২৫ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১২:২৭

কয়লা কেলেঙ্কারি

পেট্রোবাংলার গাফিলতি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা কেলেঙ্কারিতে পেট্রোবাংলার গাফিলতি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারি এই সংস্থাটি অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কয়লা সংকটের কারণ কি জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, কয়লা চুরির
কেলেঙ্কারির সঙ্গে পেট্রোবাংলার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত। সংস্থাটির তদারকিতে যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে। এটা সাগরচুরির সমান বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, চুরির প্ল্যান একদিনের নয়।

এই চুরির অপারেশন করার জন্য ৬ থেকে ৭ মাস সময় নিয়েছে। দেড় লাখ টন কয়লার দাম বাইরে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা। আর এই কয়লা যদি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ক্রয় করতো তাহলে লাগতো প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। এটি উন্নতমানের কয়লা। প্রতিটন কয়লার বাজার দর ১৭ হাজার টাকা। পিডিবি কিনে টনপ্রতি ১১ হাজার টাকা করে। বিডি রহমতউল্লাহ আরো বলেন, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিট চালু থাকলে প্রতিদিন কয়লা লাগে ৫ হাজার টন। আর দেড় লাখ টন কয়লা দিয়ে চলতে পারে দেড় থেকে দু’মাস। দেড় লাখ টন কয়লা সরাতে কমপক্ষে ১৯ থেকে ২০ হাজার ট্রাক লাগে। স্থানীয় গ্রামের সাধারণ মানুষের বুঝার শক্তি নাই। তবে খনি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যারা কাজ করেন তারা বিষয়টি আঁচ করতে পারেন কয়লা কীভাবে গেছে। বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করতে হবে।

আরেক বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কেমিক্যাল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। দেশে কয়লা নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তিনি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে মানবজমিনকে বলেন, এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা সবকিছুর একটা উত্তর চাই। কয়লা চুরির ঘটনার এখনো সম্পূর্ণ তথ্য জানা নেই। সবাই ধারণা করে বলছেন। তিনি বলেন, খনিতে বারো বছরেও সিস্টেম তৈরি হয়নি। কয়লা কীভাবে মাপতে হয়, কীভাবে রাখতে হয়। এখানে হিসাবের গরমিল থাকতে পারে। হঠাৎ করে কয়লা সংকট কেন হলো? চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটলো।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সামসুল আলম মানবজমিনকে বলেন, পেট্রোবাংলার গাফিলতি রয়েছে। সঠিকভাবে চলছে কিনা দেখেনি সরকারি এই সংস্থা। অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে সংস্থাটি। যার জন্য এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, শুধু কয়লাই নয়, গ্যাসে, বিদ্যুতেও কেলেঙ্কারি রয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কোম্পানিগুলোর পরিচালনা বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয়, জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের সরাতে হবে। না হলে এধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

এদিকে, গতকাল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। দুদকের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের পরদিন মঙ্গলবারই কমিটির সদস্যরা আকস্মিকভাবে কাওরান বাজারে পেট্রোবাংলা কার্যালয়ে যান। সেখানে তারা বেলা দেড়টা থেকে দু’ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন। তারা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহসহ সংস্থার আরো কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেন বলে দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। অনুসন্ধান কমিটির তদারক কর্মকর্তা কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বে এই দলে অনুসন্ধান কমিটির প্রধান দুদকের উপ-পরিচালক শামসুল আলম ও দুই সদস্য সহকারী পরিচালক এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন এবং সহকারী পরিচালক এএসএম তাজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। কাজী শফিকুল বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা নিয়ে দুর্নীতি বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথিপত্র চেয়েছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব নথিপত্র আমাদেরকে সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময় ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করবেন বলে কাজী শফিকুল জানান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩১শে জুলাই ও ২০১৮ সালের ২৫শে জানুয়ারি দুটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কয়লা বিক্রি করা হয়। গত ১৮ই মার্চ থেকেই বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে অন্য গ্রাহকদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ করা হয়। এদিকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৫-০৬ সালে বর্তমান স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। গত ১৩ বছরে একবারও কয়লা বিক্রি করার পর ইয়ার্ডে কি পরিমাণ কয়লা আছে রহস্যজনকভাবে তার হিসাব রাখা হয়নি। শুধু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এক কোটি ২২ হাজার ৯৩৩ টন কয়লা তোলা হয়েছে তার হিসাব আছে। প্রথম বছরে তিন লাখ তিন হাজার ১৫ টন কয়লা উত্তোলন করে। পরবর্তী বছর থেকে কয়লা তোলার পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৭ টন কয়লা তোলা হয়। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২১ হাজার ৬৩৮ টন। এভাবে প্রতি বছরই সাত থেকে নয় লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের গত মার্চ পর্যন্ত ৭ লাখ ৮২ হাজার ২১৪ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির শিফট পরিবর্তন করার কারণে কয়লা তোলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখতে কয়লার চাহিদা পূরণের সমান কয়লা মজুত রাখার অনুরোধ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এর পরিপ্রেক্ষিতে খনি কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে জানায়, এক লাখ টন কয়লা মজুত রয়েছে। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কোনো সংকট হবে না। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে কয়লা না থাকার বিষয়টি পিডিবিকে জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) সাঈদ আহমেদ পরিদর্শনে গিয়ে কয়লা না থাকার সত্যতা পান। কয়লা না থাকায় বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২২শে জুলাই রাত ১০টা ২০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বড়পুকরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবীব উদ্দিন আহমদ ও অন্যদের বিরুদ্ধে। ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ওই কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকায় রংপুর বিভাগের আট জেলা বিদ্যুৎ সংকটে পড়ায় বিকল্প পথ খুঁজছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=127387