১ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১১:১৩

বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা

নেপথ্যে মালিক চালক নেতাদের মুনাফালিপ্সা

রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বর সেকশন থেকে আগারগাঁও, মহাখালী, কাকলী, গুলশান হয়ে নতুন বাজার পর্যন্ত ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে বাস স্টপেজ (থামার স্থান) আছে ১০টি। এই পথে চলাচল করে বিহঙ্গ পরিবহনসহ বিভিন্ন কম্পানির বাস। সিটিং সার্ভিস, গেটলকসহ বিভিন্ন নাম দিয়ে এসব বাস চালানো হয় অনুমোদন ছাড়াই। নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াও যেখানে-সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলা হয় এসব বাসে। যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই চালকরা বাস থামিয়ে দেয় আর চালকের সহকারীরা ডাকাডাকি করে, হাত ধরে টেনে তোলে যাত্রীদের। আবার যাত্রীরাও হাতের ইশারা দিলে বাস থামিয়ে তুলে নেওয়া হয়।

সুপ্রভাত পরিবহন চলাচল করে ঢাকার সদরঘাট থেকে গাজীপুরের গাজীপুরা রুটে। সদরঘাট ও গাজীপুরা ছাড়াও এই রুটে বাস থামার নির্দিষ্ট স্থান আছে গুলিস্তান, রামপুরা, বাড্ডা, নতুন বাজার, বিশ্বরোড, উত্তরা, টঙ্গীতে। এই কম্পানির বহরে বাস আছে সাড়ে তিন শর মতো। নিয়মিত চলাচল করে প্রায় ২০০ বাস। এসব বাস চলাচল করে প্রগতি সরণি ও বাড্ডা মূল সড়ক ধরে। তবে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়াও যেখানে-সেখানে যাত্রী তোলা হয় ওই কম্পানির বাসে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কুড়িলের কাছে ৩০০ ফুট সড়কের পাশে এ কম্পানির ৪০টি বাস পার্কিং করে রাখা ছিল। সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব ১২-০৮৬৯) চালক নওয়াব আলী বাসের ভেতর বসে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন পরিস্থিতি নিয়ে। রাস্তায় অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এবং যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা-নামানোর কারণ জানতে চাইলে বাসচালক নওয়াব আলী বলেন, যাত্রীরাই ইচ্ছামতো স্থানে নামতে চায়। একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, তাঁরা নিজেরাই প্রতিযোগিতা করে বাস চালান যাত্রী তোলার জন্য। তিনি জানান, যানজটে ট্রিপ (প্রতিবার যাওয়া-আসা) কমে গেছে। দুই বছর আগে দিনে ছয় ট্রিপ দিতে পারতেন, এখন তিন ট্রিপও হয় না। মালিকের হাতে আয়ের অর্থ তুলে দিতেই যাত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাই রাস্তায় যাত্রীর দিকেই চোখ থাকে চালকদের।
ঢাকা থেকে আশপাশের এলাকায় এবং ঢাকার ভেতরে বাস চালানোর রুট আছে ২৪৬টি। এসব রুটে চলাচল করে প্রায় আট হাজার বাস। ঢাকার ভেতরেই ২০০ বাস স্টপেজ চিহ্নিত করে অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কম্পানিজ সাইনবোর্ড টানিয়েছিল দেড় দশক আগে। সাইনবোর্ডগুলো এখনো আছে, তবে ওই সব স্টপেজের মধ্যে ৯০ শতাংশ স্থানেই বাস থামানো হয় না। রাজধানীতে গণপরিবহনের তীব্র সংকট, ফুটপাতের অভাব এবং ওভারব্রিজ যথেষ্ট ও যথাস্থানে না থাকায় পথেই বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। বাসে উঠতে যাত্রীদের মধ্যেও থাকে প্রতিযোগিতা। বাদুরের মতো ঝুলে হলেও বাসে উঠতে হয় তাদের। গতকাল সকালে মিরপুর-১০, কল্যাণপুর, কালশী মোড়, মহাখালী, বনানী, কাকলীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতা করে বাস চালিয়ে যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। রাজধানীতে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী তুলতে গিয়ে স্টপেজে বাস রাখা হয় এলোপাতাড়িভাবে। তাতে মূল সড়কের বড় অংশই দখলে থাকে ওই সব বাসের। মোড়ে মোড়ে, বাস স্টপেজে তাই যানজট তীব্র রূপ নেয়। ফার্মগেটে বাস-বে থাকা সত্ত্বেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর ওপর বাস তুলে দেওয়া হয়।
ঢাকায় বাসখাতে বিশৃঙ্খলায় দিনে গড়ে অন্তত একজনের প্রাণহানি ঘটছে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, গত বছর ঢাকার রাস্তায় ৪১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যমতে, দেশে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ শতাংশই ঘটে শহরে। দেশের শহরাঞ্চলে দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঘটছে ঢাকায়। এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার রাস্তায় যাত্রী তুলতে ফুটপাতের পাশে বাস দাঁড় করানো হয়।
গত ১০ এপ্রিল ফার্মগেটে চালক বাস তুলে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী রুনি আক্তারের পায়ের ওপর। প্রথমে পঙ্গু হাসপাতালে ও পরে ইবনে সিনা হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা করানো হয়েছিল। গত ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজারে সার্ক ফোয়ারার কাছে দুই বাসের চাপায় ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের। শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে প্রাণহানি ঘটে রাজীবের। গত রবিবার দুপুরে বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা কেড়ে নেয় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর প্রাণ। ওই দুটি বাসের একটির (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭৬৫৭) ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ১৮ মে। আরেকটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭) রুট পারমিটের ফিসও জমা দেওয়া হয়নি। জানা গেছে, শিক্ষার্থী হত্যায় জড়িত বাস দুটির নিবন্ধন বাতিল করবে বিআরটিএ।
বাসখাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সব শেষ প্রস্তাব তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক। পরিবহন মালিক ও অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনক্রমে আনিসুল হক ওই কাজে অনেকটা এগিয়ে গেলেও তাঁর মৃত্যুর পর সেটি আটকে গেছে।
ডিএনসিসির অধীনে বাস সংস্কার ও কম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনার প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেন ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৭ সালের ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিএনসিসিকে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, বিদ্যমান প্রায় ২০০ বাস কম্পানিকে কমিয়ে ছয়টি কম্পানি করা হবে। ২৪৬টি রুট কমিয়ে আনা হবে ২২টিতে। মোট লাভের অর্থ সব মালিক সমানভাবে পাবেন বাসের সংখ্যা অনুপাতে। তাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকবে না। প্রতিটি কম্পানির বাস হবে নির্দিষ্ট রঙের। এর মধ্যে গোলাপি রঙের সব বাস চলবে কোনাবাড়ী, মৌচাক, গাজীপুর, কাপাসিয়া, শ্রীপুর, চেরাগ আলী থেকে শিমরাইল, পোস্তগোলা, সদরঘাট, ঝিলমিল, মিরপুর, গাবতলী, আজিমপুর রুটে। এ কম্পানির রুট হবে ৪৬টি। বাস থাকবে ১৯৮১টি। এভাবে ছয়টি রুটে বাস চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

ড. সালেহ উদ্দিন আরো বলেন, ‘ঢাকায় পরিবহনখাতে বিশৃঙ্খলা দূর করতে হলে প্রথমেই বাস সার্ভিস উন্নত করতে হবে। আমরা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করেছি। আমরা দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করে বাস কম্পানি পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করেছি। তবে কাজে গতি নেই।’ তিনি বলেন, ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকরা কেন গতিশীল হচ্ছেন না বুঝতে পারছি না।’
বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্যমতে, ঢাকায় দিনে যানজটে নষ্ট হচ্ছে কমপক্ষে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। একটি রুটেই অতিরিক্ত জ্বালানি পুড়ছে ১০ হাজার কোটি টাকার। সব মিলিয়ে যানজটে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৯৮ হাজার কোটি টাকার। এর বড় কারণ বাসখাতের বিশৃঙ্খলা। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০০৪ সালে। ২০০৪ সাল থেকে ২০ বছর মেয়াদি এসটিপিতে ঢাকাকে বাঁচাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বাসখাতে শৃঙ্খলা আনার ওপর। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ওই সুপারিশ ১৪ বছর ধরেই উপেক্ষিত রয়েছে। জানা গেছে, বাসখাতে বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বজায় রাখতেই প্রভাবশালী পরিবহন নেতা ও মালিকরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আঁতাত করে ওই সব সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় বাস চালাতে দিনে ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় প্রতিটি বাসকে। চাঁদা নেওয়ার বিভিন্ন স্থান থাকে। ওই চাঁদা দিতেও বাসগুলোকে স্থানে স্থানে থামাতে হয়। চাঁদা না দিয়ে বাস চালানো যায় না। মালিক সমিতি দৈনিক প্রতিটি বাস থেকে ৪০ টাকা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর নামে প্রতিটি বাস থেকে ৩০ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন ছাড়াও নানা কারণে চাঁদা দিতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। বাসচালকরা জানান, ফিটনেসহীন, লাইসেন্স না থাকা, আইন অমান্য করে বেপরোয়া বাস চালানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশ ধরলে চাঁদা দিতে হয়।

জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাবে ও চাঁদায় নেওয়া হচ্ছে রুট পারমিট। তাতে অপরিকল্পিত ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে এবং বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। ঢাকায় বাস চালানো হয় মালিকের সরাসরি তদারকিতে আর মালিক-চালক চুক্তিতে। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতিভুক্ত বিভিন্ন পরিবহন মালিক জানান, চুক্তিতেই এখন বেশি বাস চলাচল করছে। মালিক নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে চালক বা পরিবহন শ্রমিকের কাছে তাঁর বাস ভাড়া দিচ্ছেন। চালক-শ্রমিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করলে বাসে সারা দিন কতজন যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে, তা পথের নির্দিষ্ট স্থানে থাকা কম্পানির কর্মীরা লিখে রাখে। এটা দেখেই দিন শেষে আয় হিসাব করা হয়। চালক-শ্রমিকের কাছে বাস-মিনিবাস দৈনিক চুক্তিতে দিলে দিনে বাসটি কতবার চলবে সেটাও নির্দিষ্ট করা থাকে। বাড়তি চালালে মালিককে বাড়তি টাকা দিতে হয়। পরিচালনার সব ব্যয় বাদে নিজেদের আয় বাসায় নিতে হয় চালক-শ্রমিককে। এ জন্যই চালকরা যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বা প্রতিযোগিতায় নামছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/08/01/664543