, অন্যান্য প্রার্থীরা : ০.৮%, সিদ্ধান্তহীন : ২৩.৫%, উত্তর দেননি : ১৫.৯%।
রাজশাহী সিটি নির্বাচন নিয়ে বলা হয়, খায়রুজ্জামান লিটন (আওয়ামী লীগ) : ৫৮.০%, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল (বিএনপি) : ১৬.৪%, অন্যান্য প্রার্থীরা : ০.৯%, সিদ্ধান্তহীন : ১২.৩%, উত্তর দেননি : ৯.৬%।
সিলেট সিটি নির্বাচন নিয়ে বলা হয়, বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান (আওয়ামী লীগ) : ৩৩.০%, আরিফুল হোক চৌধুরী (বিএনপি) : ২৮.১%, অন্যান্য প্রার্থীরা : ১.৩%, সিদ্ধান্তহীন : ২৩.০%, উত্তর দেননি : ১২.৬%।
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজশাহী, বরিশালে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় হয়েছে বিএনপির ধানের শীষের। আর সিলেটে জয় পেয়েছে বিএনপি।
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন ফল চাইছিল, সেটাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের তুলে ধরা জরিপে তার প্রকাশই ঘটেছিল বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। ভোটের পরদিন মঙ্গলবার নির্বাচন নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এই মন্তব্য করা হয়।
নয়া পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এই জরিপ সম্পর্কে সাংবাদিকরা মতামত চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, উনি (সজীব ওয়াজেদ জয়) তো থাকেন আমেরিকায়। তার ধারণার মধ্যে বিদেশে যে ধরনের নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করা হয়, প্রি পোল, পোস্ট পোল- এই ধরনের বিষয়গুলো থাকে। যে কারণে ওখান থেকে তার একটা নিজস্ব তৈরি করা যে একটা রিসার্চ সেন্টার, তার লোকজনকে দিয়ে তৈরি করেছেন। আমরা এটাকে গুরুত্ব দিইনি খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই।
এরপর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পাশে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে মাইক দেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এটা কোনো রিসার্চের রিপোর্ট না, এটা হল তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা। রাজশাহী ও বরিশালে কী করবেন এবং তাতে কী দাঁড়াবে- এটা জয় সাহেব বলেছেন এবং উনি এটাও বুঝিয়েছেন যে, সিলেটে অতখানি করা সম্ভব হবে না। অতত্রব সেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এবং তাই হয়েছে। এটা কোনো রিসার্চ না, এটা হল তাদের আকাক্সক্ষা, তাদের ইচ্ছা। তারা যেভাবে করতে চান, সেটা আগেই বলে দিয়েছেন এবং সেটা করেছেনও তারা। তাদের পরিকল্পনার পূর্বাভাস ছিল ওই রিপোর্ট।
অস্বাভাবিক ভোট: রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম, কেন্দ্র দখল ও কারচুপির অভিযোগের মধ্যে বেরিয়ে এসেছে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার হারও। সিলেট সিটির কোথাও ১৯ শতাংশ আবার কোথাও ৯১ দশমিক ৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ ভোট পড়ার হারকে অস্বাভাবিক মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিলেট সিটিতে ভোট পড়েছে ৬১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ সিটিতে ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২টি ভোটের মধ্যে বৈধ ভোট ১ লাখ ৯১ হাজার ২৮৯টি ও বাতিল ৭ হাজার ৩৬৭টি। এ সিটিতে প্রায় ৪ শতাংশ ভোট নষ্ট হয়েছে। এ সিটিতে ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট পেয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী এগিয়ে আছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট।
তিনটিতেই কমবেশি কারচুপি, কেন্দ্র দখল করে জালভোট, ধানের শীষের এজেন্টসহ অন্যান্য প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া, প্রার্থীকে মারধর, সহিংসতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেছে বিএনপিসহ অন্য দলের প্রার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট হারের অস্বাভাবিক তারতম্য দেখা গেছে। একটি কেন্দ্রে ৯১ দশমিক ৭১ শতাংশ ও আরেকটি কেন্দ্রে ১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তারা, এ দুটিকেই অস্বাভাবিক ভোটের হার বলে মনে করছেন। এ সিটি নির্বাচনে আরও দুটি ভোটকেন্দ্রে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
৭টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশ বা তার বেশি ও ২৬টি কেন্দ্রে ৭০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে। অপরদিকে অন্তত ৩টি ভোটকেন্দ্রে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, এ সিটিতে সোনারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে।
এ কেন্দ্রে ২ হাজার ২৪৪টি ভোটের মধ্যে ২ হাজার ৫৮টি ভোট পড়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বদরউদ্দীন আহমদ কামরান পেয়েছেন ১ হাজার ১৫৫ ভোট। পক্ষান্তরে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী পেয়েছেন ৬৪০ ভোট। অপরদিকে পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বনিম্ন ১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ কেন্দ্রে ২ হাজার ১৭১টির মধ্যে ৪২৯টি ভোট পড়েছে। এ কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন।
আরও দেখা গেছে, সিলেটের শেখঘাট এলাকার মঈনুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৮৯ দশমিক ৯১ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ কেন্দ্রে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী ৯৬০ ভোট ও আওয়ামী লীগের বদরউদ্দীন আহমদ কামরান ৯০০ ভোট পেয়েছেন। অপরদিকে শাহ গাজী সৈয়দ বুরহানউদ্দিন রহঃ মাদরাসা কেন্দ্রে ৮৯ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ কেন্দ্রে নৌকায় ১ হাজার ৫৭৬টি ভোট ও ধানের শীষে ১ হাজার ২৫৭টি ভোট পড়েছে। এ দুটি কেন্দ্রে নির্বাচনের দিন জালভোট দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
সিলেট সিটি নির্বাচনের যেসব কেন্দ্রে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে সেগুলো হচ্ছে- একাডেমিক ভবন প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট পিটিআই (৩৫.৮২ শতাংশ) ও শাহজালাল উপশহর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র (৩৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ)। এছাড়া যে আটটি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে সেগুলো হচ্ছে- মঈনুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (৮৬.৪৭ শতাংশ), শেখঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (৮৯.৪২), কিশোরী মোহন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (৮৩.৪২ শতাংশ), কাজী জালাল উদ্দিন বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (৮০.৬৪ শতাংশ), নবীনচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (৮০.৬১ শতাংশ), স্কলার্স হোম প্রিপারেটরি স্কুল (৮৭.২৩ শতাংশ) ও বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল (৮৪.৩০ শতাংশ)।
সিলেটের নির্বাচনে জামায়াত: উপজেলা নির্বাচনে সিলেট বিভাগে জামায়াতের ফলাফল ছিল ইতিবাচক। সিলেটের গোলাপগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীকে টপকিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন হাফিজ নজমুল ইসলাম।
জৈন্তাপুরে জামায়াতের জয়নাল আবেদীন নির্বাচিতন হন বিপুল ভোটে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বহাল রয়েছেন তরুণ জামায়াত নেতা সাইফুল্লাহ আল হোসাইন।
দক্ষিণ সুরমায় জামায়াতের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান দ্বিতীয় মেয়াদে প্রার্থী হলে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হন। সেখানে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও জামায়াত ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। বিএনপির অবস্থান ছিল তৃতীয়।
একইভাবে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে জামায়াতের ডা. আব্দুল কুদ্দুস দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন যেখানে বিএনপি ছিল তৃতীয় অবস্থানে।
জামায়াত সর্বশেষ নিজ নামে সিলেট পৌরসভায় নির্বাচন করেছিল ১৯৯৪ সালে। তখন বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির আ ফ ম কামাল। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১৩ হাজার। আর জামায়াতের কুতুব উদ্দিন পেয়েছিলেন ৭ হাজার।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা। সেই উপজেলার ৩টি ওয়ার্ড সিটি কর্পোরেশনভুক্ত। সর্বশেষ নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছিলেন ২৮,০৯৫ ভোট। বিএনপির প্রার্থী পেয়েছিল ২১, ৫২৮ ভোট। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৩০, ৯০৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। এর আগের নির্বাচনে সেখানে বিএনপির প্রার্থী ছিল না। নির্বাচিত হয়েছিলেন জামায়াতের প্রার্থী। যেখানে একটা ক্ষুদ্র অংশে যেখানে জামায়াতের প্রার্থী ২৮ হাজার ভোট পায় তাহলে পুরো শহরে মাত্র ১০ হাজার ভোট হয় কী করে?

সিলেটে ঘোষিত ফলে তারতম্য: সিলেটে মেয়র প্রার্থী এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হাফিজ আব্দুল হাই হারুন, নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. আব্দুল আহাদ ও সদস্য সচিব মো: ফখরুল ইসলাম গতকাল বুধবার দেয়া বিবৃতিতে বলেন, ৩০ জুলাই সিলেটে প্রকৃতপক্ষে কোন ভোট হয়নি। ভোটের নামে লুটপাটের উৎসব চালিয়ে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। তারা বলেন, নির্বাচনে তান্ডব চলাকালে সরকারে বিভিন্ন বাহিনী কোন বাধা না দিয়ে সরকারদলীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, কেন্দ্র দখল ও সীল মারার মহোৎসব চালানোর পরও সরকার দলীয় মেয়র প্রার্থী মাত্র ৮৫ হাজার ভোট পেয়েছেন। অথচ বিগত নির্বাচনে তিনি ৮০ হাজারের বেশী ভোট পেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়, সিলেটে তাদের ভোট কত? আর দখল ভোটের সীলমারা উৎসবের ভোটগুলো গেল কোথায়? এছাড়া এত তান্ডবের পরও টেবিল ঘড়ির উল্লেখযোগ্য ভোট কাউন্টিংয়ে নিয়ে আসা হয়নি।
সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের তান্ডবের কারণে নগরীর এক তৃতীয়াংশেরও বেশী কেন্দ্রে ভোট গণনার পূর্বেই টেবিল ঘড়ির এজেন্টদের জোরপূর্বক বের করে দেয়া। যেসব কেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত এজেন্ট ছিল সেই এজেন্টের স্লিপের হিসাব ও রিটার্নিং অফিসার ঘোষিত ভোটের হিসাবে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। একদিকে সকাল থেকে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি, কেন্দ্র দখল, টেবিল কাষ্ট তারপর এজেন্টদের বের করে দেয়া ও গণনার সময় ঘড়ির এজেন্টদের উপস্থিত থাকতে না দিয়ে টেবিল ঘড়ির প্রাপ্ত ভোটকে কাউন্টিংয়ে না নিয়ে এসে ইচ্ছেমত সংখ্যা বসিয়ে দিয়ে ভোটের সংখ্যা ঘোষণা দেয়া সবই সরকারের নীল-নকশা ও কুট-কৌশলের অংশ। ঘোষিত এই ফলাফলে সিলেটবাসীকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানান তারা।
প্রকৃত জনমত নয়: সিলেটের নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সিলেটে কোন নির্বাচনই হয়নি। কেন্দ্র দখল, এজেন্টদের বের করে দেয়া, জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃস্টি করা হয়েছে, তাতে ভোটাররা ভোট দিতে যেতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কে কত ভোট পেলো, তা হিসাব করা যেতো। জনগন ভোট দিতে পারেনি। তাই এ ভোট কখনই প্রকৃত জনমত হতে পারে না।

নির্বাচনের নামে জঘন্য কাজ করলো সরকার: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেছেন, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন দিতে হবে। গতকাল দেয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, ৩০ জুলাই তিন সিটিতে প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান করে নির্বাচনের নামে জঘন্য কাজ করলো সরকার। যা বিশ^ মিডিয়াসহ দেশীয় সকল মিডিয়ায় গুরুত্ব পেয়েছে। এরপরও নির্বাচন কমিশনের নির্লজ্জ দালালী জাতিকে বিস্মিত করেছে। তিনি বলেন, তিন সিটির ফলাফল বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে।
বিশ্লেষকরা যা বলেন: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, তিন সিটিতেই অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে। এতে নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও জাল ভোটের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে, এটা কি সম্ভব? এর আগেও খুলনা ও গাজীপুর সিটিতেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। এবার তিন সিটিতে ওই হারে ভোট পড়েছে। কারণ গাজীপুর ও খুলনার মডেলে তিন সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এসব বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। কোনো মানেরই হয়নি। নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আগামীতে কি এ ধরনের নির্বাচন করবে নাকি ভুলগুলো সংশোধন করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল ও কারচুপি হয়েছে তার প্রমাণ হচ্ছে এ অস্বাভাবিক ভোট। যেসব কেন্দ্রে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, সেখানে অস্বাভাবিক ভোট পড়াই স্বাভাবিক। একই সঙ্গে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নির্বাচনের এ ফল গ্রহণ করে গেজেট প্রকাশ করবে নাকি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে?

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি বলেন, এটা বলা যায়, ভোটের ব্যাপারে কেউই খোলামেলা কিছু বলছে না। যেটা দৃশ্যমান তা হলো পর্দার আড়ালে এমন কিছু ঘটছে যা রাজনীতিতে শুভকর নয়। ছলচাতুরি করে রাজনীতি হয় না। সারা দিন একজনের কথা বললাম আর রাতে আরেকজনের কাছে গেলাম, এভাবে রাজনীতির মাঠে ভালো ফল বয়ে আনে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্লেষণ
সিলেটের নির্বাচন নিয়ে নানামুখি বিশ্লেষণ চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ডিজিটাল কারচুপি কিংবা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও নানা কথা এসেছে সেই বিশ্লেষণগুলোতে।
ঘড়ির ভোট কোথায়: হাবিবুর রহমান মুরাদ তার ফেসবুকের ওয়ালে লিখেন, সিলেটে জুবায়েরের ১১ হাজার ভোট যেমন মিথ্যা! তেমনি বরিশালে বিএনপির সরোয়ারের ১৩ হাজার ভোটও মিথ্যা!
সিলেটে মোট ভোটার প্রায় ৩,২১,৭৩২
কেন্দ্র-১৩৪, ফলাফল-১৩২
প্রাপ্ত ভোটঃ কামরান-৮৫,৮৭০
আরিফ-৯০,৪৯৬
ঘড়ির ভোট কোথায় গেল? ৬২টি সেন্টার পরে ঘড়ির কোন ভোটই প্রকাশ করা হয় নাই। বাকি ১,৪৫,৩৬৬ ভোট কি কয়লার মত বাতাসে উড়ে গেছে?
সত্য গোপন থাকেনা, একটু সময় লাগবে হয়তো. ঘড়ি তার ঠিক নিয়মে চলবে, ঘড়ির কাটা থেমে থাকেনা ... ইনশাআল্লাহ।
২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে গুরুত্বহীন করার জন্য, জোটে দ্বন্দ্ব কলহ আর ভাঙন সৃষ্টির জন্য সিলেট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কুট কৌশলটা মারাত্নক। এই কুট কৌশল বাস্তবায়নে বলির পাঠা বানানো হয়েছে নিজ দলীয় নেতা কামরানকে।
মামুন সরকার ভোটের হিসাব নিকাশ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেন ১৩৪টি কেন্দ্র, ভোটার সংখ্যা ৩২১০০০, ধান-৯০৪৯৬, নৌকা-৮৫৮৭০, হাতপাখা-২১৯৫, বাকি ১৪২৪৭৫ ভোট কোথায়?
আওয়ামীলীগের জাল ভোটসহ ৪২০০০ভোট বাদ গেলেও তারপরেও ১০০৪৭৫ টি ভোট ঘড়ি মার্কায় জনগণ ভোট দিয়েছেন, এগোলা মেনে নিতে হবে আর এগুলা বুঝে ফেলেছে আওয়ামীলীগরা যার কারনে জামায়াত কে জয়ী না করার জন্য আওয়ামীলীগ বিএনপিকে দিয়ে এই মাইন্ড গেইম খেলেছে, আর সকল ভোট কাস্ট হয়েছে বলেই ভোটাররা কেন্দ্রতে গিয়ে ব্যালট পেপার পায় নাই, তাহলে ঐ ভোটগুলা গেলো কোথায় আবার ঘড়ির ভোট ও হিসাব করে দিতে রাজি নয় কেন, জাতির কাছে আমার এ প্রশ্ন?
ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝতে হবে: সিলেটের মাহমুদুর রহমান দিলওয়ার বলেন, সাধারণ মানুষকেও অসাধারণ জ্ঞানে ধন্য করলো। আওয়ামী নির্বাচন তথা ডিজিটাল কারচুপি কিংবা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝতে, এখন আর টকশোর বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণ শুনতে হবে না। অবাক করা ব্যাপার হলো- এই রকম একটি ফলাফল হতে পারে, বহু ভাইদের সাদামাটা মন্তব্যে প্রতীয়মান হয়েছে।
একান্ত প্রিয় দ্বীনি ভাইদের বলছি- প্লিজ, হতাশ হবেন না। মনে হতে পারে, আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। না, বরং আমরা অনেক কিছুই অর্জন করেছি।
প্রিয় ফাহাদসহ ভাইদের এই কুরবানী বৃথা যাবে না, ইনশাআল্লাহ।
ইয়া আল্লাহ! ইয়া রাব্বাল আআলামীন!! ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ জাতির সম্মুখে উন্মোচিত করুন। অধম গোনাহগারদের প্রতি রহম করুন। হিম্মত বাড়িয়ে দিন। দ্বীনের পথে আজীবন অবিচল রাখুন। আমীন।।
বর্জন করেও জেতা যায়: আবু শাকের লিখেছেন, হেলিকপ্টারে এসে অর্থমন্ত্রী সফল কূটকৌশলে বন্ধী করল আরিফকে। বলি হল কামরান কেন্দ্র দখল করেও লাভ হয়নি। জামায়াতের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার ফল বিএনপির ঘরে। বরিশালে ওদের কত ভোট দিল! সুতরাং এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনই হয়না!! হয় ডিজিটাল কারচুপি। তাই করনীয় ঠিক করুন বিরোধী পক্ষ।
আল্লাহর ফায়সালাই চূড়ান্ত: আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন, মহান আল্লাহর ফায়সালাই চুড়ান্ত। তিনি যে রেজাল্ট আমাদের জন্য বরাদ্ধ রেখেছেন তা অবশ্যই আমাদের আগামী দিনের পথচলাকে সুদৃঢ় করবে। এটা ঠিক যে আমরা কাক্ষিত রেজাল্ট পাইনি। কিন্তু আমরা হাজারো জনগনের কাছে হাজির হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ইতিহাসের নির্মম জুলুম নির্যাতন নিপিড়নের পরেও আমাদের কাছে পেয়ে মুক্তি পাগল জনতা আপ্লুত হয়েছে। সিলেটের পাশাপাশি সারাদেশের এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করা দ্বীনি আন্দোলনের লাখো কর্মী নতুন করে উজ্জীবনী শক্তি পেয়েছে।
অন্যরা সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে আমরা তখন লড়াই করেছি। গ্রেফতার, গুলি, নির্যাতনের মুখেও আমরা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাইনি। আমরা যে লড়তে জানি, আমরা যে আতাতকারী নই তা আবারো প্রমান করেছি। আমার প্রিয় ভাই ফাহাদ গুলির মুখেও অকুতোভয় যোদ্ধার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের সারাদিনের লড়াকু তৎপরতা দেশবাসীকে নতুন করে জালিমশাহী থেকে মুক্তির আশা জুগিয়েছে।

আমাদের হারাবার কিছু নেই বরং আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য আমরা লড়াইয়ের পুঁজি ও প্রশিক্ষণ পেয়েছি। জনগনের আস্থা এবং ভালোবাসা পেয়েছি। আমাদের জোট বন্ধুদের ব্যতিক্রমী ভালোবাসা সঞ্চয় করেছি। এসবই আমাদের সংগ্রামী পথচলায় অনেক বড় অর্জন। আলহামদুলিল্লাহ।।
আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন, আমাদের সকল ভরসা কেবলমাত্র তারই উপর। ঈমানকে দৃঢ় করে আমরা দ্বীন বিজয়ের জন্য আমৃত্যু অবিচল অটল থাকবো, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর ঘোষণাই আমাদের চুড়ান্ত পাথেয়- "তোমরা হতাশ হয়ো না দুঃখ পেয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি সত্যিকার মু'মিন হয়ে থাকো"-(আলকুরআন)।

আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচনের নমুনা: শেখ ফরিদ লিখেন, বিএনপি জামায়াত জোট ভাঙ্গার জন্য দীর্ঘদিন যাবত চেষ্টা করে না পারলেও সিলেট নির্বাচনে দিনভর ভোট ডাকাতি ও বিকেলের দিকে ভোট বর্জন করার পরও আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয় কিছুটা হলেও কাজে লাগতে পারে। এই কুট কৌশল বাস্তবায়নে বলির পাঠা বানানো হয়েছে নিজ দলীয় নেতা কামরানকে।
সিলেটে জুবায়েরের ১০ হাজার ভোট যেমন মিথ্যা, তেমনি বরিশালে সরোয়ারের ১৩ হাজার ভোটও মিথ্যা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ দলীয় জোট সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছে!! তারা যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনে বিএনপি- জামায়াত আলাদা নির্বাচন করতো তাহলে জোটের জন্য ভাল হতো। বিএনপি অন্তত আরও ২/৩ টি সিটিতে জিততে পারতো!!
হারাবার কিছু নেই: সিলেটের অধিবাসী, প্রবাসী আবু সালেহ ইয়াহইয়া বলেন, জাতীয় রাজনীতি, সামনের জাতীয় ইলেকশন ও বিএনপি জামায়াত জোটের ভবিষ্যত নির্ধারণসহ অনেক গুলো হিসেব কষে কষে সিসিকের রেজাল্ট নামক গরম বার্গার রেডি করা হচ্ছে। এরপর তা মিডিয়া, বাম, সুশীল সমাজ এমনকি বিএনপিও আওয়ামীলীগ এর সাথে তাল মিলিয়ে চেটে চেটে খেয়ে ঢেকুর তুলতে থাকবে।

ঘড়ি প্রতীকের জুবায়ের ভাই ও তার সমর্থকদের হারাবার বা হতাশ হবার কিছু নেই। বরং আপনারাই দেখিয়ে দিয়েছেন জালিম যত বড়ই হোক না কেন, তার আক্রমণ যতই নির্মম ও নৃশংস হোক না কেন তার বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়।
ভোগবাদী সভ্যতা ও রাজনীতিতে আদর্শিক রাজনীতির কোন স্পেস কেউ দেবেনা, দিতে চায় না। এই রাজনীতি চায় না জুবায়ের এর মত নেতার উত্থান। জনগণ যাতে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তির সেবা না পায় তার জন্য সবই করতে পারে এই কলুষিত রাজনীতি। এখানে আওয়ামীলীগ বিএনপি সবাই সবার বন্ধু।
আদর্শিক রাজনীতির পথ পরিক্রমায় মাঝে মাঝে মৌসুম উপযোগী অস্থায়ী কিছু বন্ধুর দেখা মিলে কিন্তু স্থায়ীভাবে কেউ কখনো বন্ধু হয় না, হতে পারে না। এটা মাথায় নিয়েই আমাদের সামনের পথচলা ঠিক করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/340215