২ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১১:৩১

পরিবহণ সেক্টরের ভয়াবহ নৈরাজ্য এবং অরাজকতা মেনে নেয়া যায় না

অলিউর রহমান ফিরোজ : দেশের পরিবহণের নৈরাজ্যের কারণে অকালে ঝড়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ-তরুণীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পরিবারে আশা-আকাক্সক্ষা মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে পরিবহণের চালক নামের বিবেক-বিবর্জিত মানুষগুলো। তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দরুন সড়কে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। কিন্তু তাতে করে রাষ্ট্রের যেন কোন প্রকার মাথা ব্যথা নেই। জবাবদিহিতার কোন বালাই নেই। যে যেভাবে পারছে মানুষকে জিম্মীদশায় পরিণত করে ছাড়ছে। গজারিয়ায় পায়েলকে বাসের সুপার ভাইজার থেকে শুরু করে হেলপার এবং চালক যেভাবে নৃশংসভাবে নদীতে ফেলে দিল তা সভ্য সমাজে চিন্তা করা যায় না। তাদের পশুর সাথে তুলনা করলেও পশু সমাজের দুর্নাম করা হবে। পশুর আচরণে এতোটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। তারা বিনা কারণে অন্য কোন প্রাণীকে এভাবে হত্যা করে না। তাকে যদি আহত অবস্থাতেও ফেলে যেতো তাহলেও কোন মানবকুলের কারণে সে বেঁচে যেতো। এদিকে আরো ভয়ানকভাবে কুর্মিটোলা ফ্লাইওভারের ঢালে দুই বাসের রেষারেষিতে জাবালে নূর গাড়ির চালক গাড়ির জন্য অপেক্ষারত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর যেভাবে বাসটি উঠিয়ে হত্যা করলো সে নিষ্ঠুরতার কোন হিসাব মিলে না। আহতদের চিৎকারে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। এর আগে রাজীবের ঘটনাটি দেশের মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। বাবা-মা হারা রাজীবের আরো দুটি ভাই ছিল। যারা রাজীবের ভবিষ্যৎ পথের দিকে চেয়ে ছিল। আজ রাজীবের সেই এতিম ভাইগুলো রাজীবকে হারিয়ে যেন আরো এতিম হয়ে গেলো। সেই ঘটনা যদি রাষ্ট্রে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে , তাদের মনন জুড়ে যদি সামান্যটুকু রেখাপাত করতে পারতো তাহলে কুর্মিটোলার ফ্লাইওভারের ঘটনা ঘটতে পারতো না। বেসরকারী ফার্মে কর্মরত রূপার কথা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। সামান্য সুযোগ পেয়ে মেয়েটির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাসের হেলপার, চালক এবং সুপারভাইজার। তাদের লালসার নখড়ে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল রূপার শরীর। ভোগ শেষে তারা নিষ্ঠুরভাবে রূপাকে হত্যা করে বনের নির্জন জায়গায় ফেলে যায় হায়েনার দল । বনের কোন পশু, হিংস্র জানোয়ার রূপার শরীরে একফোঁটাও নখের আঁচড় বসায়নি। সে ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আরেক পোশাক কারখানার নারীকে চলন্ত বাসে জোরপূর্বক হায়েনারা লালসা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নারীর জীবন-যৌবন এতো সস্তা নয় যে তারা ভোগ করবে। তাই চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে তার সতীত্ব রক্ষা করেছেন। গণপরিবহণে যদি একজন পায়েলকে হত্যার শিকার হতে হয়। চলন্ত গাড়িতে যদি রূপার ইজ্জত লুট হয়ার পর মৃত্যু ঘটে, তাহলে এর দায়ভার কে নিবে? রাষ্ট্র যদি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে না আসে তাহলে হায়েনাদের কবল থেকে আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা কিভাবে হবে তা তাদেরকে এখনই জানাতে হবে। সবচেয়ে অবাকীয় বিষয় হলো-কুর্মিটোলায় বাসচাপার ঘটনাটি শুনে দেশের নৌপরিবহণ মন্ত্রী বলেছেন, ভারতে বাসচাপয় মানুষ মরলেও তো এরকম হৈচই হয় না। আমাদের দেশে কেন এরকম হয়? তার এ বক্তব্যে দেশের মানুষের মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে একজন পাগল মন্ত্রী এক ছোট বাচ্চা মারা যায়ার ঘটনায় বলেছিল আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে। তখনকার সময় সে বক্তব্যে দেশের মানুষের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। মূলত বাসের চালক হিসেবে যারা স্টিয়ারিংয়ে বসেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অত্যন্ত কম। তার পর রয়েছে পেশাগত দক্ষতা। সেখানে অধিকাংশ চালকেরই কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। একজন প্রশিক্ষিত চালক যখন লাইসেন্স নিতে যান তখন তাকে গাড়ি চালানোর বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। গাড়ি চালানোর জন্য অনেক নিয়ম-কানুন জানতে হয়। কিন্তু একজন হেলপার থেকে যখন গাড়ি চালকের আসনে বসেন, তখন তার ভেতরে কোন অভিজ্ঞতার ছোঁয়া থাকে না। গাড়ি নিয়ে সড়কে বের হলেই বেপরোয়া ভাব তার মধ্যে তৈরী হয়। তাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা মানুষের অহরহ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। অনেকে আবার রাস্তার পাশে বসা দোকানের ওপর গাড়ি উঠিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। মহাসড়কের পাশে রাতে পরিবার নিয়ে ঘুমিয়ে আছে ,তাদের ওপর গাড়ি চালিয়ে পুরো পরিবারটি ঘুমের ঘোরেই হত্যা করার মতো ঘটনা আমাদের দেশে আছে। তারা অনেক সময় গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইলে কথা বলেন, যা নিষিদ্ধ। কিন্তু কে মানছে কার কথা। অনেক সড়ক আছে যেখানে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাস্তার মাঝে গতিরোধক যন্ত্র বসিয়ে গতি মাপা হচ্ছে। তারপরও তাদের গতি, কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না, মানুষ মারা রোধ করা যাচ্ছে না। পঙ্গু হাসপাতালগুলোতে গেলে বুঝা যায় সড়কে আহত মানুষের করুণ আহাজারী। কুর্মিটোলার দুর্ঘটনায় আবদুল করিম এবং দিয়া খানমের লাশ গোড়ে নেয়ার আগেই আবার আমরা শুনতে পাবো অন্য কোন সড়কের খবর। তারপর হয়তো এ ঘটনা আমরা ভুলেই যাবো। এভাবেই কি আমাদের পরিবহণের নৈরাজ্যে চলতে থাকবো? আমরা কি এর কোন গতিরোধ করতে পারবো না? তবে সমস্যা রয়েছে এ দেশের পরিবহণ আইনের। একজন পথচারীকে কোন চালক চাপা দিয়ে হত্যা করলে তার জন্য রয়েছে মাত্র ৬ মাসের জেল জরিমানা। আইনের দুর্বলতা সংশোধন করা না গেলে চালকদের গতি রোধ সম্ভব নয়। আবার কোন চালককে যদি গ্রেফতার করা হয় তার জন্য দেশের পবিহণের নেতারা ধর্মঘট ডেকে পুরো দেশ অচল করে দেন। তাদের আগে আইনের জালে ধরতে হবে। কোন গাড়ির মালিক যখন ড্রাইভার নিয়োগ দেন, তার অবশ্যই ড্রাইভার লাইসেন্স থাকতে হতে, এটা নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। সরকারের পক্ষ থেকেও ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত পরিবহণ সেক্টরকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে সরকারকে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিতে হবে। শিক্ষিত চালকদেরই ধীরে ধীরে গাড়ির চালকের আসনে বসাতে হবে, এটাই হবে সরকারের অগ্রগতির প্রথম ধাপ। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের জন্য কান্না। এখন প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতদিনিই সড়কের মৃত্যু মিছিল লম্বা হচ্ছে। তাতে করে কারো জীবন চিরতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার পঙ্গুত্ব বরণ করে অন্যের কাঁধের বোঝা হচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো-বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। এখন আবার দুর্ঘটনার নতুন মাত্রা পেয়েছে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা। তাদের কোন নিয়মনীতির মধ্যে আনা যাচ্ছে না। মোটর সাইকেল চালকরা অনেক সময় রাস্তায় জ্যাম থাকলে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতেও গাড়ি উঠিয়ে দেন। এতে পথচারীরা ফুটপাত ধরে হাঁটতে পারে না। বেপরোয়া ও অনিয়মের মধ্যে গাড়ি চালাতে যেয়ে অযথা হর্ণ বাজানোরও প্রবণতা লক্ষণীয়। এতে করে মারাত্মকভাবে শব্দ দূষণ ঘটছে। শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছে অসুস্থ ও হার্টের রোগীরা। যে সড়কে যতোটুকু গতি রয়েছে, গাড়ি চালাতে তা অবশ্যই মানতে হবে। নইলে ভয়াবহ দুর্ঘটরা যে কোন সময়ে। এখানে একটি কথা বলতে হয়, মোটর সাইকেল চালানোর জন্য কিছু নির্দিষ্ট সড়ক রয়েছে। রয়েছে গাড়ির কিছু নিয়ম-কানুন। মোটর সাইকেল নিয়ে মহাসড়কে চলাচল করা আর আজরাইলের হাতে জান সোপর্দ করারই শামিল। কারণ, মহাসড়কে বেশি গতির যানবাহন ছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলাচল করলে তখনই ঘটে বিপত্তি। বড় গাড়ির লুকিং গ্লাসে অনেক সময় ছোট মোটর সাইকেল ধরা পড়ে না। নিয়ম না মেনে ওভারটেক করাও বিপদজনক। তাই মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। তাছাড়া দুর্ঘটনায় হতাহতের বেশি কারণ হলো-নিয়ম মেনে কেউ গাড়ি চালায় না। মাথায় হেলমেট পড়ার কথা থাকলেও তার যথাযথ পালন করেন না মোটর সাইকেল চালকরা। তাই কোনরকম দুর্ঘটনা ঘটলেই মৃত্যু আসন্ন হয়ে যায়। বড় গাড়ি থেকে প্রাইভেটকারের চালকদেরও সিটবেল্ট বাঁধার নিয়ম রয়েছে। তারা এ ক্ষেত্রে গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছেন। যতো ধরনের খামখেয়ালীপনা আছে তা যেন গাড়ি চালকদের মধ্যে বিরাজমান। প্রশিক্ষিত একজন ড্রাইভারের যেমন থাকে গাড়ি চালানোর নিয়মন কানুন জানা, তেমনি থাকে কখন কিভাবে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ৮০ ভাগ চালকেরই কোন ধরনের প্রশিক্ষণ নেই, লাইসেন্স নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলাও গাড়ি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। আমরা প্রতিদিন সড়কের দিকে তাকালে দেখতে পাই অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে সড়কগুলোতে। মহাসড়কের নিয়মহীনভাবে যত্রতত্রভাবে রোড ডিভাইডার বসানোর ফলেও মোটর সাইকেল মুহূর্তের মধ্যে উল্টে যেয়ে দুর্ঘটানর শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো- মোটর সাইকেল চালকদের মধ্যে বেশিরভাগই যুবক শ্রেণীর। তাদের মধ্যে নিয়ম মানার প্রবণতা খুবই কম প্রতীয়মান। সড়কে অনেক সময় বড় গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। কিছু দুর্ঘটনা দৈবপাকে হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বেপরোয় এবং অযাচিত গাড়ি চালনাই দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোটর সাইকেল চালকদের নিয়ম মানার লক্ষ্যে ট্রাফিক পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও তাতে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না । কোন কোন রোডে ছোট গাড়ি চালানো যাবে তার সম্যক ধারণা আগে জানতে হবে। যে সড়কে গাড়ি চলবে তার গতি কিলোমিটারে কতো আছে তা জেনে নিতে হবে। সবচেয়ে দিকনির্দেশনা হলো-গতি কমাও দুর্ঘটনা কমাও, মৃত্যু হার কমাও, এটাই হোক আগামী দিনের গাড়ি চালানোর শ্লোগান।

http://www.dailysangram.com/post/340284