৩০ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ৯:২৩

খুলনা-গাজীপুরের চেয়েও ভয়াবহ ভোট ডাকাতির শঙ্কা

আজ সোমবার রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একযোগে ভোটগ্রহণ চলবে এ তিন সিটিতে। ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। সুষ্ঠুভাবে ভোট অনুষ্ঠানের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস থেকে। কিন্তু মাঠে বিরোধী দলের প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে। তাদের আশঙ্কা খুলনা ও গাজীপুরের চেয়েও ভয়াবহ ভোট ডাকাতি হতে পারে এ তিন সিটিতে। তার আলামত ইতোমধ্যে ভোটাররা দেখছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ছাড়া আর কোন প্রার্থীই নিরাপদ নয়। বিএনপিসহ অন্যান্য প্রার্থীর কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি চলছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে নানা অভিযোগ দিলেও কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সাধারণ ভোটাররা আশঙ্কা করছেন তাদের ভোট আগেই দেয়া হতে পারে। এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিশেষ মহরার কারণে এসব শঙ্কা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

তিন সিটি থেকে সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিন সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ছাড়া অন্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি এমন উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। তাদের মতে, ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভোটারদের মনে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের বিষয়ে ইসির কর্মকর্তারা প্রতিদিনই আশ্বাস দিচ্ছেন। তবে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের আশ্বাসে সাধারণ ভোটারদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না। বরিশাল নগরীর বঙ্গবন্ধু কলোনির বাসিন্দা গৃহকর্মী তানিয়া বেগম বলেন, এইবার পরথম ভোড দিমু। কিন্তু মোর জামাই কয় যে ভোড দেতে যাওন লাগবে না। হেহানে বোলে আগেই মোগো ভোড দিয়া দেবে।’ রাজশাহীতে বিএনপির পক্ষে কেউ প্রচারে নামলে তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী কিছু নেতাকর্মী বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় পাহারা বসিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আর সিলেটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবাদপূর্ণ অবস্থান, বিএনপির প্রার্থীর নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি, বাসাবাড়িতে পুলিশের হানা, কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে হানাহানিসহ নানা কারণে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কার।
তিন সিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগের স্তূপ জমলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। এমন অবস্থায় সর্বশেষ তিন সিটিতেই বিএনপির প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কমিশন ও আদালতের নির্দেশ থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মী-সমর্থক এমনকি পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিন সিটির বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্য এই অভিযোগের কৌশলী জবাব দিচ্ছে। তারা বলছে, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এর আগে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছিল নির্বাচন কমিশন। এ দুই সিটির নির্বাচনে ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপি’ হয়েছিল বলে বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। কেন্দ্র দখল, জালভোট ও ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া এবং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে এই দুই সিটির নির্বাচনে। আর এসব অনিয়মে সহযোগিতার অভিযোগ উঠে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগের সত্যতা মিলে নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও। গাজীপুরের নির্বাচনের পর নানা প্রশ্নের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল অতীতের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি তিন সিটির নির্বাচনে আর হবে না। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আদতে নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইসির আদেশ মানছে কি না- এ প্রশ্ন তুলছেন তিন সিটির ভোটার এবং প্রার্থীরা। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুজব আর গুঞ্জন। এতে বাড়ছে সাধারণ ভোটাদের ভয় আর আতঙ্ক। এমন অবস্থায় তিন সিটিতে সুষ্ঠু ভোট করে ইসি নতুন নজির গড়বে নাকি খুলনা গাজীপুরের ভোটের মতো নয়া কিছিমের কোন ভোটের মহড়া প্রত্যক্ষ করবে- এটাই আজ দেখার বিষয়।
এদিকে গতকাল রোববার কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ভোট কেন্দ্রে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী মালামাল পাঠিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা। এ ছাড়া শনিবার মধ্যরাতে প্রচারণা শেষ হয়েছে। তিন সিটিতে আজ সরকারি ছুটি পালিত হবে। নির্বাচন কমিশনের স্টিকার ছাড়া কোন যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা টহলে রয়েছে। সেই সাথে থাকবে ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট।
রাজশাহী : এ সিটিতে ভোটার ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ জন এবং নারী ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন। সাধারণ ওয়ার্ড ৩০, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১০। ভোট কেন্দ্র ১৩৮ ও ভোটকক্ষ ১০২৬টি। তবে ১৩৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১১৪টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্বাচন অফিস এই কেন্দ্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে দেখছে। এ জন্য কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ১৯ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে বিজিবি সদস্যরা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় টহলসহ নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। ভোটের পরের দিন পর্যন্ত তারা মাঠে থাকবেন। এ সিটিতে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ২১৭ জন। এর মধ্যে মেয়র পদে প্রার্থী আছেন পাঁচজন। আর ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আছেন ১৬০ জন প্রার্থী। এ ছাড়া ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর পদের প্রার্থী ৫২ জন। মেয়র প্রার্থীরা হলেন, আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খাযরুজ্জামান লিটন, বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির হাবিবুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শফিকুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদ।
বরিশাল : এ সিটিতে ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ১৬৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২১ হাজার ৪৩৬ জন এবং নারী ১ লাখ ২০ হাজার ৭৩০ জন। সাধারণ ওয়ার্ড ৩০, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১০। ভোট কেন্দ্র ১২৩ ও ভোটকক্ষ ৭৫০টি। বরিশাল সিটিতে মেয়র পদে লড়ছেন আওয়ামী লীগের সাদিক আবদুল্লাহ, বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার, জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন তাপস, কমিউনিস্ট পার্টির এ কে আজাদ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের মনীষা চক্রবর্ত্তী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওবাইদুর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বশীর আহমেদ ঝুনু। এ সিটির ৪টি ওয়ার্ডের ১১টি কেন্দ্রে ৭৮টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতিতে। সিটি করপোরেশনের ১২৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫০টির অধিক গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) ও ৬২টি গুরুত্বপূর্ণ এবং ১১টি কেন্দ্রকে সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা। অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি কেন্দ্রে পুলিশ, এপিবিএন এবং আনসার মিলিয়ে ১৪ জন সশস্ত্রসহ মোট ২৪ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ কেন্দ্রে ১২ জন সশস্ত্র পুলিশ, এপিবিএন ও আনসারসহ মোট ২২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। থাকছেন ১০ জন নির্বাহী এবং ১০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া ১৯ প্লাটুন বিজিবি ছাড়াও র্যাবের ৩৫টি টহল দল ও সাদা পোশাকধারীসহ প্রায় সাড়ে ৩০০ সদস্য কেন্দ্রের বাইরে নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন।
সিলেট : এ সিটিতে ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন এবং নারী ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। সাধারণ ওয়ার্ড ২৭, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৯। ভোট কেন্দ্র ১৩৪ ও ভোটকক্ষ ৯২৬টি। এ নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন ৭ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী, স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর জামায়াতের আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র মোয়াজ্জেম হোসেন খান, সিপিবি-বাসদ প্রার্থী মো. আবু জাফর, ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল হক তাহের এবং বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিম। যদিও সেলিম নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এ সিটির ৮০টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘সাধারণ’ তালিকায় থাকা কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ জন সদস্য ‘গুরুত্বপূর্ণ’ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রগুলোতে ২৪ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে ইসি। নিরাপত্তায় র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া মাঠে রয়েছে ১৪ প্লাটুন বিজিবি সদস্য। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে থাকছে ২৭টি মোবাইল ফোর্স। পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যের সমন্বয়ে এর প্রতিটিতে সদস্য থাকবে ৩০ জন। ২৭টি ওয়ার্ডে স্ট্রাইকিং ফোর্সের সংখ্যা থাকবে ৯টি। এর বাইরে নগরীর প্রতি দুই ওয়ার্ড মিলিয়ে এক প্লাটুন বিজিবি মাঠে থাকবে। নগরীর প্রতি ওয়ার্ডে টহল দেবে র্যাবের একটি করে টিম। সেই সঙ্গে মাঠে থাকবেন ১৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট।

 

http://www.dailysangram.com/post/339780-