২৬ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৮

বেশির ভাগ ভোটার মেয়র পদে ভোট দিতে পারেননি

নজিরবিহীন কারচুপি ও প্রকাশ্যে ভোট

কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচন

নৌকা প্রতীকের চিহ্নিত কর্মী-সমর্থক ছাড়া কক্সবাজারের কোনো ভোটার গতকাল অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে ভোট দিতে পারেননি। কিছু সংখ্যক ভোটার যারা দিয়েছেন তারা প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারতে বাধ্য হয়েছেন। কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে ছিল না ভোট দেয়ার গোপন কক্ষ। ভারী বর্ষণ উপেক্ষা করে যারা ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়েছেন তারা পাননি মেয়রের ব্যালট। ভোটকেন্দ্রের বাইরে ও ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিপুল সংখ্যক বহিরাগত লোকজন নৌকা প্রতীকের সমর্থনে সার্বক্ষণিক পাহারা ও নজরদারি করে ভোট আদায়ের এই দৃশ্য অসহায়ের মতো দেখেছে কক্সবাজারের মানুষ। ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ অনেক পেশার মানুষ ফেরত এসেছে কেন্দ্র থেকে ব্যালট না পেয়ে। দু’টি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। এককথায় ব্যাপক জালভোট, প্রকাশ্যে সিল মারা এবং অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনকে নজিরবিহীন প্রহসনের নির্বাচন বলে এটিকে গতকাল দুপুরের পর থেকেই একে একে বর্জন করেছেন নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীকের মেয়রপ্রার্থীরা। তারা আবার নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টায় এবিসি ঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারা হচ্ছে। এর আগে বের করে দেয়া হয় অন্য প্রার্থীর বেশির ভাগ এজেন্টদের। এ সময় চা পানরত ছিলেন কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার মুজিবুল হক। দেখা যায়, এই অনিয়মের প্রতিবাদ করছেন নাগরিক কমিটির মেয়রপ্রার্থী সরওয়ার কামালকে। প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের একপর্যায়ে প্রিজাইডিং অফিসার নিজেকে নৌকার সমর্থক বলে উল্টো মেয়রপ্রার্থীকে ধমক দেন। একজন মহিলার হাত থেকে মেয়রের ব্যালটটি নিয়ে একজন নৌকায় সিল মেরে মহিলার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এভাবেই সেখানে চলে ভোট গ্রহণ। বেলা ১১টার দিকে উত্তর নুনিয়াছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে দেখা যায়, সেখানে ভোট দেয়ায় জন্য গোপন বা আলাদা কোনো কক্ষ নেই। ব্যালট পেপার কালেকশনের টেবিল থেকে একটু দূরে ব্যালটে সিল মারার টেবিলটি আলাদা করা আছে; কিন্তু তাতে কোনো পর্দা নেই। প্রকাশ্যে সিল মারতে বাধ্য করা হচ্ছে সেখানে এবং ওই কেন্দ্রে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মেয়রপ্রার্থীর এজেন্টকেই ঢুকতে দেয়া হয়নি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে যান কক্সবাজারের একটি স্থানীয় পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। তিনি ব্যালট পেপার হাতে নিলে কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে বলেন, নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে সিল মারতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাংবাদিক বলেন, ‘পরিবেশ এমন করা হয় যে তিনি অবশেষে নৌকায় সিল মারতে বাধ্য হন’। গোপন কক্ষ না থাকার বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসার মো: আবদুল করিম বলেন, এখানে সবাই এভাবেই ভোট দিচ্ছে। কেউ তো আপত্তি করছেন না। ঠিক এরকমই ভোট গ্রহণ হয়েছে ওই এলাকার হোসেন ফকির সুন্নিয়া মাদরাসাকেন্দ্রে, মধ্যম নুনিয়াছড়ার বিমানবন্দর প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রসহ আরো কয়েকটি কেন্দ্রে। ওইসব কেন্দ্রসহ কুতুবদিয়াপাড়া এবং সমিতিপাড়া এলাকার সব ভোটকেন্দ্রে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মেয়রপ্রার্থী এবং তার সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্র তো দূরের কথা রাস্তা ঘাটেও দাঁড়াতে পারেনি। দুপুর ১২টার দিকে কস্তুরাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যান কক্সবাজার পৌরসভার এক কর্মচারী দম্পতি। কিন্তু তারা যাওয়ার আগেই তাদের ভোট অন্যরা দিয়ে দিয়েছে বলে জানান।
নাম গোপন রাখার শর্তে তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রিজাইডিং অফিসারকে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাইনি। বেলা ২টার দিকে বর্ষণ উপেক্ষা করে পরিবারের ছয়জন ভোটার নিয়ে লাইট হাউজপাড়া মাদরাসাকেন্দ্রে ভোট দিতে যান সৌদি ফেরত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাওলানা আনোয়ার হোসেন।

তিনি ব্যালট পেপার না পেয়ে সবাইকে নিয়ে ফেরত আসেন। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, আগে বিদেশ থেকে শুনেছি বাংলাদেশে একজনের ভোট অন্যজন দিয়ে দিতে। আজ তা প্রমাণ পেলাম। প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে ব্যালট না পাওয়ার বিষয়ে জানালেও তিনি কোনো প্রতিকার করতে পারেননি। বেলা ১টার দিকে কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা মুখোশ পরা ব্যক্তি কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। পরে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা এসে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশকেও ফাঁকা গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
দুপুরে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উমিদিয়া জামেয়া কেন্দ্র গুলিবর্ষণের মাধ্যমে দখল করে নেন এক কাউন্সিলর প্রার্থী। আমিনুল ইসলাম মুকুল নামের অপর এক কাউন্সিলর প্রার্থী এ সময় কেন্দ্র দখল ঠেকাতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাইরে পরিস্থিতি সামাল দিলেও কেন্দ্রের অভ্যন্তর থেকে আউট হন মুকুল। সেখানে চলে তখন প্রকাশ্যে সিল মারার উৎসব। বেলা ১১টার দিকে ভোকেশনাল কেন্দ্রে এক মহিলা ভোটারের হাত থেকে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট নিয়ে তাতে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে দেন এক আওয়ামী লীগ নেতা। নাগরিক কমিটির মেয়র প্রার্থীর সামনে এ ঘটনা ঘটলেও তিনি প্রতিবাদ করা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি। প্রায় সব কেন্দ্রেই ভোটারের হাত থেকে মেয়র পদের ব্যালট জোর করে কেড়ে নিলেও কারো প্রতিবাদ করার উপায় ছিল না। এ দিকে এসব কেন্দ্র ঘুরে এবং প্রশাসনকে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার না পেয়ে দুপুরের পরে ভোট বর্জন করেন নৌকা ছাড়া অন্য সব মেয়র প্রার্থী।

কেন্দ্র দখল করে নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থীর ব্যালটে গণহারে সিল, নিজেদের এজেন্ট বের করে দেয়া ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন জামায়াত সমর্থিত নাগরিক কমিটির প্রার্থী সরওয়ার কামাল ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী রফিকুল ইসলাম। পৃথক সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদ্বয় ফের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানান। এ ছাড়া নিজের ফেসবুক পেইজে প্রহসন ঘৃণ্য ও নজিরবিহীন কারচুপির ভোট আখ্যা দিয়ে বর্জন করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী রুহুল আমিন সিকদার।

বেলা আড়াইটায় নিজের বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক কমিটি প্রার্থী সরওয়ার কামাল অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ বিপুলসংখ্যক বহিরাগত দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে বুধবার সকাল থেকে কক্সবাজার পৌরসভার ৩৯টি ভোটকেন্দ্র দখলে নেয়। পরে ওই ক্যাডাররা মেয়র প্রার্থীর ব্যালটে নৌকা প্রতীকের ওপর নিজেরাই সিল মেরে ভোটারদের হাতে ধরিয়ে দেয়। কখনো কখনো নিজেরাই সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কোথাও কোথাও তার এজেন্টদের বের করে দিয়েছে এবং কোনো কোনো কেন্দ্রে এজেন্টদের জিম্মি করে নৌকায় সিল মেরেছে। প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি। প্রশাসন এ কাজে সহযোগিতা করেছে। তিনি বলেন, সকালে আমি নিজে এবিসি ঘোনা কেন্দ্রে গিয়ে দেখি একজন প্রিজাইডিং অফিসার (কক্সবাজার সরকারি কলেজের প্রভাষক) স্বয়ং নৌকার পক্ষে সিল মারতে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করছে। এতে আমি প্রতিবাদ করলে তিনি নিজকে আওয়ামী লীগ কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে উল্টো উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এভাবে প্রায় ২০টি কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট আদায়ের উৎসব হয়েছে। তিনি আবদুল বাতেন নামে এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেন, ওই সরকারি কর্মকর্তা কক্সবাজার এসে ভোট ডাকাতির পরিকল্পনা এবং তার পরিকল্পনা ও সরাসরি হস্তক্ষেপে কক্সবাজারে প্রহসনের একটি র্নিবাচনের আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন। কক্সবাজারের ইতিহাসে এমন ভোট ডাকাতি আর হয়নি। এ নির্বাচন আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো: গোলাম কিবরিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান জি এম রহিমুল্লাহ ও ভিপি ছৈয়দ করিম উপস্থিত ছিলেন।
অন্য দিকে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে বেলা সাড়ে ৩টায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী রফিকুল ইসলাম ভোটকেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে পুনর্নির্বাচন দাবি করেন। তিনি বলেন, ১৯টি কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আওয়ামী ক্যাডাররা বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিয়ে ব্যালট পেপার ছিনতাই, জালভোট প্রদান ও নৌকা প্রতীকে জোর করে সিল মেরেছে। এ ছাড়া বেলা ১টার পর থেকে ২০টি কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থীর সব ব্যালট পেপার নিয়ে গিয়ে নৌকায় সিল মেরেছে। ফলে অসংখ্য ভোটার উপস্থিত হয়ে ব্যালট পেপার না পেয়ে ভোট দিতে পারেননি। তিনি বলেন, কক্সবাজারে এ ভোট ডাকাতি স্বৈরাচারী এরশাদ আমলেও হয়নি উল্লেখ করে আবার কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচন দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা লুৎফুর রহমান কাজল, জেলা সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, ইউছুপ বদরী প্রমুখ।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/336139