২৬ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৬

দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র!

ভারতীয় ও দেশীয় বিরাট যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন না, বিপুল কয়লা মজুদ থাকার কথা থাকলেও কয়লা ইয়ার্ড এখন শূন্য মাঠ। এখান থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হওয়া নিছক কোন দুর্ঘটনা বা কতিপয় ব্যক্তির দুর্নীতি সর্বস্ব ব্যাপার নয় বলে বিশেষজ্ঞদের দাব। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১০ বছরের শাসনামলে বড়পুকুরিয়ায় লুটপাট হয়েছে শত শত কোটি টাকা। সর্বশেষ ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা গায়েবের ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টিতে প্রশ্ন উঠেছে- এতদিন এতো টাকা লুটপাট হয়েও সেভাবে প্রকাশ হয়নি, এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতেই কি এসব প্রকাশ করা হলো। যা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি অথবা সুন্দরবন বিনষ্টকারী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে যৌক্তিক করবে! বড়পুকুরিয়ার কয়লা গায়েব নিয়ে দেশের সর্বত্র যখন ব্যাপক আলোচনা জন্ম দিচ্ছে, তখন এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নানা হিসাব-নিকাশও কষছেন। শুধু তাই নয়, যাদের জমি অধিগ্রহণ করে নির্মিত হয়েছে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র তারাও গত মঙ্গলবার দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে হয়ে উঠছেন সোচ্চার। দুর্নীতিবাজদের শাস্তির দাবিতে তারা সাংবাদিকদের সাথে খোলামেলা কথা বলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা খোলা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোকসানের যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদাতা ও এলাকাবাসী জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র জোর দাবি জানিয়েছেন। গত সোমবার ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধের ফলে দিনাজপুরসহ রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা পড়বে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। এ জন্য এলাকার মানুষ বর্তমান সরকারকেই দূষছেন। সরকারের গাফলতি ও নানা অব্যবস্থাপনায় এ ঘটনা ঘটেছে। আর তাৎক্ষণিক লাভবান হয়েছেন খনির অসাধু কর্তা ব্যক্তি ও সরকারের কতিপয় সুবিধাবাদীরা। আর সুদূরপ্রসারী লাভবান হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকার। দুদকের অনুসন্ধানেও সেখানকার দুর্নীতির প্রাথমিক বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। গত সোমবার দুদকের একটি টিম প্রাথমিক তদন্তে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা গায়েবের প্রাথমিক সত্যতা পায়।

গত মঙ্গলবার অধিগ্রহণকৃত জমির মালিক মৃত নুরুল হুদা চৌধুরী’র পুত্র মোহাম্মদ আলী চৌধুরী জানান, আমি নিজে জাতীয় স্বার্থে ১৪ একর ১২ শতক, আমার ভাই শওকত আলী চৌধুরী ১৪ একর ১২ শতক, লিয়াকত আলী চৌধুরী ১৪ একর ১২ শতক, নজরুল ইসলাম চৌধুরী সহ আমরা আট ভাই এবং গ্রামের বিভিন্ন লোকজনের জমি সরকার অধিগ্রহণ করে। আমরা ভেবেছিলোম বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষদের বিদ্যুৎতের কষ্ট লাঘব হবে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা কালো বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। আমরা উক্ত দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি। খনি এলাকাবাসী জানান, আমরা দেশের স্বার্থে এবং আমাদের নিজ এলাকায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার আশায় জমি দিয়েছি। অথচ খনির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা চুরি করে কোটি কোটি টাকার কয়লা বিক্রি করে দেয়ায় আমরাই এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছি না।

খনি সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোন ডিও ছাড়াই খনি থেকে বের হয় ৩০০ মেট্রিক টন কয়লা। মজার ব্যাপার- যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়েই খোয়া যাওয়া কয়লার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়। কারা এই কয়লা চুরি করেছিল বা গেট থেকে ট্রাক ভর্তি কয়লা কিভাবে কোথায় গেল তার কোন হদিস মেলেনি আজো। ২০০৮ সালে দুই কোটি ৯ লাখ টাকার তামা চুরি হয়। এ ঘটনায় একজন সাধারণ শ্রমিকের নামে মামলা হলেও আদালতের রায়ে সে বেকসুর খালাস পায়। কিন্তু চুরি যাওয়া তামা আর উদ্ধার হয়নি। এভাবে আরো কত কোটি টাকার মালামাল চুরি হয়েছে তা কেউই সঠিক করে বলতে পারছেন না। তবে খনিতে পুকুর চুরির ঘটনা খনির কর্মকর্তা, শ্রমিক ও এলাকাবাসী অবলীলায় স্বীকার করেন। তাদের মতে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সদস্য দলীয় বিবেচনায় মন্ত্রী, এমপি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ পেট্রোবাংলার পদস্থ কর্মকর্তা এবং খনির কতিপয় কর্মকর্তারা। সিন্ডিকেট কোন ধরনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ডিও ও বিশেষ ডিও এর মাধ্যমে ফড়িয়াদের নিকট কয়লা বিক্রি করে। বিনিময়ে আয় করে লাখ লাখ টাকা কমিশন।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে উত্তোলনকৃত কয়লার মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার মেঃ টন কয়লা ঘাটতি রয়েছে। কাগজে কলমে এই কয়লা থাকার কথা থাকলেও দৃশ্যমান নেই। কয়লার হিসাব মিলাতে না পারার কারনে গত ১৯ জুলাই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কোম্পানির সচিব (জিএম প্রশাসন)কে প্রত্যাহার করেছে, একই কারনে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মাইনিং এন্ড অপরেশন ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর)কে সাময়িক বহিস্কার করেছে। যদিও খনি কর্তৃপক্ষ বলছে এক লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা সিস্টেম লস। তাদের দাবি গত ১১ বছরে এক কোটি ১০ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে এর মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা সিস্টেম লস। এদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেক্ট্রি সাপ্লাই কোম্পানি লিঃ নেসকো’র প্রধান প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেন সরকার জানান, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় প্রতিদিন ৬৫০ মেগওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে ৫২৫ মেগওয়াট বিদ্যুৎ আসে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। গত এক মাসে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২টি ইউনিট বন্ধ থাকায়, সেখান থেকে মাত্র ১৫০ মেগওয়াট বিদ্যুৎ আসায় গত এক মাস থেকে বিদুতের কিছু ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় এই ঘাটতি আরো বাড়লো। এ প্রভাবে বিদ্যুতের লো-ভোল্টেজ ও লোড শেডিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ারউর রহমানের শাসনামলে বড়পুকুরিয়া বাজারে একটি গভীর সেচ পাম্প বসাতে গিয়ে কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের সময় চীনা কোম্পানী সিএমসির সাথে চুক্তি, ১৯৯৪ সালে বাস্তবায়নের কাজ শুরু এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে ২০০৬ সালে খনিটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। ২০০৮ সালের শেষে এসে খনিটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার হস্তক্ষেপে দলীয় বিবেচনায় খনি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদবঞ্চিত এবং দলীয় বিবেচনায় কয়লার ডিও ফড়িয়াদের হাতে দেয়া শুরু হয়। এতে করে ধীরে ধীরে খনিটি একটি দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিণত হয়। আমদানিকৃত নিম্নমানের কয়লা’র সাথে বড়পুকুরিয়া কয়লা মিশ্রিত করে বিক্রি’র শুরু করা হয়। এহেন নানান দুর্নীতি ও অপকর্মে সর্বশেষ আজ কয়লা খনিটি ও কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেল।

http://www.dailysangram.com/post/339278