২৬ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৯

২২৭ কোটি টাকার কয়লা চুরির নাটের গুরু প্রধানিয়া

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে ২২৭ কোটি টাকা মূল্যের এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা উধাওয়ের নাটের গুরু বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) সদ্য সাবেক জিএম (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব আবুল কাশেম প্রধানিয়া। পেট্রোবাংলার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির জমা দেয়া রিপোর্ট এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা মিলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে জুনিয়র অফিসার পদে চাকরি পাওয়ার পর থেকে একই কোম্পানিতে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত ছিলেন আবুল কাশেম প্রধানিয়া। এ প্রতিষ্ঠানে চাকরিকালীন সময়ে কর্মচারী ইউনিয়নের সঙ্গে মিলেমিশে কোল মাইনিং কোম্পানিটি নিজের মতো চালিয়েছেন প্রধানিয়া। যেসব ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা জিএম পদে কর্মরতরা তার কথা শুনতেন না কর্মচারী ইউনিয়নের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আন্দোলন উসকে দিতেন। আন্দোলন হলে সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে ওই সব কর্মকর্তাদের বদলি করতেন।
এরপর সুবিধা মতো কর্মকর্তাকে নিজের প্রতিষ্ঠানে বদলি করে নিয়ে যেতেন। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, জিএম (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব পদে বেশ কয়েক বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন আবুল কাশেম প্রধানিয়া। এ পদে থেকেই কয়লা চুরির সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেদারসে কয়লা লোপাটে সহায়তা দেন এ কর্মকর্তা। এজন্য বড়পুকুরিয়া থেকে বড় ধরনের কয়লা গায়েব হওয়ার তথ্য বের হওয়ার পর থেকে অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকেন এ কর্মকর্তা। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২২শে জুলাই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয় বিসিএমসিএল এর জিএম (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রুমে এসে তিনি নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অসংলগ্ন আচরণ শুরু করেন। বলেন, স্যার আমাদের ইজ্জত আর থাকল না। কয়লা চুরির তথ্য মোটেও সঠিক নয়।

আসলে সিস্টেম লসের কারণে এমনটা হয়েছে। তিনি এও বলেন, কয়লা বাতাসে উড়ে যায় এ বিষয়টিও আপনাদের মাথায় রাখতে হবে। এমন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছ থেকে এমন বক্তব্য শুনে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার উপর রুষ্ঠ হন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আবুল কাশেমকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানোর আগেই তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য তার সম্পর্কে জেনে কাশেমকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডে বদলি করা হয়। মিডিয়াতে কয়লা গায়েব নিয়ে আজগুবি তথ্য দেন আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ১৭ একর জমিতে কয়লাগুলো স্তূপ করে রাখা হয়। ২০০৫ সালের পর এ পর্যন্ত কখনো স্তূপে কয়লা ১ লাখ ৫০ হাজার টনের নিচে নামেনি। ২০০৫ সাল থেকে অন্তত ৭/৮ জন এমডি এখান থেকে চলে গেছেন। এতদিন বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। এখন এসেছে। আবুল কাশেম প্রধানিয়া বলেন, বিশ্বের প্রতিটি কয়লা খনিতে ২ থেকে ৫ শতাংশ সিস্টেম লস থাকে।

সিস্টেম লসের কারণে কয়লা শুকিয়ে যায়, অটোমেটিক জ্বলে যায়, কয়লা বাতাসেও উড়ে যায়। বাতাসে উড়ে যাওয়ার কারণে কয়লা অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। সম্প্রতি কয়লা গায়েবের কারণে বদলি হওয়ার পর আবুল কাশেম প্রধানিয়া সাংবাদিকদের বলেন, বদলির সময় বলা হয়েছে, এখানে ঝামেলা চলছে। তুমি অন্য জায়গায় যাও। আমাকে ভালো জায়গাতেই বদলি করা হয়েছে। এদিকে কয়লা গায়েব হওয়া নিয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (মাইন অপারেশন) কামরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গতকাল রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তবে কমিটির রিপোর্টের বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক শামসুল আলমের নেতৃত্বে কয়লা গায়েব হওয়ার তথ্য যোগাড়ে কাজ করছেন। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক তাজুল ইসলাম। এরই মধ্যে এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) চার শীর্ষ কর্মকর্তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)- এর সুপারিশের ভিত্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা থাকা কর্মকর্তারা হলেন- বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির এমডি হাবিব উদ্দিন আহমেদ, দুই মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবুল কাশেম প্রধানিয়া ও আবু তাহের মো. নুরুজ্জামান চৌধুরী এবং উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খালেদুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএমসিএল এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (পেট্রোবাংলার পরিচালক) আইয়ুব খান চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমার কাছে আসেনি। সচিব মহোদয় ও চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে হয়তবা তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়েছে। তাদের কাছ থেকে যে নির্দেশনা পাবো ওই অনুযায়ী কাজ করবো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আবুল কাশেম প্রধানিয়া বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে নিয়োগ পেয়ে সেখানেই এতদিন ধরে কর্মরত ছিলেন।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় খনির ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে খনি কর্তৃপক্ষ। কয়লা উধাওয়ের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তরের আট জেলায় বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। আগের চেয়ে লোডশেডিং বাড়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন গ্রাহকরা। কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কয়লা কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের ধরতে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক।
এদিকে রাতে কয়লা গায়েবের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নেন।

কয়লাচুরির ঘটনায় এমডিসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা
স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর থেকে জানান, পার্বতীপুর বড়পুকুরিয়া খনি থেকে ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব কেলেঙ্কারির ঘটনায় খনির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টায় পার্বতীপুর মডেল থানায় দুর্নীতি দমন আইনের ৫(২) এবং ৪০৯ ধারায় ওই মামলা করেছেন খনির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনিছুর রহমান।

অন্য আসামিরা হলেন- সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) খালেদুল ইসলাম, সাময়িক বরখাস্ত উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর) আবুল কাশেম প্রধানিয়া, সাবেক মহাব্যবস্থাপক কোম্পানি সচিব মোশারফ হোসেন, ব্যবস্থাপক (এক্সপ্লোরেশন) মাসুদুর রহমান হাওলাদার, ব্যবস্থাপক (জেনারেল সার্ভিসেস) অশোক কুমার হালদার, ব্যবস্থাপক (প্রডাকশন ম্যানেজমেন্ট) আরিফুর রহমান, ব্যবস্থাপক (মেইনটেনেন্স অ্যান্ড অপারেশন) জাহিদুল ইসলাম, ব্যবস্থাপক (ডিজাইন, কন্সট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) একরামুল হক, উপ-ব্যবস্থাপক (সেইফটি ম্যানেজমেন্ট) খলিলুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (কোল হ্যান্ডলিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট) মোর্শেদুজ্জামান, উপ-ব্যবস্থাপক (মেইনটেনেন্স অ্যান্ড অপারেশন) হাবিবুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রডাকশন ম্যানেজমেন্ট); জাহিদুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (মাইন ডেভেলপমেন্ট), সত্যেন্দ্র নাথ বর্মণ, সহকারী ব্যবস্থাপক (ভেনটিলেশন ম্যানেজমেন্ট) সৈয়দ ইমাম হাসান, ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) জোবায়ের আলী, উপ-মহাব্যবস্থাপক (মাইন প্লানিং অ্যান্ড অপারেশন) আব্দুল মান্নান পাটওয়ারী, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) এবং গোপাল চন্দ্র সাহা, মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) এবং কর্মকর্তা আবু তাহের মোহাম্মদ নুরুজ্জামান চৌধুরীকে।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির প্রায় ২৩০ কোটি টাকা মূল্যমানের ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লা ঘাটতি অথবা চুরির সঙ্গে ওই ১৯ কর্মকর্তা জড়িত বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগে, মজুতকৃত কয়লার হিসাবের গড়মিলের বিষয়টি দুর্র্র্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) এবং ৪০৯ ধারা অনুযায়ী এজাহারভুক্ত করে তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়।
অভিযোগে দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে পার্বতীপুর মডেল থানার ওসি হাবিবুল হক প্রধান জানান, তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পার্বতীপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফকরুল ইসলাম জানান, এজাহারে কিছু ত্রুটি রয়েছে। তাছাড়া নিরাপরাধ কেউ যাতে অযথা মামলায় জড়িয়ে হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=127570