২৬ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৪

একতরফা সংসদ নির্বাচনের নতুন চেষ্টা!

এতদিন কোনো খবরাখবর না নিলেও হঠাৎ করেই বামদলগুলোর প্রতি হাত বাড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এটি তখনই করা হচ্ছে যখন সরকারের দমন পীড়নসহ অপশাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ৮ দলের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করা হলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বামদলগুলোকে কাছে টানতে চাইছে সরকারি দল। কারণ বিরোধী জোট বিশেষ করে ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা আরও বেশ কয়েকটি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাম দলগুলোও একই দাবিতে ২০১৪ সালের একতরফার নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীতেও যে একতরফা নির্বাচনের স্বপ্ন ক্ষমতাসীনরা দেখছে তাতে গণতন্ত্রমণা এই দলগুলোকে কাছে টানতে চাইছে সরকারি দল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে করে সরকারি দলের কোনো লাভ হবেনা। কারণ গত ৫ বছর ধরে বামদলগুলোও দেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে আসছে। এই অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের কোনো কুপ্রস্তাবে তারা সাড়া দেবেনা এটা অন্তত নিশ্চিৎ।
সূত্র মতে, গত ১৮ জুলাই আত্মপ্রকাশ করা নতুন বাম গণতান্ত্রিক জোট নামে যে জোট গঠন করা হয়েছে তাতে আছে আটটি রাজনৈতিক দল, যার সবগুলো বামপন্থী ঘরানার দল হিসেবেই পরিচিত। জোটে আছে - সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন ও বাসদ (মার্ক্সবাদী। এর মধ্যে কয়েকটি দলের আগেও আওয়ামী লীগের সাথে একসাথে আন্দোলন ও নির্বাচন করার অভিজ্ঞতাও আছে। ২০১৪ সালের ৫ ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি সিপিবি। ওই নির্বাচনটি বর্জন করেছিলো বিএনপি তার সমমনা দলগুলো। এবারও যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয় সেক্ষেত্রে এসব দলকে নির্বাচনে রাখাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও সিপিবি সভাপতি বলছেন তারা এবারও দরকার হলে ভোট করবেন, আবার দরকার হলে ভোট বর্জন করবেন।

সূত্র মতে, ঢাকায় হঠাৎ করেই গত মঙ্গলবার দুপুরে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কার্যালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বেশ কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন দলটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে। যদিও উভয়পক্ষই বলছেন এটি নিছক রাজনৈতিক সৌজন্যতা। আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক কোন বৈঠক নয়। তবে এ নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলগুলো। প্রশ্ন উঠেছে ১৪-দলীয় জোট বা মহাজোটের বাইরে থাকা দলগুলোকে লক্ষ্য করে আলাদা করে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কি-না ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে। ওবায়দুল কাদের অবশ্য সিপিবির সাথে বৈঠকের মধ্যে কোন রাজনৈতিক মেরুকরণ থাকাকে উড়িয়ে দিয়েছেন।

নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে এটা সৌজন্য সাক্ষাতই ছিলো এবং ফোনে সৌজন্য কথা হয়েছে তার সাথে বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকীর সাথেও। কিন্তু এগুলো কি নিতান্তই সৌজন্য সাক্ষাত বা কথাবার্তা? এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন, এর সাথে নির্বাচন বা রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না আসার ভুল এবার করবে কি-না জানিনা। তবে আমরা চাই একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সিপিবি বা সিপিবির নেতৃত্বে সম্প্রতি যে বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়েছে সেই জোটকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে নেয়ার কোনো তৎপরতা শুরু হয়েছে কি-না তা নিয়েও নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে ওবায়দুল কাদেরর সিপিবি অফিসে যাওয়ার পর থেকেই।

তবে জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলছেন, আওয়ামী লীগ তার অবস্থানে থেকে সে চেষ্টা করতেই পারে। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে বেশি দলকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা সরকারি দল করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের জোট আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কারও সাথেই যাবেনা। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিবো পরিস্থিতির আলোকে।
একই ধরণের কথা বলেছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি জানান, ওবাদুল কাদেরের সাথে তাদের পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন নিয়ে নানা গল্প হয়েছে তাদের কার্যালয়ে। রাজনীতি, নির্বাচন কিংবা জোট মহাজোট নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো বিরোধী জোট। আমরা বর্তমান দু:শাসনের অবসান চাই, পাশাপাশি আও্যয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপির দু:শাসন আসুক সেটাও চাইনা।

তারপরেও বাম দল বা জোট নিয়ে এতো আলোচনা কেন? আওয়ামী লীগের সাথে বাম দলের ইস্যুভিত্তিক ঐক্য বা জোট নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বামপন্থী দলের সাথে ঐক্য করেছে দলটি। এমনকি বর্তমান সরকারেও আছেন বামপন্থী কয়েকজন নেতা ও দল। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ বা সিপিবি যাই বলুক আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের জোটকে আরও সম্প্রসারণ করতে চায় সরকারি দল। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে কাউকে নেয়া হলে সেটি হবে জোটের শরীকের মতামতের ভিত্তিতেই বা যথেষ্ট যাচাই বাছাই করেই। যাদের ১৪-দলীয় জোটে নেয়া হবেনা তাদের মহাজোটে নেয়া হবে যাতে করে ১৪ দলীয় জোটও অক্ষুণ্ণ থাকে আবার মহাজোটের আকারও বাড়ানো যায়। এখন ওবায়দুল কাদেরসহ আরও কয়েকজন নেতা সিপিবির নেতৃত্বে সম্প্রতি ৮টি বাম দলেল যে জোট গঠন হয়েছে তাদের নেতাদের সাথে একটি সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন ওই একই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই।
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দৃঢ়তার সাথেই বলছেন আওয়ামী লীগের সাথে কোনো জোট করার চিন্তাই তাদের নেই, বরং কার্যকর বিরোধী দল হিসেবেই ভূমিকা পালন করে যাবেন তারা।
সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজন। নৌকা প্রতীক না পেলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা সামনে কতটুকু আছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ পেয়েছিলো বামপন্থীরা। পরের নির্বাচনগুলোতে তা আরও কমে আসে। নিজেদের মধ্যে অতিমাত্রায় বিরোধ, সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ নানা কারণে বামপন্থী দলগুলোর প্রভাব এখন আর তেমন একটা নেই। নির্বাচন কমিশনে বামপন্থী বলে পরিচিত এমন নিবন্ধিত দল আছে দশটি আর এর বাইরে নাম শোনা যায় আরও অন্তত পনেরটি দলের। আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে আছে দশটির মতো দল যারা বাম ঘরানার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেও আছে দুটি বাম ঘরানার দল। এসবের বাইরে এখন বাম ঘরানার দুটি জোট সক্রিয়- একটি সম্প্রতি গঠিত হওয়া বাম গণতান্ত্রিক জোট আর আরেকটি হলো জাতীয় মুক্তি জোট যাতে আছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণ ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে সরকারের বাইরে থাকা বাম দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কিন্তু এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে এসে শেষ পর্যন্ত ছোটো খাটো সব দল বা জোটেরই নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে মনে করা হচ্ছে, বিশেষ করে কোনো কারণে যদি বিএনপি এবারও নির্বাচনে অংশ না নেয়।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হক বলছেন এমন পরিস্থিতির সম্ভাবনা তারা মোটেও উড়িয়ে দিচ্ছেননা, যদিও তারা এখন এসব নিয়ে ভাবতে রাজী নন বলেই বলছেন তিনি। যদিও আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার মতে বাম ঘরানার অধিকাংশ দলের সাথেই যোগাযোগ শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশেই, যাতে করে সব দলের নির্বাচনে আসার একটা আবহ আগেই তৈরি করা যায়। আর এসব কারণেই সৌজন্য সাক্ষাত বলা হলেও হঠাৎ করে ওবায়দুল কাদেরের সিপিবি অফিসে যাওয়া এবং অন্য বাম নেতাদের সাথে সাক্ষাত বা ফোনে কথা বলার ঘটনা নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

http://www.dailysangram.com/post/339266