৩১ জুলাই ২০১৮, মঙ্গলবার, ১২:২৮

সড়ক-রেলপথ অবরোধ দিনভর বিক্ষোভ

জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে গতকাল সোমবার বিক্ষুব্ধ সহপার্টিরা দিনভর রাস্তা ও রেল লাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। দুই শিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খানের পদত্যাগ দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে হাসতে হাসতে প্রতিক্রিয়া জানানোয় নৌ-পরিহন মন্ত্রীকে বিদ্রুপ করেছেন বলে মনে করছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এজন্য শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি করে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিহত মীমের বাবা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। র্যা ব ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২বাস চালক ও ২জন হেলপারকে গ্রেফতার করেছে। গতকাল সকাল থেকে বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে বিক্ষোভে অংশ নিতে থাকেন। দুপুর ১২টার দিকে আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে বিমানবন্দর সড়কের উভয় পাশ বন্ধ করে দেন। সকাল থেকে শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা মন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। অবরোধের এক পর্যায়ে দুপুর দেড়টার দিকে শেওড়া রেলগেটে রেললাইনের উপরে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তাজনিত কারণে দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে সব ধরনের রেল চলাচল বন্ধ রাখে রেল কর্তৃপক্ষ। পরে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসে বিকেল ৪টার পর পুরো পুরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার সকাল ১১টা থেকে বিমানবন্দর সড়ক (হোটেল র্যা্ডিসনের সামনে) অবরোধ করে রাখে ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ কারণে বনানী থেকে উত্তরা, উত্তরা থেকে বনানী ও কালশি হয়ে উত্তরা যাওয়ার সড়কগুলো অচল হয়ে পড়েছে। এসব রাস্তার উভয় প্রান্তে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। অবরোধের কারণে হজযাত্রীরা আটকা পড়েছে জানিয়ে সড়ক ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল পুলিশ ও রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষকরা। পরে কয়েকজন হজযাত্রীকে বহনকারী গাড়ি ও মোটরসাইকেল ছেড়েছে শিক্ষার্থীরা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্টের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আশেপাশের কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। এগুলো হলো ভাষানটেক সরকারি কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, গুলশার ডিগ্রি কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, বিএফ শাহীন কুর্মিটোলা, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, বনানী বিদ্যানিকেতন কলেজ। অবরোধে ৯ দফা দাবি জানিয়েছে ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে রয়েছে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের ক্ষমাপ্রার্থনা, বাসচালকদের গ্রেফতার, লাইসেন্সবিহীন চালকদের গাড়ি চালানো বন্ধ ইত্যাদি। এসব দাবি বাস্তবায়নে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছে তারা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অবরোধ কর্মসূচি থেকে পাঁচজনকে পুলিশ আটক করেছে। তবে গুলশান বিভাগের ডিসি মোশতাক আহমেদের দাবি, কাউকে আটক করা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবিগুলো হচ্ছে- বেপোরোয়া ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর গতকালের (রোববার) বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে স্পিড ব্রেকার দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।

শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম আপন বলেন, যার সন্তান মারা গেছে শুধু সেই বোঝে হারানোর কষ্ট। আর সেই মৃত্যু নিয়ে একজন মন্ত্রী কীভাবে বিদ্রুপ করেন। এই মন্ত্রীর সেল্টারেই বাস চালকরা বেপরোয়া। আমরা ঘাতক বাস চালকদের ফাঁসিসহ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি।
র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যা ব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) আনোয়ার লতিফ খান বলেন, ঘাতকদের বিচারের বিষয়ে আশ্বস্ত করতে গেলে শিক্ষার্থীরা চিৎকার শুরু করেন। তারা একসঙ্গে বলে উঠেন, নৌমন্ত্রীর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন? তখন আবার অবস্থান অনঢ় রেখে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শেওড়া রেলগেটে রেললাইনের উপরে অবস্থান নিয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে দুপুর দেড়টা থেকে ঢাকার সঙ্গে সব ধরনের রেল চলাচল বন্ধ রেখেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মোজাম্মেল হোসেন জানান, বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। জাবালে নূর পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এএইচএম নোমান বলেন, আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছি। যেহেতু নিহত একজনের বাবা মামলা করেছে, তাই প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। ঘটনার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাবালে নূরের কোনো গাড়ি চলবে না। আব্দুল্লাহপুর-মিরপুর ও মিরপুর-নতুন বাজার রুটে জাবালে নূর পরিবহনের ৬০টি গাড়ি চলে। অভিযোগ রয়েছে, এ দুই রুটের অন্য বাসচালকদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে কথা বলে এ গাড়ির চালকরা। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, যেখানে-সেখানে পার্কিং, ওভারটেকিং সবই প্রভাবের সঙ্গেই করে জাবালে নূর পরিবহনের চালকরা। উল্লেখ গত রোববার দুপুরে হোটেল র্যাখডিসনের সামনে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার ঘেঁষে রাস্তার বাঁ-পাশে দাঁড়ানো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একদল শিক্ষার্থীর উপর উঠিয়ে দেয়া হয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাস। এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন আরও ১৪জন শিক্ষার্থী। প্রতিবাদে তখন বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, অবরোধের মধ্যে গতকাল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্তত ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে বসেন রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষকরা এবং পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এর আগে কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি কুলসুম মাইকে ঘোষনা দেন রমিজ উদ্দিন কলেজের ৪ জন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ৮ জন সহ মোট ১২ জন থাকবেন এ বৈঠকে। বৈঠকে ছাত্রদের দাবীসহ সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। এরপরই কলেজে বৈঠকে বসায় হয়। বৈঠকে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি পেশ করা হয়। ওই কলেজের এক শিক্ষক বলেন, ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত দলের সাথে কলেজের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামাল গনি খান বসেছেন। সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলো। ছাত্ররা ৯ টি দাবির কথা বলেছে। তাদের অধিকাংশ দাবির প্রতি কলেজের কমান্ডার একমত পোষণ করেছেন। সেখানে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃস্টি হয়। পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রনে বাইরে যায়। কেউ কারো কথা শুনছিলে না। ওই শিক্ষক বলেন, এখানে বাইরের কিছু লোক এসে আমাদের কলেজের ছাত্রদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। ফেসবুকেও গুজব ছড়ানো হয়েছে। ঘটনায় মোট ২ জন মারা গেছে। ৯ জন আহত হয়েছে। আহত জুবাইদা, প্রিয়াঙ্কা, আলরাফি, মিমসহ ৯ জনের চিকিৎসা কলেজের অর্থায়নে চলছে সিএমএইচে। সবাই এখন আশঙ্কা মুক্ত। বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকে পুলিশ, র্যা ব এবং মিলিটারী পুলিশের যৌথ টিম ছাত্রদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে উত্তেজনা তৈরি হয়। সেখানে পুলিশকে লক্ষ্য করে ছাত্ররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে এক পর্যায়ে কয়েক পুলিশ সদস্য আহত হয়। এরপরই পুলিশ একত্রিত হয়ে ছাত্রদের ধাওয়া করে। ছাত্ররা পুলিশের ধাওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটার সময় বেশ কিছু গাড়ি ভাংচুর করে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/144917