২৮ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ১১:০০

বড়পুকুরিয়ার কয়লা খাওয়া শুরু না শেষ?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : কয়লা খায় এমন পাগল জীবনে কয়েকবার দেখেছি। এইতো কয়েক বছর আগে মহানগরী ঢাকাতেই সারা গায়ে শেকল জড়ানো এক পাগলকে গটাগট করে কয়লা গিলতে দেখেছিলাম। কয়লা মানুষের প্রিয় খাবার হতে পারে তা কিন্তু তখন ভাবিনি। এখন দেখছি লাখ লাখ টন কয়লাও খেয়ে ফেলতে পারে সুস্থ মানুষ।

হ্যাঁ, ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন মিডিয়া খবর দিয়েছে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উত্তোলিত ১ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিকটন কয়লা গায়েব হয়েছে মানে খেয়ে ফেলেছেন সংশ্লিষ্টরা। গায়েব হওয়া কয়লার বাজারমূল্য ২২৭ কোটি টাকারও বেশি বলে রিপোর্টে প্রকাশ। তবে বড়পুকুরিয়ার কয়লা খাওয়া শুরু না শেষ তা এখনই বলা যাবে না। এটা নিশ্চিত বলা যেতে পারে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর।

এদেশের অনেক কিছুই খেয়ে ফেলে মানুষ। ব্যাংকের রিজার্ভ, গচ্ছিত সোনা, দামি অলঙ্কার সবই খোয়া যায়। খোয়া যায় মানে কেউ খেয়ে ফেলে। অর্থকড়ি বা সোনাদানার মতো খনিজ পদার্থসমূহের তো হাতপা কিংবা ডানাপাখনা নেই যে কোনও ফাঁকে সেগুলো পালিয়ে যাবে বা উড়াল দেবে? ও রকম তাড়না বা অনুভূতিও নেই। কারণ অর্থকড়ি কিংবা সোনাদানা মানুষের কাছে খুব আকর্ষণীয় হলেও তা নির্জীব ও নিশ্চল। এগুলো যেভাবে যেখানে রাখা হয় ঠিক সেভাবেই পড়ে থাকে। মানুষের হাত না লাগলে এসবের কোনও পরিবর্তনের উপায় নেই। এগুলোর মূল্যমান থাকলেও নিজস্ব চলৎশক্তি নেই। মানুষ নাড়লে বা নাড়াচাড়া করলেই কেবল চলে।
আমেরিকারর ব্যাংকে রিজার্ভ রাখা হাজার হাজার কোটি বাংলাদেশের টাকা চুরি হয়ে ফিলিপাইনে গেল। সে টাকা আর ফেরত পাবার আশা নেই। অর্থমন্ত্রী প্রথমে বলেছিলেন, ওটা সামান্য কিছু। মানে আরও কিছু গেলে তিনি খুশি হতেন। দেশব্যাপী এ নিয়ে তোলপাড় হলো। কিন্তু সুরাহা নেই। ফিলিপাইনের তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ, এ চুরির সঙ্গে বিবির লোক জড়িত। এই রিজার্ভ চুরি মানেও খাওয়া। ডলার বা টাকা মেরে দেয়া। গায়েব করে দেয়া।

বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনির জমি অধিগ্রহণের সময় কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেয়া হয়নি। অনেক কৃষকপরিবার এখনও হাহাকার করছে। কয়লা নিয়েও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কয়লা যাতে উত্তোলন না করা হয় এজন্য নানা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের রাণীগঞ্জের কয়লা বাংলাদেশে বিক্রির জন্য বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বন্ধ করে দেবার যড়যন্ত্র এখনও বন্ধ হয়েছে তা বলা যায় না। সেখানকার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জ্বালানির অভাবে গত ২২ জুলাই থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবই কিন্তু হিসেবছাড়া খাওয়াদাওয়ার ফল। এদেশে ভাত, রুটি, ডাল, তরকারি ছাড়াও অনেক খাদ্যবস্তু আছে। যেমন: রাস্তাতৈরির ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর, চুন, সুড়কি, বিটুমিন সবকিছুই খেতে পারে মানুষ। অর্থাৎ নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাক্টররা এসব দিব্যি হজম করে ফেলেন। ফলে রাস্তাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণের অল্পদিনের মধ্যেই নষ্ট হচ্ছে বা ভেঙে পড়ছে। এমনকি সরকারি ভবন, স্কুল ও কলেজের কোনও কোনও ভবন নির্মাণাধীন অবস্থাতেই ভেঙে পড়ছে। রাস্তাঘাট নির্মাণের কয়েক মাসেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এর কারণ হচ্ছে খাওয়াদাওয়া। বেহিসেবি খাওয়া মানে মেরে দেয়া। অনেকেই দেখেছেন, রাস্তাঘাট ও ভবন নির্মাণে রড-সিমেন্টের বদলে বাঁশ ও বালি দিয়েই কাজ সেরে ফেলছেন। এটাকে কোন খাওয়া বলা যেতে পারে? নিশ্চয়ই ডিজিটাল খাওয়া বলা যায়। শুধু যে বিবি’র রিজার্ভ খাওয়া হয়েছে এমন নয়, সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত আরও অনেক ব্যাংকেরই টাকা গায়েব হয়ে গেছে। এরপর দেশটা এখনও টিকে আছে সেটাকে আমাদের ভাগ্য বলতে হয় বৈকি।

এ নিবন্ধ নিয়ে কাজ করবার সময় খবর পাওয়া গেল, বড়পুকুরিয়ার কয়লা খাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং ঘটনা তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেছেন। এর আগেই সংশ্লিষ্ট কয়েক জনকে বরখাস্ত করা হয়। বিদায়ী এমডিসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ধীরেধীরে চুরির তথ্য আরও ফাঁস হচ্ছে। খেয়ে ফেলা শুধু উল্লিখিত ১ লাখ ৪২ হাজার টন নয়। চুরির পরিমাণ আরও বেশি। প্রায় আড়াই লাখ টন বলে জানা গেছে। যে কয়লা ওপরে তোলা ছিল শুধু কি সেগুলোই খোয়া গেছে, না খনির ভেতর থেকেও সব সাবাড় করা হয়েছে, তাইবা কে নিশ্চিত করে বলবে! কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যখন পুরোই বন্ধ করে দিতে হলো তখন সেটা বড়পুকুরিয়ার পুকুরচুরি নয়। ‘সাগরচুরি’ই হবে। আজকাল পুকুরটুকুর চুরিতে আর লাভ কত? চুরি করলে সাগরটাগরইতো করা উচিত, কী বলেন?
জেনে রাখা ভালো, এতো কয়লা কি এক-দুই দিনে কেউ খেয়ে ফেলেছে বা গায়েব হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই না। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির এমডি, জিএম, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ সবাই জানেন এতো কয়লা কার পেটে কীভাবে ঢুকেছে। এমনকি ঢাকাস্থ পেট্রোবাংলার হেড অফিসেরও কয়লা গায়েবের খবর জানবার কথা। গোড়া ধরে টান দিলে সব খবর বেরুবে। উত্তরাঞ্চলের যত ইটভাটা আছে সবগুলোতে বড়পুকুরিয়ার কয়লা গেছে। এমনকি ঢাকা মহানগরীর আশপাশে যতো ইটভাটা আছে সেগুলোতেও বড়পুকুরিয়ার কয়লা পুড়েছে। দেশের অন্য জায়গার ইটভাটাতেও এই কয়লা গেছে শতশত ট্রাকে করে। সঠিক তদন্ত হলে বড়পুকুরিয়া থেকে যে কেবল পুকুরই চুরি হয়নি, সাগরও চুরি হয়েছে তাও বেরুবে। আমারতো মনে হয়, শুধু ওপরে স্তুপিকৃত কয়লাই লোপাট হয়নি। খনির নিচের কয়লাও শেষ করে ফেলেছে। কি পরিমাণ কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছে তার হিসেবও হয়তো ঠিকমতো রাখা হয়নি। রাখলে এতো কয়লা খেয়ে হজম করবার কথা নয়। তাই কয়লা উত্তোলনের লগবইও চেক করা দরকার।

আমাদের উন্নয়ন কর্মকর্তা ও কর্মীদের দেশপ্রেম কতটা গভীর ও প্রবলতর হলে সড়ক ও রাস্তাঘাট এবং কালভার্ট নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ আর সিমেন্টের পরিবর্তে শুধু কাদামাটি দিয়ে কাজ সেরে বিল পাস করিয়ে নিতে পারেন তা ভাবলে বুক গৌরবে ভরে যেতে চায় আর কী।
বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার ফলে উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের চন্দরিয়া থেকে সাবেক প্রধানশিক্ষক আবদুল হাকিম আমাকে জানান, এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ থাকছে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অন্ধকারে ডুবে থাকছে উত্তরের পুরো জনপদ। তীব্র গরমে জনজীবন হয়ে উঠেছে দুঃসহ। শিশু ও বয়স্করা গরমে করছে হাঁসফাঁস। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এ অবস্থা এক মাস অব্যাহত থাকবে।

শুধু বড়পুকুরিয়ার কয়লাই খোয়া যায়নি বা খেয়ে ফেলেনি চোরের দল। দেশের অনেক প্রকল্পের অবস্থায়ই বড়পুকুরিয়ার মতো ফকফকা। ব্যাংকের টাকা গায়েব। রেলের চাকা, বগি গায়েব। সুন্দরবনের সুন্দরি গাছও লাপাত্তা। মহানগরী ঢাকাসহ সারাদেশের রাস্তাঘাট বানাবার কয়েক মাসেই সাফা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গায়েব। বহু স্কুলকলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসিতে একজনও পাস করছে না। মানে শিক্ষকরা ফাঁকি দিচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীরা কিছুই শেখেনি ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে। মানে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেবার নামে তাদের জীবন বিনষ্ট করেছেন বা খেয়ে ফেলেছেন। অন্যথায় শতশত স্কুলকলেজ থেকে একজনও পাস করবে না, তা ভাবা যায়? হবেইবা না কেন? ঘুষ দিয়ে স্কুল অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। এমপিও দেয়া হয় একই কায়দায়। তারপর জিপিও ফাইভ বা ‘এ প্লাস’ এসবও নাকি অর্থের বিনিময়ে মেলে। এমন অবিশ্বাস্য সচিত্র রিপোর্ট সম্প্রচারিত হয়েছে টিভি চ্যানেলে। আমরা কোন দেশের বাসিন্দা ভাবলে মুখ লুকোবার জায়গা পাওয়া ভার হয়ে যায়। কোথায় যাই বলুন?

যাই হোক, বড়পুকুরিয়ার কয়লা খাওয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কয়েকজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে নির্দেশ দিয়েছেন। দুদক ইতোমধ্যে কয়লা গায়েবের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জব্দ করেছে দুদক। এতো কয়লা শুধু চুনোপুঁটিতে খেয়েছে বলে মনে হয় না। কয়লাখোর রাঘববোয়ালও থাকতে পারে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় শুধু কয়লাখোর নয়, কাউকেই থামানো যাবে না। এমনকি এসব চোর আমাদের প্রিয়দেশও গিলে ফেলতে পারে। তাই দেশের সম্পদ ও দেশ বাঁচাতে চোর-ডাকাত সবকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া একান্ত জরুরি। এর কোনও বিকল্প নেই। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি প্রকল্পের সন্দেহভাজন কয়লাখোর এমডিসহ আরও ৪ কর্মকর্তার বিদেশগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলে সব কয়লাখোর চিহ্নিত হয়ে আসবে আইনের আওতায়।

http://www.dailysangram.com/post/339570