৩০ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ৯:২০

১০ বছরেও ভল্টের স্বর্ণ বিক্রি না হওয়ার নেপথ্যে

বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত স্বর্ণের নিলাম হয়েছিল ২০০৮ সালে। এরপর গত ১০ বছরে আর কোনো নিলাম হয়নি। এজন্য বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দু’মাস আগে নিলাম ডাকার জন্য শুল্ক গোয়েন্দার পক্ষ থেকে বলা হলেও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

সূত্র জানায়, প্রধান দুই কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত স্বর্ণের নিলাম ডাকা হচ্ছে না। এর মধ্যে একটি হলো- মূল্য খুবই কম দিতে চান স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
অপরটি হলো- ভল্টে জমা রাখা বেশিরভাগ স্বর্ণের বিষয়ে মামলা এখনও বিচারাধীন। নিলাম বন্ধ থাকায় ভল্টে ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ জমা আছে। নিয়ম অনুযায়ী, মামলা নিষ্পত্তির পর রক্ষিত সোনা নিলামে তোলার কথা। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৩শে জুলাইয়ের পর নিলামে আর স্বর্ণ বিক্রি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস এম রবিউল হাসান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার সঙ্গে ঝামেলার কারণে আপাতত নিলাম হচ্ছে না। চলমান সমস্যার সমাধান হলেই শিগগিরই নিলাম ডাকা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, নিলাম ডাকা হলে ব্যবসায়ীরা ৪০ হাজার টাকার সোনার দাম বলে তিন হাজার টাকারও কম। এ কারণে গত ১০ বছর ধরে সোনার নিলাম হয়নি। ২০০৮ সালের নিলামের সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, দেশে নাকি সোনার চাহিদা নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (কারেন্সি অফিসার) আওলাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, বেশিরভাগ সোনা সংক্রান্ত মামলাই বিচারাধীন। আর বিচারাধীন থাকার কারণে সোনার নিলাম হচ্ছে না।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আমাদের কাছে আন্তর্জাতিক বাজার দরে সোনা বিক্রি করলে, আমরা সব সোনা নিয়ে নেবো। আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম আছে, তা-ই দেবো।

বর্তমান বাজার দর অনুসারে, ভালোমানের (২২ ক্যারেট) স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ৪৯ হাজার ৮০৫ টাকা। ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার চলছে ৪৭ হাজার ৫৩০ টাকা, আর ৪২ হাজার ৪৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ।

জানা গেছে, যেসব স্বর্ণের বিপরীতে করা মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং ভল্টে রাখা স্বর্ণ যদি আদালতের মাধ্যমে সরকারের অনুকূলে জব্দ করা হয়, সেসব স্বর্ণের নিলাম করা হয়। তবে যেসব স্বর্ণের বার বা ‘বিস্কুট’ আকারে আছে, সেগুলোকে বিশুদ্ধ স্বর্ণ মনে করা হয়। এগুলো সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নেয়। পরে তারা এগুলোকে রিজার্ভে দেখানোর জন্য ভল্টে রেখে দেয়। নিলামের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে দিয়ে দেয়।

সূত্র মতে, সর্বশেষ ২০০৮ সালে চার দফায় ৯১ কেজি সোনা নিলাম করা হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত ৯৬৩ কেজির কিছু বেশি পরিমাণ জব্দ করা স্বর্ণ আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থায়ী খাতে জমা পড়েছে।

সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে জব্দ হওয়া স্বর্ণের মধ্যে রাষ্ট্রের অনুকূলে আদালত থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া ২ হাজার ৩০০ কেজি সোনা কিনে রিজার্ভে যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বছরে ১৮ কেজি স্বর্ণ রিজার্ভে নেয়ার কথা ছিল। এছাড়া ১০ কেজি স্বর্ণ নিলামে বিক্রির কথা থাকলেও আপাতত তা স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ভল্টে জমা থাকা এই স্বর্ণ নিয়ে তৈরি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শুল্ক গোয়েন্দারা যে স্বর্ণ নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তার মধ্যে অস্থায়ী খাতে আছে ৯৩৫ কেজি ৪৫০ গ্রাম, যার বিপরীতে এখনও মামলা চলমান। আর আদালত থেকে নিষ্পত্তির পর সমপ্রতি স্থায়ী খাতে জমা করা হয়েছে ২৮ কেজি স্বর্ণ। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির ১৫৫টি বারের ১৮ কেজি স্বর্ণ কিনে নিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০ কেজি সোনার অলঙ্কার নিলামের জন্য সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তাসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ মোট ৫ সদস্যের ১টি কমিটি করা হয়েছে। তবে ওই সোনার পরিমাপ ও মান নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে নিলাম প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দারা বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট ৪ হাজার ৬৪৫ কেজি বা ১১৬ মণের বেশি স্বর্ণ জব্দ করেছে। এরমধ্যে বেশির ভাগই আদালত বাজেয়াপ্ত করেছে। বাজেয়াপ্ত সোনার মধ্যে ২ হাজার ২৯৯ কেজি বা ৫৭ মণ ১৯ কেজি স্বর্ণ সমসাময়িক আন্তর্জাতিক দরে কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে ২৪ মণ বা ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ নিয়ে এখন আদালতে মামলা চলছে। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে নিলামের মাধ্যমে কিছু স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে। এছাড়া আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে কিছু স্বর্ণ ফেরত দেয়া হয়েছে।

সর্বশেষ নিলাম হয়েছে ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই। সে সময় ২১ কেজি ৮২২ গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করা হয়েছিল। একই বছরে আরও তিন ধাপে ২৫, ২৫ ও ২০ কেজি স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করা হয়।

এদিকে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে পড়ে থাকা স্বর্ণ কিনতে চান ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের স্বর্ণ কেনার জন্য বাজুস গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে একটি চিঠি দিয়েছে। তবে স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম বলে জানিয়েছেন বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগারওয়াল। তিনি বলেন, স্বর্ণের চাহিদা বাড়লেও আমদানির জটিলতা কারণে ব্যবসায়ীরা সেদিকে যেতে পারেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম অনুসারে নিলাম করে আসছিল। কিন্তু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে বাজারদরের চেয়ে অনেক কম মূল্যে স্বর্ণ কিনে নিতে চায়। ফলে বাধ্য হয়েই নিলাম বন্ধ করে দেয়া হয়।
সমপ্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে সঠিকভাবে স্বর্ণ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটি, তা হয়ে গেছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। যদিও এই প্রতিবেদন সঠিক নয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এত কিছুর পরও স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে এসব স্বর্ণ ভল্টে রেখে না দিয়ে নিলাম করা হচ্ছে না কেন? তাহলে এটা নিয়ে অনিয়মের কোনো প্রশ্ন উঠতো না।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=128258&cat=3/