২ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৩

কয়লা কি বাতাসে ওড়ে?

মো: তোফাজ্জল বিন আমীন

একটার পর একটা খারাপ সংবাদ আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক সুবিচার ও আইনের সুশাসনের সব সূচককে ভূলুণ্ঠিত করলেও একশ্রেণীর দলকানা বলছেনÑ সব কিছু ঠিকঠাক, কোনো সমস্যা নেই; দেশ উন্নয়নের মহাসাগরে ভাসছে। তারা না দেখছেন মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি, না দেখছে গুম-খুন-অপহরণ বা ধর্ষিতার চোখের পানি। দুর্নীতির মহোৎসব চললেও শাসকশ্রেণী উন্নয়নের মোহে জাতিকে বুঁদ করে রাখতে চায়। দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেও কেন দুর্নীতি বন্ধ করা দূরে থাক, কমানোও যাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু আফসোস করে বলেছিলেন, ‘আমি সারা দুনিয়া থেকে বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য ভিক্ষা করে আনি আর তা সাবাড় করে দেয় চাটার দল।’ সাম্প্রতিককালে ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের চিত্র তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেনÑ এই খাতে পুকুর নয়, সাগরচুরি হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিনৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সমালোচনা করলে ক্ষমতাসীনেরা অতীতের প্রসঙ্গ টেনে বলে থাকেন, আগের আমলে আরো বেশি দুর্নীতি হয়েছে। অথচ এখনো বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। আমাদের নিচে আছে কেবল আফগানিস্তান। উন্নয়ন দিয়ে দুর্নীতির সূচকের পরিবর্তন করা যায় না, এটা অনুধাবন করা প্রয়োজন।

একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার জরুরি। অপর দিকে, অন্যায়, জুলুম, অবিচার, অনিয়ম, দুর্নীতি বা চুরির অভিযোগ যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ওঠে, তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, সরষের ভেতরেই ভূতের বসবাস। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতি প্রভৃতি বাংলাদেশে নতুন নয়। এবার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কয়লা উধাও হওয়ার আগেও দেশে অনেক দুর্নীতির বড় ঘটনা ঘটেছে, যার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া কথিত দুর্নীতির মামলায় দুদককে অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেলেও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া কিংবা আবদুর রহমান বদির মতো ক্ষমতাসীন দলের ডজনখানেক নেতার মামলায় কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা রহস্যজনক।
বেগম জিয়া ১১ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে। এ সময় দেশে আইনের শাসন ও সুনীতির বন্যা বয়ে যায়নি। খালেদার আমল ধোয়া তুলসী পাতা কিংবা দুর্নীতিমুক্ত ছিল তা যেমন মোটা দাগে বলা যাবে না, তেমনি এ সরকারের শাসনামলকে দুর্নীতিমুক্ত সনদ দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নিকট অতীতে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা এবং সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সে দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা; এসব তথ্য কি প্রমাণ করে যে এ দেশে দুর্নীতি হচ্ছে না? অথচ দুর্নীতির কুশীলবেরা ধরা পড়ছে না। আর ধরা পড়লেও তাদের বিচার হয় না। যদি সত্যিকার অর্থে বিচার হতো, তাহলে ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মূল হোতারা কিভাবে এতদিন বাইরে থাকে? ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রেস্ট জালিয়াতি, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বেপরোয়া লুণ্ঠন ও চুরি এবং সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে স্বর্ণ জালিয়াতির খলনায়কেরা কিভাবে দাপট দেখায়? এসব বড় বড় দুর্নীতির জন্য যারা দায়ী, তাদের আইনের আওতায় না আনলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বাড়তেই থাকবে। এসব ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন ঘরানার লোকেরাই জড়িত। উদ্দেশ্যমূলক ব্যবস্থা নিয়ে নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানো যায়, কিন্তু রাষ্ট্রে সুবিচার কায়েম করা যায় না।

একটি দেশের রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রের অভিভাবক। রাজনীতির চাকা এগোলে অর্থনীতিও সমানতালে অগ্রসর হয়। কিন্তু রাজনীতি পিছিয়ে গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল জনগণ ভোগ করতে পারে না। কারণ, সেটি তখন অন্যরা খেয়ে ফেলে। বাংলাদেশের অর্থনীতি তারই প্রমাণ দিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন ৩২.৫ বিলিয়ন ডলার, তখন বছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। তখন উন্নয়নের নামে লুটপাটের রাজত্ব সর্বত্র বিরাজ করে। ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করে তার ছিটেফোঁটাও যদি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রতিরোধে করা হতো তাহলে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা উধাও হতে পারত না। কোল্ড মাইনিং কোম্পানিটি ১৯৭৮ সালে বড়পুকুরিয়া বাজারে একটি সেচপাম্প বসাতে গিয়ে কয়লার সন্ধান পায়। ১৯৯২ সালে চীনা কোম্পানি সিএমসির সাথে চুক্তি হওয়ার পর ১৯৯৪ সালে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। ২০০৬ সালে খনিটি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হওয়ার পর ২০০৮ সালে এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয় বিবেচনায় খনি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি,স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ দেয়ার ফলেই এটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

দুদকের প্রাথমিক তদন্তে কয়লা চুরির আলামত পাওয়া গেছে। কাগজপত্রে কয়লা থাকার কথা এক লাখ ৪৬ হাজার টন, সেখানে মজুদ আছে দুই হাজার টনের মতো। বাকি এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হলো কী করে? পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে কোনো ডিও ছাড়াই খনি থেকে ৩০০ মেট্রিক টন কয়লা বের হয়ে যায়। আবার ‘অদৃশ্য’ শক্তির মাধ্যমে খোয়া যাওয়া কয়লার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করে দেয়া হয়েছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার থাকার পরও গেট দিয়ে ট্রাকভর্তি কয়লা কারা বের করে নিলো, সে প্রশ্নের উত্তর আজো জানা হয়নি। এর আগে ২০০৮ সালে দুই কোটি ৯ লাখ টাকার তামা চুরি হলে মামলা হয় বটে, কিন্তু সে তামা উদ্ধার করা হয়নি। এত দিন জানতাম পেট্রল বাতাসে ওড়ে। এবার নতুন করে জানতে পারলাম, কয়লাও নাকি বাতাসে ওড়ে। কবে যে শুনব, স্বর্ণও বাতাসে ওড়ে যায়, সেই অপেক্ষায় জাতি। এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা কি উধাও হয়ে যেতে পারে?
বাংলাদেশ খনিজ সম্পদের দেশ। এটা একক কোনো সরকার কিংবা দলের কৃতিত্ব নয়। মহান আরশের মালিক আল্লাহ তায়ালা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশের মাটির নিচে প্রচুর খনিজ সম্পদ দান করেছেন। অথচ আমরা ক্ষমতার মোহে দাম্ভিকতার সাথে স্রষ্টার বিধানকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে চলেছি। বাংলাদেশ জ্বালানি চাহিদার শতকরা দুই ভাগ কয়লাশক্তি থেকে মিটিয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই বিলিয়ন টন কয়লার মজুদ রয়েছে আমাদের দেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। ভারত ও চীনসহ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার প্রয়োজন মেটাতে কয়লাশক্তির ওপর নির্ভর করলেও আমরা কয়লার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি।
২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হওয়া থেকে এ পর্যন্ত যত কর্মকর্তা কোল মাইনিং কোম্পানির দায়িত্বশীল পদে ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। জালিয়াতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যহারের মাধ্যমে এক লাখ ১৬ হাজার টন কয়লা খোলাবাজারে বিক্রি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ চার কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিতে শুধু কি আমলারাই জড়িত, নাকি অন্য কেউ সম্পৃক্ত, তা উদঘাটন জরুরি। দেশবাসী আশা করে, সরকার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে কয়লা লুণ্ঠনকারীদের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করবে। হ

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/338083